হাবিবুল্লাহ সিদ্দিক
‘বাংলাদেশের মানুষ বেশ ঝাল খায়, কিন্তু তারা প্রচণ্ড অতিথিপরায়ণ।’ কথার শুরুতেই বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন মজার মন্তব্য করলেন হেলগা। ‘ঝাল’ ও ‘অতিথিপরায়ণ’ শব্দ দুটি দিয়ে আদতে কী বোঝাতে চাইলেন হেলগা হোলিডা, তা বোঝা গেল না। কিন্তু তাঁর কথায় ঠিকই হেসে উঠলেন পাশে বসে থাকা রাল্ফ ডিকমান, ভিলহ্যাম আর ক্রিশ্চিয়ান গেরকে। তাঁরা চারজনই জার্মানির। বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন মন্তব্য করার কারণও আছে। সপ্তাহ দু-একের জন্য বাংলাদেশের এসেছিলেন তাঁরা। গত নভেম্বর আর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ মিলিয়ে মোটামুটি ১৪ দিন আনন্দময় সময় কাটিয়ে গেলেন তাঁরা।
বাংলাদেশ ছাড়ার শেষ দিন গত ৬ ডিসেম্বর কথা হয় তাঁদের সঙ্গে, পল্টনের আবাসিক হোটেল ‘একাত্তর’-এ বসে। পরদিনই ভোরের ফ্লাইটে জার্মানির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। দেশে যাওয়ার তাড়া আছে। আছে ব্যাগ গোছানোর তাড়াও। কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে বসে তাঁদের কারও মধ্যেই সে ‘তাড়া’ খুঁজে পাওয়া গেল না। সেসব ছাপিয়ে চোখমুখ ঠিকরে বেরিয়ে পড়ল আনন্দ। সে আনন্দে ভাসতে ভাসতেই বললেন, ‘এখানে আসার আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা ছিল না। আমাদের বন্ধু সরাফ আহমেদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানি। তারপরই আগ্রহটা বেড়ে যায়। তাই হুট করেই চলে আসি।’
জার্মানির হ্যানোভার শহরের ভেলবা এলাকায় থাকেন এই চারজন। পেশায় কেউ প্রকৌশলী, কেউ তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মী। কিশোরীদের ফুটবল খেলা আর দল তৈরির মাধ্যমেই এই চারজনের সঙ্গে পরিচয় তাঁর। চারজনই জানালেন, প্রায়ই তাঁরা হুটহাট ঘুরতে বের হন। এরই মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশ চষে বেড়িয়েছেন। সর্বশেষ তালিকায় বাংলাদেশ।

গ্রামবাংলার রিকশায় সওয়ার
তো বাংলাদেশের কী ভালো লাগল? এমন সহজ প্রশ্ন ছিল তাঁদের কাছে। ‘মানুষ। এই দেশের মানুষ অসাধারণ।’ বললেন হেলগা।
অবশ্য বাংলাদেশের খাবার নিয়ে উচ্ছ্বাসও কম নয় তাঁদের। ক্রিশ্চিয়ান ও রাল্ফের পছন্দের তালিকায় আছে বাংলাদেশের কাবাব। বাকি দুজনেরও তা-ই। ডালের প্রশংসা করলেন হেলগা। কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন গিয়ে মাছ খেয়েছেন দেদার।
চারজন বেড়িয়েছেন খুলনা, মংলা বন্দর, সুন্দরবন, কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন। প্রতিটি জায়গায় গিয়েই মুগ্ধ হয়েছেন। ভালো লেগেছে কক্সবাজারের বিশাল সমুদ্রসৈকত। ক্রিশ্চিয়ানের কথায় অবশ্য খানিকটা হতাশাও ছিল। ‘তোমাদের এত বড় সমুদ্রসৈকত আছে, এটা কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার। এর ব্যাপারে সচেতনতা প্রয়োজন।’ তাঁর কথায় ঘাড় নাড়লেন বাকি তিনজন। তবে রাল্ফ জানালেন সুন্দরবনে গিয়ে বেশ কয়েকটি প্রাণী দেখার গল্প। বানর দেখার অভিজ্ঞতাও যে এত সুন্দর করে গুছিয়ে কেউ বলতে পারেন, এটা রাল্ফ না বললে জানা হতো না।
বেড়িয়েছেন ঢাকাতেও। আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ বেশ কিছু জায়গায় ঘুরেছেন তাঁরা। ফিরে যাওয়ার আগের দিন গিয়েছিলেন তৈরি পোশাক কারখানা ফ্যাশন জোন লিমিটেডে। ক্রিশ্চিয়ান বললেন, ‘গার্মেন্টসে কাজ দেখলাম অনেকক্ষণ। ফিরে আসার সময় আমাদের সবাইকে দুটি করে শার্ট উপহার দিলেন মালিক এলাহী বাবু। আমরা তো মুগ্ধ। কিন্তু সমস্যা হলো হেলগাকে নিয়ে। ওর লম্বা সাইজের শার্ট পাওয়া যাচ্ছিল না কোনোমতে। পরে অবশ্য এলাহী ওর মাপ রেখে দিলেন। ঠিক দুই ঘণ্টার মধ্যে হেলগার শার্ট এসে হাজির। আমরা তো পুরো অবাক!’

সুন্দরবনের অভিযাত্রী।
ছোট উপহার, তবু এই আতিথেয়তার গল্প করতে গিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন চারজনই।
জানতে চাই, দেশে ফিরে বাংলাদেশের কোন গল্পটি করবেন সবার কাছে? খানিকটা দ্বিধা নিয়েই উত্তর দিলেন ভিলহ্যাম। ‘আমাদের একটানা ১৫ ঘণ্টা বাসভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেই। এখানে এসে এটা হয়েছে। কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসার সময় এমনটা হয়েছে।’ আরও একটা ভ্রমণের কথা বললেন। রিকশাভ্রমণ। ‘গত বছর ভারতে ভ্রমণের সময়ও রিকশা দেখেছেন। কিন্তু ঢাকার রিকশা আর ভারতের রিকশার মধ্যে পার্থক্য আছে।’
হেলগা শেষে বললেন, ‘ইউরোপ আর জার্মানির পত্রিকা বা টেলিভিশনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর দরিদ্রতম দেশ বাংলাদেশের যে চালচিত্র দেখানো হয়, তার সঙ্গে কাছ থেকে দেখা বাংলাদেশের রয়েছে বিস্তর ফারাক, তা এখানে না এলে বিশ্বাস হতো না।’
আলাপের শেষে চারজনই জানিয়ে রাখলেন, এই দেশে যেখানে গিয়েছি নিরাপদ বোধ করেছি। সুযোগ হলে আবার আসব। ছবি: রাল্ফ, ভিলহ্যাম আর ক্রিশ্চিয়ানের সংগ্রহ থেকে। সৌজন্যে : প্রথম আলো