Skip to content

চিচিং ফাঁক তোজেংমা

:: মো. জাভেদ হাকিম ::

নতুন এক ঝরনার নাম তোজেংমা। আর দে-ছুটের ভ্রমণ পাগলারা নতুন কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানেই ঘর ছাড়তে পছন্দ করে। ঢাকা থেকে রাতের বাসে ছুটি খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালার উদ্দেশে। যানজটমুক্ত রাস্তা থাকায় ভোর সাড়ে চারটার সময় পৌঁছাই সেখানে। গেস্ট হাউসে রুম বুকিং থাকায় বাড়তি ঝামেলা না করেই সোজা চলে গেলাম রুমে। গাইডের অপেক্ষায় কিছুটা সময় চিত্-কাত হয়ে নিলাম বিশ্রাম। অতঃপর সকাল ৯টায় রুম থেকে বের হয়ে নাস্তা শেষে বাইকে ছুটি আলমগির টিলার উদ্দেশে। মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছাই। এবার ভরসা দুই পা। সকাল দশটায় হাঁটা শুরু। উঁচু-নিচু টিলা-পাহাড়-ঝিরি-ঝোপঝাড়, জঙ্গল দিয়ে শুধু হাঁটছি। আমরা ছয় জন ও গাইড পাঁচ জন—মোট এগার জন। গাইড পাঁচ জন কারণ প্রধান গাইড সে নিজেই তোজেংমা ঝরনা চিনে না। তাই ওরাসহ আমাদের সবার নিরাপত্তা ও সুবিধার জন্য সে আরও চারজনকে সঙ্গে নিয়েছে। কেউ চিনে না, শুধু লোকেশন নির্ভর করে এগিয়ে যাওয়া এমন নিঝুম-বুনো পাহাড়ি পথে হাইকিং, ট্র্যাকিং সত্যিই অন্যরকম রোমাঞ্চকর। নৈঃশব্দের বুনো পরিবেশে একটা সময় পথ হারিয়ে ফেলি। ভুল পথে উঠে যাই উঁচু এক পাহাড়ে। কী আর করা নামতে হবে আবারও। তবে বাড়তি পাওনা চূড়া থেকে দেখা চারপাশের অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কিছুটা শুকনো খাবার খেয়ে নব উদ্যমে ছুটলাম। কিছুটা দূর এগিয়ে যাওয়ার পরেই এক অন্য রকম ভালোলাগা রহস্য ঘেরা অনুভূতি মনে দোল দেয়। বয়ে যাওয়া পানির বিপরীতে হাঁটা, পায়ের নিচে মরণ ফাঁদ পাথর খণ্ড, মাথার উপর ডালপালা, দুপাশে গভীর জঙ্গল—সূর্যের রশ্মিও যেখানে হার মেনেছে; এ রকম ঝিরি পথে এগিয়ে যাওয়া মানে সত্যিই অ্যাডভেঞ্চারের ষোল কলা পূর্ণ হওয়া।

বেলা প্রায় দুটো, আবারও বিরতি। ভর দুপুরেও অন্ধকার এমন পরিবেশে কিছুটা সময় জিরিয়ে নেওয়ার পর আবারও শুরু হলো হাইকিং। গড়িয়ে যাওয়া পানির তীব্রতাই বলে দেয় আর বেশি দূরে নয় লুকিয়ে থাকা বুনো সৌন্দর্য তোজেংমা ঝরনা। ঠিক ঠিকই আধা ঘণ্টার মধ্যেই রিমঝিম ছন্দ তোলা পানির শব্দ ভেসে আসে কানে। আনন্দে চোখে মুখে সবার হাসির ঝিলিক। পানির উত্স ধরে এগোতেই সামনে পড়ে ইয়া উঁচু এক পাহাড়। প্রকৃতির আপন খেয়ালেই পাহাড়টি দুই ভাগ হয়ে সেই কল্পকাহিনির আলী বাবার চিচিং ফাঁক দুর্গের রূপ ধারণ করে আছে। এসবই প্রকৃতির লীলাখেলা। আমিও ক্ষণিকের জন্য আলীবাবা সেজে চিত্কার দিয়ে বলে উঠি, ‘চিচিং ফাঁক তোজেংমা।’ পিচ্ছিল পাথর টপকিয়ে সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকতেই চোখ উঠল কপালে। আরে এ যে সত্যি সত্যি বাস্তবের ধন-দৌলতের দুর্গ। শুধু এর ব্যবহার জানতে হবে। ভাগ হয়ে যাওয়া দুই পাহাড়ের দুই পাশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম পানির ধারা। তবে সেই পানির পরশ পেতে চাই আরেকটু ধৈর্য। সেই প্রকৃতি ও পরিবেশের সান্নিধ্য পেতে হলে কিছুটা তো কষ্ট করতেই হবে। গুহার রূপের আচ্ছন্নতায় না পড়ে সজাগ দৃষ্টিতে বড় বড় ধারালো চোখা পাথর মাড়িয়ে চলে যাই একেবারে তোজেংমার কোলে। আহ্ কি শান্তি! পুরো নির্জনতায় জংলী পরিবেশে গুহা আকৃতির দুই পাহাড়ের উপর থেকে দুটো ঝরনার সফেদ সাদা পানি তীব্র গতিতে ছুটে এসে আলিঙ্গন করে একই বিন্দুতে। পানির ক্ষীপ্রতায় সৃষ্টি হওয়া প্রাকৃতিক বাথটাবে সাঁতার কাটা যাবে অনায়াসে। ঝরনা দুটোর উচ্চতা খুব বেশি উঁচু নয়, তবে তোজেংমার রয়েছে ভিন্ন রকম বৈশিষ্ট্য আর অদ্ভুত আকৃতির নজরকাড়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ঝরনার আছড়ে পড়া পানির তীব্রতাও বেশ। এখনো অধিকাংশ ভ্রমণপিপাসুদের নিকট অচেনা-অজানা রয়েছে তোজেংমা ঝরনার রূপ রহস্য। ঝরনার আশপাশে নেই কোনো বসতি, তাই তোজেংমা নামের আভিধানিক অর্থ কী তাও এবারের জন্য আড়ালেই রয়ে গেল। অনিন্দ্য সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম প্রকৃতির মলাটে সাজানো পাহাড়ের কোলে নিজেকে লুকিয়ে রাখা অসম্ভব ভালোলাগার তোজেংমার পানিতে প্রায় ঘণ্টা খানেক ভিজে ফেরার পথ ধরি। আহ্ সেই আনন্দ লিখে জানানো সম্ভব নয়।

গুহামুখে এসে ভারাক্রান্ত হূদয়ে চিত্কার দিয়ে বলে উঠি, ‘বিদায় তোজেংমা বিদায়!’

কীভাবে যাবেন
ঢাকার গাবতলী-ফকিরাপুল-সায়েদাবাদ হতে দিনে রাতে প্রতিদিন খাগড়াছড়ি ও দীঘিনালার উদ্দেশে বিভিন্ন পরিবহনের এসি/নন-এসি বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৫২০, ৫৮০, ৯০০ টাকা মাত্র। দীঘিনালা হতে বাইকে আলমগির টিলা। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। যাওয়ার সময়ই ফেরার বিষয়টা বাইকচালকের সঙ্গে ঠিক করে রাখুন। নয়তো গাড়ি পেতে ঝামেলা হবে।

কোথায় থাকবেন
দীঘিনালা বাজারে বিভিন্ন গেস্ট হাউস রয়েছে। ভাড়া ৫০০ টাকা হতে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। তবে মৌসুম অনুযায়ী ভাড়ায় তারতম্য ঘটে।

খাবেন কোথায়
গেস্ট হাউসগুলোর পাশেই বেশ কিছু খাবারের হোটেল রয়েছে, খাবার শেষে বিল পরিশোধের আগে কী কী খেলেন সেই হিসেব কষে নিন সঠিকভাবে। অন্যথায় এক আইটেমের বিল দু’বার দেওয়া লাগতে পারে।

খরচপাতি
খরচ জনপ্রতি এক রাত দুই দিনের জন্য ২৫০০ টাকা হলেই যথেষ্ট। অবশ্য খরচটা নির্ভর করে অনেকটা নিজেদের সামর্থ্যের ওপর।

গাইড
তোজেংমার পথে এখনো তেমন কোনো প্রফেশনাল গাইড মিলবে না। দুর্গমের বুনো গন্ধ আর নতুনত্ব দেখার তীব্র বাসনা যাদের, শুধু তাদের জন্যই পাহাড়ি জংলী পথের তোজেংমা ঝরনা দেখার সাধ্য রয়েছে। গাইড চার্জ নির্দিষ্ট নয়। সারাদিনের জন্য ৮০০ টাকা দিলেই যথেষ্ট। যদি কারো সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে তাহলে নিচে দেওয়া ফেসবুক আইডিতে পরামর্শ নিতে পারেন। সৌজন্যে : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *