Skip to content

চাঁদপুরের সৌন্দর্য

মো. আবদুল বাতেন
‘সৌন্দর্য আবিষ্কারের অর্থই হলো ভালোবাসাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নেয়া’—কবিতার এই পঙক্তির ওপর সৌন্দর্যের আর কোনো রূপ থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না। যাকে ভালোবাসা যায় তাকে যতই দেখবেন ততই তার সৌন্দর্য আবিষ্কার হতে থাকবে। ভালোবাসা শব্দটি আপেক্ষিক, যেখানেই ব্যবহৃত হয় সেখানেই নান্দনিকতা জন্ম হয়। সেখানেই বেঁচে থাকার অবলম্বন তৈরি হয়। ইট-কাঠের চৌকোনায় বন্দি হয়ে যান্ত্রিক যন্ত্র হয়ে উঠেছি অনবরত। তবুও মানুষের ভালোবাসার মানুষ থাকে, ভালোবাসার স্থান, জিনিস থাকে, ভালোবাসায় ভালোবাসা থাকে। আমারও ভালোবাসার কিছু স্থান আছে, সেখানে গেলেই বার বার নতুন সৌন্দর্য তৈরি হয়। যা আগের কোনো উপমার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। চাঁদপুর সেরকমই একটি জেলা।

Mohona-Dwip

আমার ফুফাতো ভাই নূরউদ্দিন চাঁদপুর সরকারি কলেজে যখন পড়ত, আমি কুমিল্লা থেকে সকালে চলে আসতাম, সারাদিন নদীর কূল ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে রাতে আবার কুমিল্লা চলে আসতাম। কেন জানি একটা ভালোবাসা তৈরি হলো চাঁদপুরের নদীর সঙ্গে। এই ভালোবাসার উৎস খুঁজে পেয়েছিলাম কলেজ জীবনে পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস পড়ে। এখনও খুঁজে পাবেন কোনো কোনো চরে কুবেরের বালিশ, মালার সরলতা, কপিলার চঞ্চলতা আর ময়না দ্বীপের মতো অনেক ছোট-বড় চর।

নদীর প্রতি প্রেমের আরও একটি কারণ আছে। নদীর পাড়ের মানুষ নাকি কবি হয়। এর সত্যতাও মেলে বাংলাদেশের অধিকাংশ কবির বেড়ে ওঠা দেখলে। যেমন তিতাস পাড়ের আল মাহমুদ, কপোতাক্ষের মাইকেল মধুসূধন দত্ত, পদ্মা পাড়ের জসীমউদ্দীন, জানা-অজানা অনেক কবি।

শিক্ষা জীবন ঢাকায় পরিবর্তন হওয়ার ফলে কুমিল্লা থেকে গিয়ে ঘুরে ঘুরে চাঁদপুর দেখা আমার আর হয়ে ওঠেনি। লঞ্চে বাড়ি যেতে রাতের আঁধারে নদীর ছলাত ছলাত শব্দ আমাকে ডেকেছে বহুবার। সময় আর বাস্তবতা মেলেনি, তাই অনেক দিন যাওয়া হয়নি চাঁদপুর। শীতের আগমন তখনও শুরু হয়নি। কাজের তালিকায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু না থাকায় স্মৃতির আলমারির দরজা খুলে দিলাম ঢাকায় বৃষ্টিমুখর এক সন্ধ্যায়। বিদ্যুৎহীন জানালার পাশে উঁচু উঁচু দালানের ফাঁকে একখণ্ড মেঘ ভেসে যাচ্ছে বিজলীর আচমকা আলোতে। মনের ভেতর নীরব প্রার্থনায় বলতে লাগলাম—আত্মা প্রশান্তিকারী হে আমার বৃষ্টির মালিক, আবার একটি আকাশে আলোর ঝিলিক দাও আমি মেঘের ওড়াউড়ি দেখব।

Mohona-Dwip2

আমার মস্তিষ্কে ধরা পড়ল একদিন চাঁদপুরে লগ্গীমারা চরে ঘুরতে এসে বৃষ্টিমুখর এক সন্ধ্যায় কাদাপানি গায়ে মেখে ৪ বন্ধু নৌকায় উঠতে গিয়ে অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে আকাশের মালিকের কাছে বিজলীর প্রার্থনা করেছিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম কালই চাঁদপুর যাব। রাতের সব প্রস্তুতি শেষ করে সদরঘাট থেকে সকাল ৮টায় লঞ্চে চাঁদপুরে রওনা হলাম। (ভাড়া নরমাল ৮০ টাকা, ১ম শ্রেণী ১৫০ টাকা, সেমি সিঙ্গেল কেবিন ৫০০ টাকা)। বুড়িগঙ্গার পানির দুর্গন্ধে কেবিন থেকে বের হলাম না। মুন্সীগঞ্জের পর নদীর স্রোতের সঙ্গে কথার মিতালী তুলেছি ঠিকই, আল মাহমুদের মতো নারীর সঙ্গে নদীর গভীর সম্পর্ক অর্থ বের করতে পারিনি, ট্রলারের নৌকা দিয়ে চর থেকে নিয়ে আসা পাকা কলা, শসা, গাজর, বুট ইত্যাদি খাবার না খেলে যে কোনো যাত্রীর দারুণ কিছুর তাজা স্বাদ আহরণ থেকে বাদ পড়বেন। লঞ্চের ভিসিডিতে বিরক্তিকর বাংলা ছবি সাধারণ মানুষ হা করে দেখছে। ছবির রি-অ্যাকশন মানুষের চোখে-মুখে। দেখছি আর নতুন কিছু উপলব্ধি করছি। আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি, বাতাস এলোমেলো করে দিচ্ছে মাথার চুল। সূর্যের আলো আর নদীর ঢেউয়ে পাল ঝিলিক ঝিলিক চোখ ধরে আসে। ছোট ছোট দু’একটি নৌকা মাছ ধরছে।

লঞ্চ থেকে চাঁদপুর বড় স্টেশন মোড় দেখা যায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় শহর থেকে লম্বা একটি রাস্তা মোহনায় এসে শেষ হয়েছে। কথিত আছে এই মোহনায় আল্লাহর কোনো বড় পীর, অলি এখানে থাকত, তাই এই মোহনা ভেঙে যায় না। মোহনার কাছে লঞ্চ এলে সবাই একটু সতর্ক হয়ে যায়। পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থল এটি। স্রোতের ঘূর্ণি দেখে ভয় আসাটা স্বাভাবিক। হৃদয়ে মহান আল্লাহকে স্মরণে রেখে দাঁড়িয়ে দেখছি নদীর প্রতিযোগিতা। বড় স্টেশনের কাছে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে মাঝিরা বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে।

মাথার ওপর সূর্য, সারাদিন বসে বসে মাছ ধরতে কষ্ট হয় কিনা জানতে চাইলে তারা জানায়। মাঝ নদীতে ইলিশ ধরে যা পাই তা ২-৩ ভাগ হয়। বড়শি দিয়ে ১-১.৫ কেজি রিডা মাছ পাইলে ১০০০-১২০০ টাকা বেচতে পারি। তাছাড়া কাটা, ছারা পাঙ্গাশ, বাইলা মাছ তো পাই। শামুক আর কাঁকড়ার মাংস দিয়ে এই মাছ ধরা হয়। বড় স্টেশন থেকে শুরু করে মাদরাসা ঘাট পর্যন্ত মাঝি পাড়া ধরা হয়। সিংহভাগ জায়গা রেলওয়ের। এখানে প্রায় ৮ হাজার লোকের বসবাস। যাদের আয়ের উৎস মাছ ধরা, নৌকা, রিকশা চালানো, জাহাজের কুলি ইত্যাদি। বড় স্টেশনের পূর্ব পাড়ে পুরান বাজার। এক সময় বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়ের দখলে ছিল এই এলাকা, তখন এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে ওঠে। চাঁদপুরের বর্তমান অবস্থান থেকে ৬-৭ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে, তা এখন নদীগর্ভে বিলীন। পুরান বাজার সেই সময় ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। আর চাঁদ রায়ের নামানুসারে চাঁদপুরের নামকরণ করা হয়।

Mohona-Dwip3

নদীপাড়ের মানুষের জীবন সাধারণ মানুষের জীবনের চেয়ে একটু আলাদা। ছোট বাজারে নারীদের বেচা বিক্রি। মাঝিদের জাল সেলাই, ছোট ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা, নদীতে ঝাঁপিয়ে গোসল করা ইত্যাদি দেখতে দেখতে পুরান বাজার নৌকা ঘাটে পৌঁছলাম। আমার লক্ষ্য সুখিপুর। বড় ট্রলারের নৌকায় পুরান বাজার থেকে মানুষ বিভিন্ন মালামাল নিয়ে যায়। প্রতি ২০-৩০ মিনিট পরপর ট্রলার ছাড়ে। ভাড়া ২৫-৩০ টাকা। মোহনা পার হতেই উদ্দাম নদী যেন মাতাল। আকাশে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। আচমকা ঢেউয়ের দোলায় ভিজে গেলাম।

আমার ভয় পাওয়া দেখে যাত্রীরা হেসে একাকার। সুখিপুর শরীয়তপুর জেলার অংশ। ইলিশ পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত। চাঁদপুর কিংবা চাঁদপুরের আশপাশে ইলিশ ধরার জন্য সুখিপুর সেরা। মাঝিরা জাল নিয়ে নদীতে যাচ্ছে, ইলিশ বোঝাই করে ফিরে আসছে পাড়ে। কেউ যদি তাজা ইলিশ কম টাকায় পেতে চায়, সুখিপুরে আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

বিশাল চরের পাশে কাশবন। বনের ভেতর এঁকেবেঁকে নদীর শাখা হারিয়ে গেছে আরেক নদীর বুকে।

চাঁদপুরের উত্তর, পশ্চিম, দক্ষিণে অনেকগুলো চর আছে। যে চরেই আপনি যান না কেন, মন ভরে তাজা শাক-সবজি, ঋতুর ফসল দেখে মন ভালো হতেই হবে। কোনো কোনো চরে আলুর চাষ, কোনো চরে সরিষা ফুলের হলুদের প্রান্তর, আবার কোনো চরে বালুময় সাহারা।

চরে মাঝিদের বাড়ি। যদি কোনো মাঝির সঙ্গে সম্পর্ক হয়ে যায়, খেয়ে আসতে পারবেন তাজা ইলিশের ভাজি। সুখীপুর, মোল্লাবাজার, মালের বাজার, তারা মানিয়া, লগ্গি মারা, কোদালপুর, আলুবাজার, নিশানবালা, রাজরার চর, জাহাজ মারা, শহর মালি, চেয়ারম্যান ঘাট, এরকম ছোট-বড় অসংখ্য চর চাঁদপুরের চারদিক ঘিরে আছে। মতলব, হাইমচর, চাঁদপুর সদরে এসব চরের জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের সংস্কৃতি আলাদা আলাদা। ঋতু পরিবর্তনের বাঁকে বাঁকে পরিবর্তন হয় চরের। কোনো কোনো চর ভেঙে যায় আবার নতুন চর জেগে ওঠে।

যারা ব্যস্ততায় ডুবে থাকেন, যান্ত্রিকতায় নিজেদের যন্ত্রের মতো করে চলে যাচ্ছে দিন। তারা হঠাৎ ঘুরে আসতে পারেন চাঁদপুরে। মননের আর প্রশান্তির জন্য হঠাৎ কোনো দৃশ্য হয়ে উঠতে পারে আপনার সুখের কারণ। আর যদি কোনো পূর্ণিমা রাতের আকাশ পেয়ে যান তাহলে লঞ্চের ছাদে বন্ধুদের আড্ডায় হারিয়ে যাওয়া যাবে শৈশবে কিংবা প্রেমের কোনো মধুর মুহূর্তে।

হয়তো কোনো চরে তাজা ১০০০-১৫০০ টাকার ইলিশে ভরে যেতে পারে আপনার ফ্রিজ। বড় স্টেশন গোধূলি আলোয় নরম নীরব শান্ত নদীতে একটানা বয়ে যাচ্ছে বিরতিহীন স্রোতের ধারা। লাল সূর্যের মাঝে একা হেলেদুলে দূরে আবছা আঁধারে হারিয়ে যাওয়া নৌকা খুঁজতে খুঁজতে অজান্তেই অন্যরকম কোনো মানুষ হয়ে গেছি। ‘মামা আপনার পুঁচকা’ শব্দ শুনে বাস্তবে ফিরে এলাম। রাত ১১টার লঞ্চে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। আকাশে তারাদের মিছিল, বাতাসে শীতল শান্ত অনুভূতিপ্রিয় মানুষের শূন্যতা আমাকে নিদারুণ এক কষ্টের চাদরে মোড়ে দিল। কী যেন নেই, কী যেন থাকার কথা ছিল…। সৌজন্যে : আমার দেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *