Skip to content

চিরায়ত বাংলার জাদুঘর

মজিবর রহমান খান
ঠাকুরগাঁও শহর থেকে খানিকটা দূরে অকচা গ্রামে গড়ে উঠেছে এক জাদুঘর। আর দশটা জাদুঘরের মতো নয় এটি। বরং বলা যায়, খেটে খাওয়া মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রামের সঙ্গী যা কিছু, সেসবের চমৎকার উপস্থাপনা এখানে। জাদুঘরটির নাম লোকায়ন। কৃষিকাজে ব্যবহৃত নানা উপকরণ স্থান পেয়েছে এখানে। পাশাপাশি গ্রাম বাংলায় ব্যবহৃত নানা উপাদান, উপকরণ রয়েছে এখানে। বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এটা যেন গ্রাম বাংলার জাদুঘর।

Lokayan
জাদুঘরটির উদ্যোক্তা মুহম্মদ শহীদ উজ জামান। তিনি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। সংস্থার কর্মীসহ এলাকার অনেক ব্যক্তির দান করা উপকরণ দিয়েই সাজানো হয়েছে জাদুঘরটি। এখানে খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত আর ঘামে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যই স্থান পেয়েছে বেশি। কৃষক-খামারি, কামার-কুমার, জেলে-তাঁতি, দিনমজুর তথা সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত কী নেই এখানে?

Lokayan2লোকায়ন জাদুঘরে আছে লাঙল-জোয়াল, মই, ফলা, নিড়ানি, দা, কাস্তে, খুন্তি, মাথাল, ধান রাখার ডুবি, কৃষকের খেতের ইঁদুর মারার জন্য নানা রকমের ফাঁদ, গরুর গলায় বেঁধে দেওয়া ঘণ্টা, মুখে দেওয়া টুনা, ডাল ভাঙার জাঁতা, ঢেঁকি, ছাম-গাইন, হাতুড়ি, শাবল, কোদাল, কুঠার, কামারের হাপর, দড়ি পাকানোর ঢ্যারা, সেচের জোত, মাছ ধরার চাঁই, পলো, জাল, টোঁটা, খড়ম, বসার মোড়া, পিঁড়া, হুক্কা, চেরাগ, কুপি, হাতপাখা, ঢাক, ঢোল, মাদল, বাঁশি, একতারা, দোতারা, সানাই, পালকি, টোপর, কুলা, চালনি, ডালঘুটনি, শিলপাটা, ক্ষুর, পুঁথি, চিঠিপত্র, খাজনা আদায়ের রসিদ, গরুর গাড়ি, সাইকেল, হাতের চুড়ি, বালা, হাঁসুলি, বাজু, কুয়ো থেকে বালতি তোলার কাঁটা, মাটির সানকি, বাসন-কোসন, তরবারি, ঢাল, সড়কি, তির-ধনুক, বল্লমও বাদ যায়নি সংগ্রহ থেকে। বলতে গেলে বস্তুগত নিদর্শনের প্রদর্শনীতে পুরো বাংলাদেশের জীবনযাত্রাই তুলে ধরার চেষ্টা রয়েছে জাদুঘরটিতে। এখানে এলে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যের শিকড়ের অনেকটাই সন্ধান মিলবে।

শুধু শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামের ইতিহাস উপস্থাপন নয়, কৃষি ও কৃষকের জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত বর্ষামঙ্গল, নবান্ন, পিঠা উত্সবের মতো নানা উত্সব এখানে উদ্যাপন করা হয় নিয়মিত। সেসব উত্সবে স্থানীয় লোকনাট্য ধামের গান, কবিগান, গীত, আদিবাসী গান-নাচ পরিবেশন করা হয়। উত্সবে যোগ দেওয়া অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয় কলাপাতা ও মাটির তৈরি বাসন-কোসনে।

Lokayan3

প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা থাকে এই জাদুঘর। চারদিকে গাছগাছালিতে ঘেরা বিশাল চত্বর। রয়েছে ৭০ প্রজাতির ফলের গাছ, ১২০ প্রজাতির ঔষধি গাছ। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে বসার জন্য বাঁশ দিয়ে তৈরি মাচা। চেয়ার ও টেবিল তৈরি করা হয়েছে নানা গাছের গুঁড়ি দিয়ে। গ্রামীণ পরিবেশ ও পাখপাখালির আপ্যায়নের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। পাখির কলকাকলি মনকে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে।

জাদুঘরে বেড়াতে আসা শিশুদের বিনোদনের জন্য বসানো হয়েছে দোলনা, চরকি, ঢেঁকিসহ নানা ধরনের খেলনা। প্রতি মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে লোকায়নের উদ্যোক্তা নিজেই বেড়াতে আসা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে এই অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি প্রদর্শন করা হয় শিশুতোষ চলচ্চিত্র।

মুহম্মদ শহীদ উজ জামান বলেন, লোকায়ন কোনো আভিধানিক শব্দ নয়। লোকজ, সংস্কৃতি ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামে ব্যবহৃত বৈচিত্র্য সব উপকরণভিত্তিক ওই জাদুঘর যখন লোকমানুষের জন্য। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে ‘লোকায়ন-জীবন বৈচিত্র্য জাদুঘর’।

Lokayan4মুহম্মদ শহীদ উজ জামান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে জানালেন, ‘সুশিক্ষার লক্ষণ এই যে, তাহা মানুষকে অভিভূত করে না, তাহা মানুষকে মুক্তি দান করে। যাদের রক্ত-ঘামে আজকের এই সভ্যতা, তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শিকড় না জানলে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন কেমন করে হয়?’ লোকায়নের উপস্থাপনায় এই অঞ্চলের ঐতিহ্য ও গৌরবকে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। লোকায়নের উপস্থাপনা এলাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেবে।

দেশ-বিদেশের জাদুঘরগুলোর অন্তরালে রয়ে গেছে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামের কথা। যান্ত্রিকতায় অভ্যস্ত মানুষের কাছে অন্তরায় থাকা এসব শ্রমজীবী মানুষের সবকিছুই স্মৃতিময় হয়ে যেতে বসেছে। সংগ্রামী সব মানুষের জীবন-জীবিকার কথা চিরজাগ্রত রাখতেই লোকায়নের এ প্রচেষ্টা—জানালেন মুহম্মদ শহীদ উজ জামান। সৌজন্যে : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *