রেজাউল করিম রেজা
একসময় চলনবিলে ১২ মাসই নৌকা চলত। চৈত্র-বৈশাখ মাসেও থাকত প্রচুর পানি। এখন পলি পড়ে বিল ভরাট হয়ে গেছে। বিলের বুক চিরে গেছে সড়ক এমনকি মহাসড়ক। তবুও বিলের এপাড়া-ওপাড়া এখন নৌকাই সম্বল। বড় বড় নৌকা চলতে না পারলেও ছোট নৌকা কম চলে না।
চলনবিলের সড়াবাড়ী গ্রামের বৃদ্ধ মজিবর রহমান জানালেন, হরেক রকম নৌকা চলত বিলে-যেমন বজরা, গয়না, পানশি, ডিঙি, বোর্ড বা বাড্ডি প্রভৃতি। তখন বড় বড় সওদাগর চলনবিল এলাকা থেকে ধান ও পাট নিত বজরা দিয়ে। একটি বজরা নৌকায় কয়েক হাজার মণ ধান আঁটে। সেগুলো চলত দাঁড় টেনে অথবা পাল খাটিয়ে। বাতাসের গতিপ্রকৃতি বুঝে পাল তুলে নৌকা চালাতে মাঝিরা ছিল ওস্তাদ। বজরা নৌকাগুলোর ওপর ছই-ছাউনির ঘর থাকত। বজরা লম্বায় বেশি বড় না হলেও প্রশস্ত হতো অনেক। ফলে এগুলোর গতি ছিল তুলনামূলক কম।
আরেক ধরনের নৌকা ছিল-পানসি। সেগুলো দীর্ঘ হতো। এই নৌকার ওপর বাঁশ বা কাঠে ঘর থাকত। ঘরে আবার জানালাও থাকত। সম্ভ্রান্ত লোকজন চলাচল করত এগুলোয়। তাদের বউ-ঝিরাও নাইওর যেত পানসি দিয়ে।
আরো এক ধরনের নৌকা ছিল, নাম ভেদী। গৃহস্থরা পণ্য পরিবহনে এটি ব্যবহার করত। তবে হাটবাজারে বা দূরপথে লোক চলাচলের জন্য গয়না নৌকা। এই নৌকার ওপর ঝড়-জল-বৃষ্টি প্রতিরোধের জন্য ছই বা আচ্ছাদন থাকত। তবে কাছাকাছি কোথাও চলাচলের জন্য বেশি ব্যবহার হয় ডিঙি। এগুলো হয় ছোট সাইজের ও সরু। ফলে সহজেই চালানো যায়। পথ উজানে হলে মাঝি-মাল্লারা মাস্তুলের সঙ্গে দড়ি বেঁধে নৌকা টানত। একে বলে গুন টানা। ভাটির পথে বৈঠা, দাঁড় বড়জোর পাল লাগে।
ডিঙি নৌকা বাদে সব ধরনের নৌকা চালানোর জন্য একজন মাঝি থাকেন, যিনি শক্ত হাতে হাল ধরেন এবং নৌকার গতি ঠিক রাখেন। তবে আশির দশকে নতুন এক ধরনের ছোট ছোট নৌকার ব্যবহার দেখা যায়, যেগুলোকে বলে বোর্ড বা বাড্ডি নৌকা। এই নৌকাগুলো বৈঠা বা লগি দিয়ে একজনই সহজে চালাতে পারে। শিমুল কাঠ দিয়ে তৈরি হয় এসব নৌকা।
মূলত আশির দশক থেকে বিল ভরাট হয়ে গভীরতা কমে গেলে এ ধরনের নৌকার প্রচলন হয়। অন্যান্য নৌকা তৈরিতে সাধারণত শাল, গজারি, সেগুন বা কাঁঠাল কাঠ ব্যবহৃত হয়। এখন বিলে চলছে ইঞ্জিন নৌকা। কাঠ ও স্টিল প্লেটের তৈরি ছোট-বড় হরেক রকমের নৌকা বিলে চলাচল করতে দেখা যায়। এগুলোর গতি বেশি। ফলে অল্প সময়েই মানুষ গন্তব্যে পৌঁছতে পারে।
এখন সড়ক হয়ে গেলেও হাটবাজার করা বা আত্মীয় বাড়ি যাওয়া বা এবাড়ি-ওবাড়ি যেতে লোকজন নৌকাই ব্যবহার করে। আর মৎস্যজীবীদের তো ডিঙি ছাড়া চলেই না। তাই বিলপারের জনপদগুলোতে নৌকা তৈরি ও বেচাকেনা চলছে এখন পুরোদমে।
যাঁরা নৌকা তৈরি করেন, তাঁদের বলা হয় সূত্রধর বা কাঠমিস্ত্রি। চলনবিলের অনেক স্থানেই রয়েছে নৌকা তৈরির কারখানা। যেখানে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের নৌকা তৈরি ও বিক্রি হয়। নাটোরের সিংড়া উপজেলা সদর, বিলদহর, গুরুদাসপুরের চাচকৈড়, নাটোর সদরের নলডাঙ্গা, শেরকোল, নাজিরপুর প্রভৃতি স্থানে নৌকা তৈরি হয়। এ ছাড়া নৌকার হাট বসেছে তাড়াশের নওগাঁ ও চাটমোহরের মির্জাপুরে।
বিলদহরের শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বর্ষা এলেই নৈকেয় (নৌকায়) লোহা মারার ধামধুম শব্দ আর আলকাতরা মজার গন্ধ মিস্ত্রিদের পাড়ায় পাড়ায়।’
আয়েশ গ্রামের আবদুর রশিদ বলেন, ‘বর্ষাকালে নৌকা ছাড়া চলে না আমাদের। শ্যালো নৈকেয় উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন স্থানে যাই, হাটে যাই।’
মির্জাপুর মিস্ত্রিপাড়ার সুবল ও তারাপদ সূত্রধর বলেন, ‘প্রেত্যেক সপ্তায় ১২-১৩ডা নৈকে বিক্রি করি। ১০-১২ হাত একটা নৈকে বানাতি খরচ হয় ১০-১৫ হাজার টাকা।’
তাঁরা আরো জানান, মালামাল পরিবহনের বড় নৌকা বানাতে খরচ পড়ে লাখ টাকা।
তবে মিস্ত্রিরা জানান, লোহার (তারকাঁটা) দাম বেড়ে গেছে বলে নৌকা তৈরির খরচ আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। তাই লাভ গেছে আগের থেকে কমে। সপ্তাহের রবি ও বৃহস্পতিবার মির্জাপুর হাটে বিক্রি হয় শতাধিক নৌকা।
উল্লেখ্য, ৯টি উপজেলা নিয়ে গঠিত চলনবিল। রাজশাহী বিভাগের চার জেলার আট উপজেলার ৬০ ইউনিয়নের ১৬০০ গ্রাম বিলটি ভাগাভাগি করে। বিলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ১৪টি নদী। আছে হাজারটি জলাশয়। সূত্র : কালের কণ্ঠ