রফিকুল আমীন খান
ভয়, উৎকণ্ঠা, সাহস আর রোমাঞ্চে ভরা বাংলার দার্জিলিং বান্দরবান। ভয় আর উৎকণ্ঠা হয় ভ্রমণে সঙ্গী। অক্টোবরে মোটামুটিভাবে পর্যটনের মওসুম শুরু হলেও নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই চার মাস পর্যটন ব্যবসা চলে রমরমা। অনুকূল আবহাওয়া, ছেলেমেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হওয়ায় স্কুল বন্ধ থাকায় বেড়ানোর একটু ফুরসত মেলে এ সময়। তাই অনেকেরই পছন্দ এ সময়ে বেড়ানো।
এখানে এলে প্রথমেই যেতে পারেন নীলগিরি। পথে শৈলপ্রপাত ও চিম্বুক দেখা হবে। বাহন হিসেবে উত্তম চান্দের গাড়ি।
আঁকাবাঁকা সর্পিল পাহাড়ি পথ। দক্ষ চালক না হলে এ পথে গাড়ি চালানো কঠিন। শহর থেকে নীলগিরির দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। পাহাড়ের পাশ কেটে অত্যন্ত কঠিন পরিশ্রমে এ পথ তৈরি করেছেন আমাদের সেনাবাহিনী। পথের একপাশে খাড়া পাহাড়, আরেক পাশে গভীর খাদ। চালকের একটু ভুল ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। গাড়ির চাকা পিছলে গেলে সোজা কয়েক শ’ ফুট নিচে… ভাবতে মেরুদণ্ডের মাঝখান দিয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে যায়।
পথের দুই পাশে জানা-অজানা গুল্ম, লতাগুল্ম আর গাছের সারি। মাথার ওপর নীল আকাশ। দূরে পাহাড়চূড়ায় সাদা মেঘ খেলা করছে। মেঘেরা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আস্তে আস্তে মেঘের রাজ্যে প্রবেশ।
বান্দরবান শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাথুরে ঝরনা শৈলপ্রপাত। মূল সড়ক থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয় এ ঝরনায়। প্রচুর পানি, খুবই ঠাণ্ডা। পাহাড়ি শিশুরা ঝরনার পানিতে খেলা করে। উপজাতি নারীরা গোসল শেষে কলসি ভরে পানি নিয়ে যায়। ঝরনার পানিতেই পাহাড়িরা সারেন প্রয়োজনীয় রান্নাবান্না।
বান্দরবান শহর থেকে বাংলার দার্জিলিং চিম্বুকের দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। ভূমি থেকে ২৫০০ ফুট উচ্চতার এ পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছলে মেঘ ছুঁয়ে দেখা যায় এখানে। তাই প্রকৃতিপ্রেমীদের অনেকেই বাংলার দার্জিলিং বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন চিম্বুককে। পর্যাপ্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে চিম্বুকের সৌন্দর্য ভারতের দার্জিলিংয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম হতো না।
গাড়িতে চড়েই চিম্বুকচূড়ায় ওঠা যায়। তবে বর্ষার এ সময় খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
বান্দরবান শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে নীলগিরি। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। এখানে দু’পাশে গভীর খাদে মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। এ দৃশ্য দেখতে খোলা ছাদের চান্দের গাড়িতে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন। তবে নীলগিরির চার দিকে সুনসান নীরবতা। শুধু চূড়ায় সেনাক্যাম্পে কর্মরত সেনাসদস্যরা। নীলগিরিতে এ রকম জনহীন পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে।
নীলগিরির রূপমাধুর্য লিখে শেষ করার নয়। ভূমি থেকে এর উচ্চতা ৩ হাজার ফুট। উচ্চতার কারণে শীত-বর্ষায় বান্দরবান বেড়ানোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা এটি। তবে বর্ষায় তা আরো আকর্ষণীয়। এর চার পাশে মেঘেরা খেলা করে। এখানে দাঁড়িয়ে নিচে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখা যায়।
যারা প্রকৃতির এই খেলা খুব কাছে থেকে দেখতে চান, তারা একটা রাত থেকে যান সেনাবাহিনী পরিচালিত কটেজে। খাবারের জন্য রয়েছে ভালোমানের রেস্টুরেন্ট। এখানে বসে পেটপুরে খেতে খেতে ডানে-বাঁয়ে চোখ বুলালে দূর-বহুদূরে দেখা যায় দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডং, পাহাড়চূড়ার বগা লেক, কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর।
বান্দরবানে আরো একটি ঝরনা খুব সহজেই দেখে নিতে পারেন। এলাকার নাম অনুসারে একে বলে রেইচা ঝরনা।
ঝরনার পানি খুব ঠাণ্ডা। এ পানিতে পা ভিজাতেই শরীরজুড়ে শীতল পরশ বয়ে যায়। বান্দরবানের এত কাছে এ রকম একটা ঝরনা রয়েছে তা ভাবাই যায় না। এছাড়াও রয়েছে মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স, যা সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনায় মুখরিত থাকে। এর আসল সৌন্দর্য পাহাড়ঘেরা সর্পিলাকার স্বচ্ছ পানির লেক ও দু’টি ঝুলন্ত ব্রিজ। ঝুলন্ত ব্রিজ দু’টি লেকের এপার থেকে ওপারে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ওপর দিয়ে যাওয়া দারুণ আনন্দের। সন্ধ্যেটা উপভোগ করতে পারেন বান্দরবানের স্বর্গভূমি খ্যাত নীলাচলে। অন্যরকম এক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হবে অবশ্যই। সৌজন্যে : নয়া দিগন্ত