
ঝোপঝাড়ে নিশ্চিহ্নের পথে চাকমা রাজার রাজবাড়ি
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগরে চাকমা রাজত্বের রাজধানী ছিল। সতেরো শতকে তৈরি সেখানকার ঐতিহ্যবাহী চাকমা রাজার বাড়িটি এখন ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়ে আছে। দেখে এসে জানালেন জিগারুল ইসলাম জিগার।
চট্টগ্রাম শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয়, তারপরও এ জায়গাটা কেমন অজপাড়া গাঁ। শহর থেকে দুটি সড়কে রাজবাড়িতে আসা যায়। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কপথে ৩৫ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কপথে ৪৫ কিলোমিটার পেরোলেই রাজবাড়ি। রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের নাম—রাজানগর, রাজাভুবন, মোগলের হাট, রাজার হাট, রাণীর হাট, শুকবিলাস, কালিন্দিরাণী সড়ক ইত্যাদি থেকেই বোঝা যায় এখানে এককালে ছিল রাজ-রাজড়াদের বাস। আর রাঙ্গুনিয়ার উত্তরে রাজানগরে রয়েছে রাজবাড়ি। ১৭৩৭ সালে চাকমা রাজা সেরমুস্ত খাঁ এখানে রাজত্ব করেন। বান্দরবানের আলীকদমে ছিল তাঁর রাজধানী। তাঁর রাজ্যসীমা ছিল উত্তরে ফেনী, দক্ষিণে শঙ্খ নদী, পূর্বে লুসাই পাহাড় এবং পশ্চিমে নিজামপুর (বর্তমানে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড) রাস্তা। সেই সময় আরাকানিদের অত্যাচারে তিনি মোগল নবাবের সঙ্গে মিত্রতা করেন। তখন চট্টগ্রামের নবাব ছিলেন জুলকদর খাঁ। তিনি সেরমুস্ত খাঁকে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। ১৭৫৭ সালে সেরমুস্ত খাঁ মৃত্যুর পর রাজা হন শুকদেব রায়। তিনি ছিলেন সেরমুস্ত খাঁর পোষ্যপুত্র। রাজা শুকদেব রায় আলীকদম ছেড়ে চাকমা অধ্যুষিত রাঙ্গুনিয়ার পদুয়ায় শিলক নদীর তীরে প্রাসাদ তৈরি করেন। নাম দেন শুকবিলাস। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেন রাজধানী। তাঁর রানির নাম ছিল ছেলেমা। রানির নামানুসারে রাজপ্রাসাদের পশ্চিম দিকে একটি পুকুরের নামকরণ করা হয় ছেলেমা পুকুর। রাজা শুকদেব রায়ের সন্তান ছিল না। ১৭৭৬ সালে রাজার মৃত্যুর পর তাঁদের বংশধর শের দৌলত খাঁ রাজ্যভার নিয়ে রাঙামাটির রাজবাড়িতে রাজত্ব স্থানান্তর করেন। সেই থেকে দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের রাজাভুবন গ্রামের রাজপ্রাসাদ, সৈন্যশালা ও বন্দিশালা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। রাজবাড়িটি অযত্ন-অবহেলায় ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হতে থাকে।
বাড়িটি এখন লতাগুল্মে আচ্ছাদিত। ইট-সুরকি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই লোহাবিহীন অট্টালিকা। এটি বায়ান্ন একর জায়গাজুড়ে। দেয়ালগুলো প্রস্থে দুই হাতেরও বেশি। দেয়ালগুলোতে এখন নানা রকম আগাছা ও লতা জন্মেছে। খসে পড়ছে ছাদ। রোদ-বৃষ্টিতে প্রাসাদটির একেবারে নড়বড়ে অবস্থা। এরই মধ্যে প্রায় হারিয়ে গেছে প্রাসাদটির রাজদরবার, হাতিঘোড়ার পিলখানা, বিখ্যাত সাগরদিঘি, পুরাকীর্তি, বৌদ্ধ-বিহারসহ গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। এখন পর্যন্ত প্রাসাদটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চাকমা রাজার বংশধর হিসেবে প্রমতোষ দেওয়ান ২০ বছর ধরে রাজপ্রাসাদটি আঁকড়ে পড়ে ছিলেন। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন।
২০০৮ সালের মাঝামাঝিতে রাজা দেবাশীষ রায় সরকারিভাবে রাজবাড়ি এলাকা পরিদর্শনের সময় সংরক্ষণের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখনো কোনো সংস্কার করা হয়নি। চট্টগ্রাম থেকে খুব বেশি দূরে নয় বলে এটিকে সংস্কার করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়, এমনই বললেন এলাকার কয়েকজন। রাজবাড়িটি সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রতিবেদন পাঠাবেন বলে জানালেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল হোসেন। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ।