Skip to content

ঘুরে আসুন সোয়াম্প ফরেস্ট

মো. জাভেদ-বিন-এ হাকিম
এই মেঘ এই বৃষ্টি, খানিক বাদেই রোদের হাসি—সবই প্রকৃতির খেয়াল। প্রকৃতি তার খেয়াল নিয়েই থাক, আমরা ‘দে-ছুট’ ভ্রমণ সংঘের দল তার তোয়াক্কা না করে ছুটে চলি প্রাকৃতিক কোনো এক বিস্ময়ের পানে। আমাদের এবারের ভ্রমণ ছিল দুটি পাতা একটি কুঁড়ি, দু শ’ ষাট আউলিয়ার পূণ্যভূমি সিলেট জেলার গোয়াইন ঘাট উপজেলার অন্তর্গত অপরূপ সৌন্দর্যের জলার বন রাতারগুল। চৌদ্দ জনের দল নিয়ে রাতের গাড়িতে রওয়ানা হয়ে সকালে গিয়ে সিলেট পৌঁছাই। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা আগে ভাগেই আমাদের নির্বিঘ্ন ভ্রমণের জন্য সবকিছু ঠিক করে রেখেছিলেন। ধন্যবাদ তাকে। হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে সোজা চলে গেলাম লালাখাল। এরমধ্যে প্রশাসনের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পলাশ ভাই সুনামগঞ্জ থেকে এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। তাকে সঙ্গী করতে পেরে আমরা দারুণ খুশি। সারী নদীর ঘাট থেকে ট্রলারে চেপে দুপুর পর্যন্ত লালাখালে ভেসে বেড়ালাম। সৌন্দর্যের উপমা লালাখালের বর্ণনা আজ আর নাইবা দিলাম। তারপর জোহরের নামাজ শেষে মটরঘাট গিয়ে ইটালি হোটেলে (চেয়ার টেবিলের বদলে খোলা আকাশের নিচে তিনটি দশ ইঞ্চি ইটের উপর বসার ব্যবস্থা) খিচুড়ি খেলাম। মরিচের গুঁড়া মেশানো আলু ভর্তা খেয়ে আলাল আর কামাল বে-সামাল। এরপরও ক্ষুধা পেটে সেই খিচুড়ি খেতে লেগেছে বেশ। দশ ইঞ্চি ইটের উপর বসার জন্য নামটা আমরাই দিয়েছি ইটালি হোটেল।

Sylhet

গাইড এমরানের ঠিক করা নৌকায় ভাসি, সাঁতার না জানা বন্ধুদের নিয়ে কিঞ্চিত্ সংশয়, তবুও তারা বেশ উত্ফুল্ল। বনের গভীরে ঢুকবেই। দে-ছুটের দলকে নিয়ে ছয়টি ডিঙ্গি নৌকা লতা-গুল্ম ভেদ করে সাপ, বিচ্ছুকে ভেংচি দিয়ে বনের গভীরে যাচ্ছে। নৌকাগুলো যতই এগিয়ে যায়, ততই মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকি। বনের ভেতর গাছের মগডালে তাকালে এক অদ্ভুত আনন্দ মনে দোলা দেয়। সাপ-বিচ্ছুর বন রাতারগুল, তবে ভয় পাওয়ার আদৌ কোনো সুযোগ নেই। কারণ বৈজ্ঞানিক মতে অধিকাংশ সাপই বিষহীন। রাতারগুলের মায়াময় নিসর্গের প্রেমে পড়ে সবাই যেন সেলফি তুলতে ভুলে যায়। আজ শুধু ক্যামেরায় প্রকৃতির হরেক রূপ ধারণ করতেই সবাই ব্যস্ত। গাছের ডালপালা দেখে এমন মনে হবে যেন পর্যটকদের আগমনে তারা আনন্দে নৃত্যরত। বড় বড় বিচ্ছু, সাপ যেন আপন মনে বিশ্রাম নেয়। খুব কাছ থেকে ফটো তুলতেও তাদের কোনো খেদ নেই। বরং মনে হয় তারা ফটোসেশনের জন্য প্রস্তুত। ৫০৪ একর আয়তনের এই বনে হিজল, করচ, তমাল, অর্জুন, কদম, বনজাম, মুর্তা আর জারুল বৃক্ষের সমারোহ। বনের পানি প্রবাহিত হয় পার্শ্ববর্তী গোয়াইন নদী থেকে। গভীর বনে আছে বানর, নানা প্রজাতির সাপ, মেছো বাঘ, ভোদরসহ বিভিন্ন প্রাণী। নীলাভ স্বচ্ছ জলের উপর ভাসমান বন রাতারগুল। বর্ষা মৌসুমে এই বনের গাছপালা গড়পরতা ৮-১০ ফুট পর্যন্ত ডুবে থাকে। অবশিষ্ট অংশ পানির উপর। পুরো বিকেলটা জলার বনে ঘুরে যখন সন্ধ্যায় ডাঙায় ফিরছি তখন ঘটল এক ভয়ানক কাণ্ড। বিরল প্রজাতির ভাইপার গ্রিন পিটার সাপের ছবি খুব কাছ থেকে তুলতে গিয়ে ডিঙ্গি ডুবল। সেই নৌকায় আমি আর আরেক বন্ধু ছিলাম। ভাগ্য ভালো যে, যত সামান্য সাঁতার জানা ছিল। পায়ের তালুতে যখন ডুবন্ত গাছের লতাপাতা জড়িয়ে যাচ্ছিল তখন বেশ ভয় পেয়েছিলাম। বন্ধু চিত্কার করে অভয় দিল—জাভেদ তুমি ভয় পেয়ো না। ভয় পেয়ো না বললেই কি আর হয়! জীবনে এই প্রথম নৌকা ডুবির অভিজ্ঞতা, তাও আবার সাপ-বিচ্ছুর বনে। মোস্তাক ও জসিম তাদের নৌকায় টেনে উঠানোর আগ পর্যন্ত ভেবেছিলাম এই বুঝি দে-ছুটের ইতি। নিজেকে স্বাভাবিক করতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছিল। এই ফাঁকে পিন্টু আমার বিধ্যস্ত হওয়ার করুণ অবস্থা ক্যামেরায় ধারণ করতে ভুল করেনি। সত্যিই এমন বৈরী পরিস্থিতি রাতারগুল বন ভ্রমণের স্মৃতি জীবনের পাতায় গেঁথে রবে চির দিন। সব ভয়কে জয় করে ভ্রমণ পিপাসু বন্ধুদের নিয়ে আগামীতে দে-ছুট ঘুরে বেড়াবে দেশের রোমাঞ্চকর সব প্রান্তে।

বর্ষা মৌসুমেই রাতারগুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার মোক্ষম সময়। শুষ্ক মৌসুমে ধারণ করে আরেক রূপ। এবারের রাতারগুল ভ্রমণের প্রতিপাদ্য স্লোগান ছিল ‘সুযোগ করে ভ্রমণ করুন, নিজেকে সুস্থ রাখুন’। সিলেটের সুন্দরবন বলে খ্যাত রাতারগুল ভ্রমণে, পর্যটকরা পাবেন এক অন্য রকম অনুভূতি, মনে জাগবে ভিন্ন রকম শিহরণ, যা শুধু সচক্ষে দেখাতেই সম্ভব। সারা পৃথিবীতে বাইশটি সোয়াম্প ফরেস্ট (জলার বন) আছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে একটি। সত্যিই জাতি হিসেবে আমরা প্রকৃতির কৃপাকে পুঁজি করে বিশ্বের পর্যটন দরবারে গর্ব করতে পারি। রাতারগুল বন সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। বনের ভেতর যেকোনো স্থাপনা তৈরির নামে রাতারগুলকে ধ্বংস করার হীন কৌশল বন্ধ করতে হবে। পরিশেষে লিখতে হয় পর্যটকদের প্রতি সিলেটের হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পরিবহন ব্যবসায় জড়িতদের আরও বেশি আন্তরিক হতে হবে। যথার্থ মানসম্পন্ন সেবাই উন্নত পর্যটনশিল্প বিকাশে সহায়ক।

যাতায়াত
সিলেট শহর থেকে গোয়াইন ঘাট উপজেলার মটরঘাট, সেখান থেকে নৌকায় বন ভ্রমণ। একদিনের ভ্রমণে জনপ্রতি ১,৭০০ টাকা হলেই হবে। সূত্র : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *