এমরান হাসান সোহেল
চরমোয়াজ্জিন। জোয়ারে ডোবে, ভাটায় জেগে ওঠে। এ কারণে ডুবোচর নামেও পরিচিতি তার। এর কিনার ঘেঁষে বয়ে চলেছে তেঁতুলিয়া নদী। পাল উড়িয়ে ছুটছে নৌকা। এই মোয়াজ্জিনের বুকে সাইবেরীয় অতিথিদের ছোটাছুটি। কেউ আহার খুঁজছে ভাটায় নেমে যাওয়া ডুবোচরের গর্তের পানিতে, আবার কেউ ঘাসের শিকড়-বাকড়ের ফাঁকে। শত্রুর আক্রমণ থেকে রেহাই পেতে মাথা উঁচিয়ে সজাগ দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ। শরীর খোঁটাখুঁটিতে ব্যস্ততা কারো। এভাবেই চরমোয়াজ্জিন জুড়ে এখন হাজারো অতিথি পাখির ব্যস্ততা। এলাকাবাসী জানিয়েছে, প্রতিবছর শীতের শুরুতে, বিশেষ করে নভেম্বরের শেষ অথবা ডিসেম্বরের শুরুর দিকে অতিথিরা আসে। ফেব্রুয়ারিতে দখিনা বাতাস বইতে শুরু করলে আবার চলে যায়। প্রায় ৮ থেকে ৯ বছর ধরে ওখানে আসা-যাওয়া ওদের।
পটুয়াখালী সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে বাউফল ও দশমিনার সীমানা নির্ধারণ করা বগি খাল। ওই খালের বগি ব্রিজ থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিট পূর্ব দিকে এগোলেই তেঁতুলিয়ার বুকে জেগে আছে তামাটে মাটির ডুবোচর। এখনো ধান চাষ কিংবা মানুষের বাস শুরু হয়নি। চরটির নাম মোয়াজ্জিন। ওখানেই সাইবেরীয় অতিথিদের ক্যাম্প। একটির পেছনে আরেকটি। কখনো আবার পাশাপাশি অবস্থান নিয়ে খাবার খোঁজে। দেশীয় গৃহপালিত রাজহাঁসের মতো কলতান চলছে নিরন্তর। ওদের সম্পর্কে কারো অভিজ্ঞতা না থাকলে আহার অবস্থায় যে কেউ দেখলে মন্তব্য করবে, কারো রাজহাঁসের খামার ওই চরে। পুরো চরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে ওরা। কেউ একা নয়। ৫০ থেকে ৭০টি সাইবেরীয় অতিথি একসঙ্গে থাকে। তবে ওই চরে কয়েক বছর ধরে শীতকালীন এ অতিথির সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। দলবদ্ধভাবে থাকা এসব অতিথির প্রিয় খাবার মাছ। তবে এ অতিথিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এড়িয়ে যেতে পারে না ছোট শামুক, কাঁকড়াও। ধানও এদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। জোয়ারের পানিতে যখন পুরো চর ডুবে যায় তখন উত্তর পাশের উঁচু চরে আশ্রয় নেয় ওরা। সেখানে গিয়ে ধান কুড়িয়ে খায়। কেউ ধানক্ষেতে উড়ে যায়, আবার কেউ ওই এলাকার আকাশে ঘুরে বেড়ায়। তবে ভাটায় পানি নেমে গেলে আবার ওই ডুবোচরে ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে আসে সবাই। কখনো আবার একদল থেকে পাশে অবস্থান করা অন্য দলে উড়ে গিয়ে যোগ দেয়।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের পর গত বুধবার সকাল ৮টার দিকে তেঁতুলিয়াপারের বগি ব্রিজ এলাকা থেকে ট্রলারযোগে পূর্ব দিকে প্রায় ১৫ মিনিট যাওয়ার পরও কোনো অতিথির দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। হতাশ হয়ে যখন ফিরে আসার চূড়ান্ত প্রস্তুতি তখন হঠাৎ ওদের কলরব কানে লাগে। তখন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হই। ওখান থেকে ট্রলারযোগে ৮ থেকে ১০ মিনিট উত্তর দিকে এগিয়ে যেতেই নজরে আসে বিশাল এক সাইবেরীয় অতিথির ঝাঁক। ভীত স্বভাবের এ সাইবেরীয় অতিথিরা মানুষের আনাগোনা অনুভব করলেই ডানা মেলে অন্যত্র উড়ে যায়। খোলা চর তাই গাছপালার কোনো আড়াল না পাওয়ায় দূরে দাঁড়িয়েই ওদের দেখতে হলো। ওদের অবস্থান থেকে প্রায় সাড়ে তিন শ গজ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখা আর ছবি তোলা ছাড়া কাছে যাওয়া হলো না। এই দূরত্ব ভেদ করতেই লম্বা ডানায় ঝাপটা মেরে চলে গেল ওই চরেরই পশ্চিম সীমানায়।
সাইবেরীয় এ পাখিটির আকৃতি আমাদের দেশের বড় সাইজের ধলাকপাল রাজহাঁসের মতো। ওজন চার থেকে পাঁচ কেজি। এই রাজহাঁসগুলো সাধারণত মিঠা পানিতে থাকতে পছন্দ করে। গ্রীষ্মকালে সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলে এদের প্রজনন হয়। নরম উদ্ভিদ ও পালক দিয়ে এরা বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো ফ্যাকাসে এবং সংখ্যায় তিন থেকে ছয়টি। মেয়ে রাজহাঁস একাই ডিমে তা দেয়। ২২ থেকে ২৮ দিনে ডিম ফোটে। এদের ঠোঁট, পা ও গলা লম্বা। পরিণত অবস্থায় দৈর্ঘ্য ৮২ সেন্টিমিটার। ডানা ৪৫ সেন্টিমিটার। শীত মৌসুমে এরা আমাদের দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে এসে ক্যাম্প তৈরি করে।
নিরাপদে নেই অতিথিরা : চরমোয়াজ্জিনে নিরাপদে নেই পাখিরা। প্রতিবছরই ওদের ওপর শিকারিরা হামলা চালায়। নানা কৌশলে ওদের জীবন কেড়ে নেয় শিকারির দল। শিকারিদের তত্পরতার কারণেই সংখ্যা অনেক কমে গেছে বলে জানান এলাকাবাসী। বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রলার নিয়ে এসে বন্দুক দিয়ে শিকারিরা ওদের হত্যা করে। তৌফিক সরদার নামের বগি খালে অবস্থান করা মান্ত্রা সম্প্রদায়ের এক জেলে জানান, ট্রলার নিয়ে এক শ্রেণির প্রভাবশালী লোক বন্দুক দিয়ে শিকার করে আবার ট্রলারেই চলে যায়। এ বছরও কয়েক দফা হামলা চালিয়ে গেছে বরিশাল ও ভোলা এলাকার শিকারিরা। এ ছাড়া স্থানীয় কিছু অসাধু লোক ধানে বিষ প্রয়োগ করে ফাঁদ পেতে শিকার করে। বিষ প্রয়োগের ধান খেয়ে আর উড়তে পারে না ওরা, তখন মাটিতে অবস্থান করে। তখন শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া পাখিগুলো শিকারিরা ধরে নিয়ে যায়। বগি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা হেদায়েত আলী মুন্সি বলেন, ‘বিষটোপ দিয়ে ওই পাখি শিকার করে এক থেকে দেড় হাজার টাকা দামে বিক্রি করে একটি পাখি।’ আবার যেগুলো শিকারিরা ধরতে পারে না সেগুলো বিষাক্ত ধান খেয়ে নদীর জলে ভেসে যায়। একপর্যায়ে মারা যায়। কুয়াশার সকালে কেউ বা আবার ডুবোচরে কারেন্ট জালের ফাঁদ তৈরি করে ওদের শিকার করে। এসব কারণে প্রতিবছরই কমছে অতিথিদের সংখ্যা।
অতিথি পাখিদের আগমন নিয়ে পাখি বিশেষজ্ঞ ও পটুয়াখালী সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক পীযূষ কান্তি হরি বলেন, ‘ওরা সাইবেরীয় অতিথি। ওরা বেশ বড় সাইজের বুনো রাজহাঁস। বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস শীত মৌসুমে বাংলাদেশে আসে, কিন্তু এই বড় রাজহাঁসগুলো সাধারণত বিদেশ ভ্রমণে তেমন আসে না। খুব কমসংখ্যক সাইবেরীয় এই বুনো রাজহাঁস বাংলাদেশে আসে। ডুবোচরের পরিবেশ মনঃপূত হওয়ায় কয়েক বছর ধরে ওখানে আসে। এলাকাটি সংরক্ষিত করে ওই চর অতিথিদের জন্য অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হলে অনেক পর্যটক ওই চরে বেড়াতে যাবে।’ সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ