Skip to content

ঘুরে দেখি দিল্লি

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা স্থাপনায় সমৃদ্ধ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। সেখানকার কিছু ঐতিহ্যবাহী স্থান ঘুরে এসে লিখেছেন গাজী মুনছুর আজিজ

দুপুরে দিল্লি পৌঁছে উঠি পাহাড়গঞ্জের এক হোটেলে। পাহাড়গঞ্জ দিল্লির পুরনো শহর। বেশ জমজমাট এলাকা। বিকেলের দিকে বের হই দিল্লি দর্শনে। পথপ্রদর্শক সাইক্লিস্ট আবুল হোসেন আসাদ। প্রথমে যাই পাহাড়গঞ্জের কাছে ঈদগাহ রোডের খাজা বাকি বিল্লাহর মাজারে। মাজার প্রাঙ্গণে তেমন দর্শনার্থী নেই। দুই-তিনজন পুণ্যার্থী বাকি বিল্লাহর কবরের পাশে বসে প্রার্থনা করছেন। মাজারের পাশেই মসজিদ। মসজিদটির ভেতরের পুরো দেয়ালে নানা রঙের নকশা আঁকা। মাজার প্রাঙ্গণে অসংখ্য কবর রয়েছে। দেখি মাঝবয়সী এক নারী তবারক হিসেবে চকোলেট বিতরণ করছেন মাজার প্রাঙ্গণের কয়েকজন শিশুর মাঝে। আমাদেরও দিয়েছেন।

ভারত উপমহাদেশে নকশবন্দি তরিকার পথিকৃৎ হিসেবে খাজা বাকি বিল্লাহ পরিচিত। তার পুরো নাম রাযি-উদ-দিন মুহাম্মদ বাকি। তবে খাজা বাকি বিল্লাহ নামেই তিনি পরিচিত। ইতিহাস ঘেঁটে জানি, আফগানিস্তানের কাবুলে তার জন্ম ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই। মৃত্যু ২৯ নভেম্বর, ১৬০৩। তার বাবা কাজী আব্দ আস-সালাম সমরকান্দি ছিলেন কাবুলের বিশিষ্ট সুফি সাধক ও ইসলামী পণ্ডিত। মা-বাবা তার নাম রাখেন মুহাম্মদ আল-বাকি। বেরাং তার ছদ্মনাম। এর অর্থ বর্ণহীন বা স্বচ্ছ।

বাকি বিল্লাহর মাজার থেকে অটোরিকশায় আসি মথুরা রোডের পশ্চিম নিজামুদ্দিন এলাকার নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে। ভারত উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার প্রখ্যাত সুফি সাধক তিনি। ইতিহাসের পাতায় তার জন্ম ১২৩৮ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদায়ুনে। মৃত্যু ৩ এপ্রিল, ১৩২৫। প্রেম বা ইশকের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রাপ্তি পাওয়া যায় বলে তিনি মানতেন। তার মতে, স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসাই মানবতার প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়।

মূল সড়ক থেকে মাজার পর্যন্ত পুণ্যার্থীর ভিড়। পথের দু’পাশে অস্থায়ী-স্থায়ী ছোট অনেক দোকান রয়েছে। সেসব দোকানে ফুল, মিষ্টি জাতীয় খাবার, গিলাফ, গোলাপজল, আগরবাতি ও আতর নিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। গিলাফগুলো নানা রঙের এবং তাতে প্রিন্ট বা এমব্রয়ডারির মাধ্যমে কোরআনের আয়াত লেখা। সব দোকানেই লাল গোলাপের পাপড়ি ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের প্লেটে সাজানো। পুণ্যার্থীরা গিলাফ, আগর, আতর ও তবারক হিসেবে মিষ্টি জাতীয় খাবারের সঙ্গে এক প্লেট গোলাপের পাপড়িও কিনে নেন নিজামুদ্দিনের (রহ.) মাজারে দেওয়ার জন্য। তারা লাইন ধরে সমাধির এক পাশ দিয়ে প্রবেশ করে মানতের এসব উপকরণ দান করে আরেক পাশ দিয়ে বের হন।

মাজার প্রাঙ্গণে মসজিদ রয়েছে। ১৩১৫ থেকে ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত জামাতখানা নামের এ মসজিদের ভেতরের দেয়াল, গম্বুজ ও বাইরের দেয়াল ও গেটে আরবি ক্যালিগ্রাফি রয়েছে। মসজিদটির সংস্করণ চলছে। আগা খান ট্রাস্ট ফর কালচার এ সংস্করণের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। নিজামুদ্দিনের মাজার ভবনটিও নানা কারুকাজে নির্মিত।

মাজার প্রাঙ্গণজুড়ে নানা বয়সী পুণ্যার্থী নারী-পুরুষের ভিড়। বাংলাদেশি অনেক পুণ্যার্থীও আছেন। নিজামুদ্দিনের মাজারের বাঁ পাশে মোগল রাজকুমারী জাহানারা বেগমের সমাধি রয়েছে। মাজার প্রাঙ্গণে কাওয়ালির আসর বসেছে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে কাওয়ালি হচ্ছে। কিছুক্ষণ কাওয়ালি শুনে বের হই আমরা। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে।

সফরের এক দুপুরে আসাদ ভাই নিয়ে আসেন লোটাস টেম্পল বা পদ্ম মন্দিরে। মন্দিরের আকৃতি পদ্ম ফুলের মতো বলেই এর নাম পদ্ম মন্দির। মূলত এটি বাহাই ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়। মন্দিরের প্রসপেক্টাস থেকে জানি, বাহাই বিশ্বাস হচ্ছে বাহাউল্লাহ (নভেম্বর ১২, ১৮১৭-মে ২৯, ১৮৯২) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একেশ্বরবাদী বিশ্বাস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বর্তমান ইরানে এ ধর্মের উৎপত্তি। এখন সারা পৃথিবীতে ৬০ লাখ অনুসারী আছে এ ধর্মের। বাহাউল্লাহর জন্ম ইরানে হলেও তার সমাধি ইসরায়েলে। ১৯৮৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর মন্দিরটি খোলা হয়। এর উচ্চতা ১১২.৪ ফুট। ব্যাসার্ধ ২৩০ ফুট। স্থপতি ফারিবোর্জ সাহবা। এর ভেতর একসঙ্গে এক হাজার ৩০০ লোক বসে প্রার্থনা করতে পারেন। প্রতি বছর ৪০ লাখ লোক এটি পরিদর্শনে আসে।

মন্দিরে ঢোকার আগে জুতা খুলি। জুতা রাখার জন্য মন্দিরের পক্ষ থেকে ব্যাগ দেওয়া হয়েছে। সেই ব্যাগে ভরে জুতা রাখি নির্দিষ্ট স্থানে। মন্দিরে ঢোকার আগে এখানকার সেবক জানিয়ে দেন মন্দিরের আদব-কায়দা, সেই সঙ্গে জানান বাহাই ধর্মের বিশ্বাসের কথা। গোলাকার মন্দিরের ভেতরে চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। সবাই চেয়ারে কিছুক্ষণ বসে ধ্যান করে বের হন।
লোটাস টেম্পল থেকে আসি ইন্ডিয়া গেট। এটি ভারতের মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তৃতীয় ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধে নিহত ৯০ হাজার ভারতীয় সেনার স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত এ সৌধ। প্যারিসের আর্ক দে ত্রিম্ম্ফের আদলে ১৯৩১ সালে নির্মিত এ সৌধের নকশা করেন স্যার এডউইন লুটিয়েনস। লাল-সাদা বেলে ও গ্রানাইট পাথরে তৈরি এ গেটের আশপাশে অসংখ্য দর্শনার্থী। পেশাদার অনেক আলোকচিত্রী গেটের নানা অ্যাঙ্গেলের ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়ান আর দর্শনার্থীদের অফার করেন সে রকম ছবি তোলার জন্য। অনেক দর্শনার্থী তাদের দিয়ে ছবি তোলান। আবার অনেক আলোকচিত্রীর ক্যামেরা নেই, তিনি দর্শনার্থীর ক্যামেরা দিয়েই ছবি তুলে দেন টাকার বিনিময়ে। গেটের ছাউনির তলে ভারতের তিন সামরিক বাহিনীর পতাকা ওড়ে। আছে নিরন্তর প্রজ্বলিত শিখা।

বিকেলের দিকে আসি মসজিদ-ই জাহান-নুমা বা দিল্লি জামে মসজিদে। সমতল থেকে বেশ উঁচুতে মসজিদটি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠি। মূল মসজিদের সামনে পুরোটা খোলা প্রাঙ্গণ। এ প্রাঙ্গণ মসজিদেরই অংশ। মসজিদের তিন পাশেই দেয়াল দেওয়া। গেটও তিন পাশে এবং গেটগুলো বেশ উঁচু। খোলা প্রাঙ্গণের মাঝখানে আছে ফোয়ারা। খোলা প্রাঙ্গণ পুরোটাই নানা বয়সী নারী-পুরুষের পদচারণায় মুখর।

ইতিহাস থেকে জানি, মোগল সম্রাট শাহজাহান ১৬৪৪ থেকে ১৬৫৬ সালের মধ্যে এ মসজিদ তৈরি করেন। এটি ভারতের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ। মূলত শাহজাহানের উজির বা প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লাহ খানের তত্ত্বাবধানে মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। লাল বেলে পাথর ও সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে এটি তৈরিতে সে সময় প্রায় ১০ লাখ রুপি খরচ হয় এবং পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। উজবেকিস্তানের বুখারার একজন ইমাম মসজিদটি উদ্বোধন করেন। একসঙ্গে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ এখানে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১৩০ ফুট ও প্রস্থ ৮৯ ফুট। এর গম্বুজ তিনটি ও মিনার দুটি। মিনারগুলোর উচ্চতা ১৩৫ ফুট। মূল মসজিদে পাঁচ থেকে ছয়টি কাতারে নামাজ আদায় করা যায়। এ মসজিদের স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্মিত বাদশাহি মসজিদের বিশেষ মিল রয়েছে। সৌজন্যে: দৈনিক সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *