ইকবাল হাসান
জানুয়ারির রৌদ্রস্নাত সকালে হাভানার পার্ক সেন্ট্রাল হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, চে গুয়েভারার বাড়িতে যাব। শুনে ভাঙা ইংরেজিতে আমাকে যা বোঝাতে চাইলেন কিংবা আমি যতটুকু বুঝলাম তা হলো, ওখানে যেতে হলে টানেল দিয়ে যেতে হবে। আমি রাজি আছি কি না। আলবত রাজি, জানতে চাইলাম, কেন কোনো অসুবিধা আছে? ট্যাক্সিওয়ালা বললেন, মাঝে মাঝে ওই টানেল বন্ধ থাকে। আমরা বাঙালি, তার ওপর বাড়ি বরিশাল, দমবার পাত্র নই মোটে, বললাম, যাব। চব্বিশ কিলোমিটার পথ, যেতে তেত্রিশ মিনিট। কিছুদূর এসেই টানেল, নদীর তলদেশে। ভিড়বাট্টা নেই। টানেলের ভেতর আলোর স্বল্পতা চোখে পড়ার মতো। মাথার ওপর নদীর স্রোত, একটু গা ছমছম ভাব হয় যাবার পথে।
যার পায়ে এখনো মফস্বলের কাদা লেগে আছে, ভাবতেই পারি না সেই আমি, অবশেষে দাঁড়িয়ে আছি চে গুয়েভারার বাড়ির সামনে। স্বপ্নের একটি দৃশ্যচিত্র যেন, দেয়ালে লাল হলুদের খেলা ও সোনালি আলোয় ভরা দিন আর উপকূলীয় বাতাস ‘চে’ নামের বাড়িটিকে বড় আপন করে তুলেছে। আকাশে মেঘ নেই বলে আলো এখানে প্রভূত বিস্তৃত, ফলে বাড়িটির প্রবেশমুখে লাল হরফে ‘চে’ লেখাটি দীপ্র হয়ে দেখাচ্ছে যেন আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা। আর অনতিদূরে কংক্রিটে নির্মিত সেন্ট চার্লসের বিশাল ভাস্কর্য। কেতাব হাতে তাকিয়ে আছেন সমুদ্রের দিকে। তাঁর পোশাক ধবধবে সাদা।
চে নামের বাড়ি
চে নামের বাড়িটিও একেবারে সাদামাটা, কোনো আদিখ্যেতা নেই, ছিমছাম, একতলা। খোলা ছাদ, যেখান থেকে দেখা যায় অবারিত আকাশ আর অনতিদূরের হাভানা; শোনা যায় সমুদ্রের গর্জন। একতলার ছাদে একটি চিলেকোঠা আছে। কেয়ারটেকার মহিলাদের একজন জানালেন, ‘ওখানে কেউ থাকে না। নিয়ম নেই।’ সর্বসাকল্যে পাঁচ-ছয়টি কক্ষ মাত্র, সযত্নে সাজানো। ছোট ছোট। চে-এর দৈনন্দিন ব্যবহৃত তৈজসপত্র, পাইপ, কফি বানানোর ছোট্ট পট সাজানো দুটো শোকেসে। যে কক্ষটিকে শোবার ঘর বলে শনাক্ত করা যায় সেখানে একটি খাট, ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা। আছে খাবার প্লেট, রেডিও ও একটি টাইপরাইটার। কিউবান পতাকা, টেবিল চেয়ার আর কালো রঙের ফোন নিয়ে ছোট্ট অফিস কক্ষ, এই বাড়িতে থাকাকালে কমরেড চে এখানে বসেই অফিস করতেন। এই কক্ষটির দেয়ালে রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে আলাপরত চে-এর সাদাকালো একটি ছবি। রোগের কাছে পরাভূত হওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না তিনি। মধ্যরাত পর্যন্ত অফিস করতেন, পাশের কক্ষটি অপেক্ষাকৃত বড় আকারের, চে এই কক্ষে নিয়মিত সভা করতেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে। কক্ষটিতে জনা পঞ্চাশেক লোক বসতে পারে। চেয়ারগুলো এখনো ওইভাবে সাজানো রয়েছে। দেখে মনে হলো, এই মাত্র সভা করে চলে গেছেন প্রিয় কমরেড।
২.
রাজধানী হাভানার হাতের নাগালের ভেতরেই লা কাবানায় [আসল নাম: ফোর্ট অব সেন্ট চার্লস] সমুদ্র উপকূলীয় টারারা নামের ক্ষুদ্র শহরে এই বাড়িটি। স্বৈরশাসক জেনারেল বাতিস্তার আমলে অভিজাতদের দখলে ছিল পুরো এলাকা, তখন এই বাড়িটিতে থাকতেন কাস্টমসের এক কর্মকর্তা।
১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে ইতিহাসের মহানায়ক ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারার নেতৃত্বে কিউবান বিপ্লবীরা লা কাবানা দখল করে নেয় কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই বাতিস্তার সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে, পালিয়ে যায় তার অভিজাতরাও।
চে গুয়েভারা বিপ্লবোত্তর কিউবার প্রতিরক্ষা প্রধান হিসেবে ১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ১২ জুন লা কাবানায় ছিলেন। এখানে বসেই তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড কার্যকর-প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করতেন। ‘চে’ নামের বাড়িটিতে তিনি মাস দুয়েক ছিলেন। বাড়িটি তাঁর স্ত্রী আলিদা মার্চের পছন্দ না হলেও পরবর্তী সময়ে হানিমুন করার জন্য এই বাড়িটিকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। আরও কয়েকবার এসেছিলেন এই বাড়িতে। তখন অবশ্য বাড়িটির নাম ‘চে’ ছিল না। পরবর্তী সময়ে চে নিহত হওয়ার পর বাড়িটিকে জাদুঘরের আবহ দেওয়া হয়। বাড়িটির নাম রাখা হয় ‘চে’।
বিপ্লবের শেষ দিকে বনজঙ্গলের ভেতর তিনি অ্যাজমায় আক্রান্ত হলে মুক্ত বাতাস ও সমুদ্র-সান্নিধ্য জরুরি হয়ে ওঠে তাঁর জন্য। কেয়ারটেকার মহিলা বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বললেন, প্রেমিকা এবং পরবর্তী সময়ে স্ত্রী আলিদা মার্চকে নিয়ে সমুদ্র উপকূলীয় এই বাড়িটিতে উঠে আসেন তিনি। স্বয়ং কমরেড ফিদেল কাস্ত্রো নাকি তাঁকে আপাতত এই বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন তথ্যচিত্রে দেখা যায় যে, অসুস্থ চেকে দেখার জন্য রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রো এই বাড়িতে এসেছেন বহুবার। অ্যাজমা তখন প্রায় কাবু করে ফেলেছিল কমরেড চেকে। টানা দুমাস এই বাড়িতে কাটানোর পর এখানকার মাইক্রোক্লাইমেট, বিশেষ করে পরিশুদ্ধ বাতাস আর বিশুদ্ধ জল এবং প্রেমিকা নার্স আলিদা মার্চের সার্বক্ষণিক পরিসেবায় তিনি অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেন। বিপ্লবের সহযোদ্ধা আলিদা মার্চকে বিয়ে করেন ১৯৬০ সালে এবং এ সংসারে তাঁদের রয়েছে চার সন্তান।
১৯২৮ সালের ১৪ জুন বিশ্বের সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহান বিপ্লবী চে গুয়েভারার জন্মদিন। জন্মস্থান আর্জেন্টিনার রোজারিও। বাবা আর্জেন্টাইন-আইরিশ। পেশায় স্থপতি। চিকিত্সাশাস্ত্রে শিক্ষা শেষে দুই বছর চে গুয়েভারা দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরে বেড়ান এবং একপর্যায়ে মেক্সিকোতে কিউবা বিপ্লবের মহানায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। তাঁরা পরিকল্পনা করেন মার্কিনদের পদলেহনকারী, চরম দুর্নীতিবাজ একনায়ক জেনারেল বাতিস্তাকে উত্খাত করে শোষিত-চিরবঞ্চিত জনগণের হাতে রাষ্ট্রের মালিকানা তুলে দেওয়ার। এই সময় তাঁকে চে নামটি দেওয়া হয়, যার অর্থ সবার বন্ধু। বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত শোষিত মানুষের অধিকার আদায় আর সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মোত্সর্গকারী এই মহাপুরুষ আজ শুধু কিউবায় নয়, যেন সারা পৃথিবীর মানবমুক্তির প্রতীক, সবার বন্ধু।
আর ‘চে’ নামের ওই বাড়িটি থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে মনে হলো, যেন বাড়িটি স্যুররিয়াল, বাস্তব-অবাস্তবের মাঝামাঝি এক টুকরো মেঘের মতোন ভাসমান জীবন্ত মন্দির, যেন একটি দীর্ঘশ্বাস। আর ভেতরের সবকিছু দেখে আমার ভাবতে অবাক লাগে, বিস্মিত হই এই ভেবে যে এত সামান্য কিছু দিয়েও একজন বিশ্বখ্যাত বিপ্লবীর চলে, যার রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল্টে দেওয়ার দর্শন ছাড়া অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই তেমন।
শুধু ফেরার সময় আমার এই পোড়া কপালে তিন আঙুল ঠেকিয়ে মনে মনে বললাম, রেড স্যালুট টু ইউ কমরেড। সৌজন্যে: প্রথম আলো