Skip to content

চার্লস রিভারের পাদদেশে ক্যামব্রিজ ও বোস্টন

ড. মো. রওশন আলম
চার্লস রিভার- একটি নদীর নাম। গ্রেটার বোস্টনের বুক চিড়ে প্রবাহিত হয়েছে এই নদীটি। ৮০ মাইল দীর্ঘ এই নদীটির শুরু হয়েছে গ্রেটার বোস্টনের ঠিক হপকিনটন শহর থেকে। আর শেষ হয়েছে বোস্টনের গাঁ ঘেঁষে লেগে থাকা আটলান্টিক মহাসাগরে। নদীটি এই অঞ্চলের ২৩টি ছোট ও মাঝারি আকারের শহরকে এঁকে-বেঁকে ছুঁয়ে গেছে। নদীটির এক পাশে যেমন গড়ে উঠেছে মূল বোস্টন শহর (ডাউনটাউন), অন্যপাশে তেমনি ক্যামব্রিজ। চার্লস রিভারের গাঁ ঘেঁষেই চলে গেছে মেমোরিয়াল ড্রাইভ রাস্তাটি (ক্যামব্রিজের দিকে)। রাতে চার্লস রিভারের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে এই মেমোরিয়াল ড্রাইভে গাড়ি না থামিয়ে কোনো গত্যন্তর নেই। মনে হবে, নদীর দু’পাশের দু’শহর থেকে অর্থাত্ “ক্যামব্রিজ ও মূল বোস্টন” ডাউনটাউনের দণ্ডায়মান বিল্ডিংগুলো যেন রাতের আলোতে নুয়ে পড়েছে রিভারের বক্ষের উপরে। পানির ঢেউয়ের তালে তালে এই বিল্ডিংগুলোও যেন দুলছে ও নাচছে নদীর পানিতে। এখানে রাতের শু শা শব্দও যেন অসাধারণ শোনা যায়। কেবল শত শত গাড়ি এই মেমোরিয়াল ড্রাইভ দিয়ে যেন ছুটে চলেছে গন্তব্যহীনভাবে। কোথায় যাচ্ছে এগুলো কে তা জানে। রাতে ছুটে চলা এসব গাড়ির হেডলাইটের সব আলো আপতিত হয় চার্লস রিভারের পানির উপরে। জ্যোত্স্না রাত হলে তো কোনো কথাই নেই। চাঁদ তার সব সৌন্দর্য যেন উজাড় করে বিকিয়ে দেয় এই নদীর বক্ষে। কি অপরূপ সে সৌন্দর্য!

Boston

চার্লস রিভারের সৌন্দর্য দেখার আরেকটি বিশেষ দিন হচ্ছে ৪ জুলাই। এই ৪ তারিখটি আমেরিকার ইতিহাসের একটি স্মরণীয় দিন। ১৭৭৬ সালের এই দিনেই আমেরিকা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শৃঙ্খলমুক্ত হয়। এই দিনটিকে বলা হয়, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস বা Declaration of Independence। এই দিন সরকারি ছুটির দিন। নানা উত্সব লেগে থাকে এই দিনটিকে ঘিরে। তন্মধ্যে ফায়ারওয়ার্কস, প্যারেড, বারবেকিউ, কারনিভালস, পিকনিক, পরিবারের সদস্যদের একত্রে পাওয়া, বেসবল গেমস, কনসার্টস, পলিটিক্যাল স্পিস অন্যতম। এই দিনে বোস্টনের চার্লস রিভারকে ঘিরে আনন্দের সাজসজ্জা একেবারে কম হয় না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে প্রায় হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে এই রিভারের দু’পাশে। মূল কারণ, এই বিশেষ দিনে ফায়ারওয়ার্কসের সৌন্দর্য উপভোগ করা। এর লাল নীল সবুজ ফ্লোরোসেনটস বাতির মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে রিভারের দু’পাশের বোস্টন ও ক্যামব্রিজ শহর মুহূর্তে মুহূর্তে কেঁপে উঠে। এর মাধ্যমে আমেরিকানরা জানান দেয় প্রতিরোধের ভাষায় ব্রিটিশদেরকে- আমরা এখনো জেগে আছি।

অন্যদিকে “ক্যামব্রিজ ও বোস্টন” শহর দুটি সাড়া পৃথিবীর ট্যালেন্টেড মানুষগুলোকে ছেঁকে ছেঁকে কাছে টেনে আনে। কীভাবে ও কেন? এর পিছনে মূল কারণ হচ্ছে এখানকার উন্নত ও আধুনিকমানের শিক্ষা-দীক্ষা, গবেষণা ও চাকরির সুযোগ। এটা হয়তো আমাদের সবারই জানা যে, রেঙ্কিং-এ পৃথিবীর সবচেয়ে টপ ও নামকরা যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রথমেই উঠে আসে তার একটি হচ্ছে হার্ভার্ড, অন্যটি এমআইটি (ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি)। এমআইটি-র ক্যাম্পাস ক্যামব্রিজ শহরে। আর হার্ভার্ডের ক্যাম্পাস রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কিছু রয়েছে ক্যামব্রিজ শহরকে ঘিরে, আর কিছু বোস্টনে। মূলত চার্লস রিভারের দু’পাশেই। বোস্টনের অন্য দুটি নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়েরও অবস্থান চার্লস রিভারের সন্নিকটেই। নাম-বোস্টন ইউনিভার্সিটি এবং ব্রান্ডিস ইউনিভার্সিটি। বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে চার্লস রিভারের বুকে চালিত নৌকাগুলোকে (For Sailing and dragonboating) একেবারেই খুব কাছে মনে হয়।

গ্রেটার বোস্টনের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততম ও কোলাহলের স্থান হচ্ছে ক্যামব্রিজ ও বোস্টন ডাউনটাউনকে ঘিরে। কারণ, একাধিক নামি-দামি ইউনিভার্সিটি ও ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি থাকার কারণে স্টুডেন্ট, গবেষক ও কর্মজীবী মানুষের গায়ে গা লাগা ভিড় এখানে লক্ষণীয়। তদুপরি দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাজার হাজার ভিজিটরদের পদচারণা তো আছেই। এখানে এটা উল্লেখ না করলেই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের ইস্টকোস্টে বায়োটেক ও ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় হাব যেমন গ্রেটার বোস্টনে (যার অধিকাংশই ক্যামব্রিজে), তেমনি ওয়েস্ট কোস্টের বড় হাব হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিসকো ও সানডিয়েগো শহরকে ঘিরে (ওয়েস্ট কোস্টের অপর ইনোভেটিভ ও টেকনোলজি শহর হচ্ছে সিলিকন ভ্যালি)। ইস্ট কোস্টের মধ্যে গ্রেটার বোস্টন হচ্ছে বড় টেকনোলজির শহর। বিশ্ব পরিচিত নোভারটিস ফার্মা, মার্ক, মিলেনিয়াম, বায়োজেন আইডেক, অ্যালনাইলাম, সানোফি-জেঞ্জাইম, মডারনা ইত্যাদি নানা ফার্মার অবস্থান এই ক্যামব্রিজ শহরেই। ব্যস্ততম এই ক্যামব্রিজ ও বোস্টন শহরকে তাই কানেক্ট করেছে মূলত চার্লস রিভারের উপরে নির্মিত ব্রিজগুলো, যেখানে রয়েছে পায়ে হেঁটে চলার পথ, গাড়ি চলার রাস্তা ও সাবওয়ের লাইন। শহর থেকে দূরের কর্মজীবী মানুষগুলোকে বয়ে আনার জন্য তাই রয়েছে পাতালরেল বা সাবওয়ে (রেড লাইন, ইয়েলো লাইন ও গ্রীন লাইন), অ্যামট্রাক (দূরপাল্লার ট্রেন) ও কমিউটার ট্রেন। যানবাহনগুলো বিনা কারণে এক মিনিটের জন্যও কোথাও সময়ের কোনো হেরফের করছে না। এক দারুণ আধুনিক কমিউনিকেশন সিস্টেম গড়ে উঠেছে এই বোস্টনকে ঘিরে। আহ! ঢাকা শহরের ডিজাইন যদি এমন হতো, মানুষের প্রতিদিনের কষ্ট কত না লাঘব হতো।

হার্ভার্ড ও এমআইটি এবং বোস্টন ও ব্রান্ডিস ইউনিভার্সিটি- এই নামগুলো ভিন্ন হলেও সবগুলোর অবস্থান কিন্তু চার্লস রিভারকে ঘিরেই। আবার এগুলোর লোকেশনও ক্যামব্রিজ ও বোস্টন শহরে। এই নদীর প্রবাহমান স্রোত এখানের শহরগুলোকে আলাদা করলেও মূলত মানুষের পদচারণায় তা আর কখনোই আলাদা মনে হয় না। অবিচ্ছিন্ন এক শহর তাই গ্রেটার বোস্টন।
লেখক : গ্রেটার বোস্টন থেকে। সূত্র : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *