১৯৫৭ সালের ৩১ আগস্ট দেশটি ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬৩ সালে উত্তর বোর্নিও, সারাওয়াক ও সিঙ্গাপুর নিয়ে গঠিত হয় মালায়া ইউনাইটেড। সেখান থেকেই দেশটির নামকরণ করা হয় মালয়েশিয়া। মাত্র দুই বছর পরই ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার হয়ে আলাদা হয়। স্বাধীন মালয়েশিয়া তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে যাত্রা করে। উঁচু-নিচু পাহাড়ঘেরা অসমতল এবং নানা ধর্ম-জাতি ও গোত্রের সমন্বয়ে দেশটি এখন পর্যটকদের স্বপ্নের দেশ। মালয়েশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান নিয়ে লিখেছেন— মাহমুদ আজহার ছবি তুলেছেন— জয়ীতা রায়।
ছিমছাম ছবির মতো সাজানো-গোছানো শহর মালয়েশিয়ার পুত্রজায়া। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে নেমে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরের পথ। যানজটমুক্ত পরিকল্পিত ও সাজানো-গোছানো শহর। পৃথিবীর অন্যতম প্রধান আধুনিক ও শৈল্পিক-স্থাপত্যশিল্পের পরিপাটি নগরী।
শহরটি তথ্য-প্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এ শহরটি। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের সঙ্গেই লেকবেষ্টিত দৃষ্টিনন্দিত পুত্রা মসজিদ দৃষ্টি কাড়ে পর্যটকদের। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের দেখা মেলে ঝিলপাড়ে। লন্ডনের টেমস নদীর ব্রিজের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে পুত্রায় এ দুটি ব্রিজ। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। জানা যায়, ১৯১৮ সালে ব্রিটিশরা স্থানটি উন্মুক্ত করে। তখন এয়ার ‘হিতাম’ নামকরণ করা হলেও এর আদি নাম ‘প্রাং বেসার’। মূল ভূখণ্ডটি ৮০০ একরের হলেও পরবর্তী সময়ে এর পরিধি কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয়। এখন পরিধি ৮ হাজার একর বা ৩২ বর্গ কিলোমিটার। শহরটির প্রায় ৪০ শতাংশ প্রাকৃতিক। পুরো নগরকে কেন্দ্র করে রয়েছে সবুজ বনানী। বোটানিক্যাল গার্ডেনের অপরূপ ল্যান্ডস্কেপ এই শহরকে করে তুলেছে অনন্য এবং আরও দৃষ্টিনন্দন। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে বিভিন্ন ধরনের জলাশয় এবং পানির ধারা। বিশেষ করে, পুত্রজায়া লেক পুরো নগরের আকর্ষণের বিশ্রাম-বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র। শহরজুড়ে বিস্তৃত এই লেক। শহর কেন্দ্রে কোলোস্যাল শোকেস বিল্ডিং পুত্রজায়ার সব থেকে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান। এখানে ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে প্রবেশে কিছু বিধিনিষেধ মানতে হয়। বিশেষ করে, পোশাকের ক্ষেত্রে। উদাহরণ হিসেবে পের্দানা পুত্রা, সেরি পের্দানা এবং পুত্রা মসজিদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। চমৎকার সুন্দর এবং সাজানো শহর পুত্রজায়া। ভবনের স্থাপত্যশৈলী, নকশা, চারপাশের গ্রিন স্পেস, মন মাতানো সাজসজ্জা যে কাউকে আকর্ষণ করবে। পুত্রজায়া লেকের সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। লেকের আশপাশেই রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতর। রয়েছে পারডানা লিডারশিপ ফাউন্ডেশন, বিচারালয়, হেরিটেজ স্কয়ার, লৌহ নির্মিত টুংকু জয়নাল আবেদীন মসজিদ, পুত্রজায়া ল্যান্ডমার্ক, ওয়েটল্যান্ড পার্ক। মিলেনিয়াম মনুমেন্ট, ন্যাশনাল হিরোজ স্কয়ার ও স্বাধীনতা চত্বরও পুত্রজায়ায়। পুত্রজায়ায় আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টার (পিআইসিসি), লৌহ মসজিদ (স্টিল মস্ক), পুত্রজায়া ব্রিজ, পুত্রজায়া বোটানিক্যাল গার্ডেন, ইমিগ্রেশন অফিসও রয়েছে। পুত্রজায়া আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের একটু সামনে লেকের ওপর ব্রিজ। এখানে কেউ এসে দাঁড়ালে তার সব দুঃখ-কষ্ট ঘুচবে। প্রশান্তি উপচে পড়বে। লেকের পানিতে ভাসমান পুত্র মসজিদ, পেছনে দৃষ্টিনন্দন পুত্রজায়া সম্মেলন কেন্দ্র, সামনে সরলরেখাকৃতি পার্কসদৃশ সড়ক আর ডানে সমুদ্রসদৃশ লেকের অবশিষ্ট অংশ এবং তার তীরে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন স্থাপনা। পরিপাটি সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিতে পর্যটকদের ভিড় বছরজুড়েই লেগে থাকে।
খেলাধুলা প্রেমীদের জন্য পুত্রজায়ার আকর্ষণের স্থান ‘তামান অ্যাকুস্ট্রিয়ান পুত্রজায়া’। পুত্রজায়ার জনপ্রিয় বিনোদনের স্থান এটি। এখানে আধুনিক রেস্টুরেন্ট, সুইমিংপুল, টেনিস কোট, মাল্টিপারপাস হলসহ রয়েছে নানা ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থাও। রাতেও রয়েছে আকর্ষণীয় সব বিনোদন আয়োজন। সেরিওয়াসানা ব্রিজ হতে পারে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সেতুটির নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি রেখে পুরো সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ মিলবে রাতভর। এছাড়াও পুত্রজায়া লেক এড়িয়ে মসজিদ চত্বরে অবস্থিত এসকেলেটর বেয়ে নিচে নেমে ফুডকোটেও বেশকিছু সময় কাটানো যায় একান্তে। কেনাকাটার জন্য আলামান্দা পুত্রজায়ার সব থেকে প্রসিদ্ধ স্থান। ছোট শহরের এই স্থানটিতে নানা ধরনের উপকরণের পাশাপাশি মিলবে বিভিন্ন ফুলের বিপুল সমারোহ।
পের্দানা পুত্রা : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এটি। ভবনটি নির্দিষ্ট সময়ে অভ্যাগতদের জন্যও উন্মুক্ত রাখা হয়। সাধারণত সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২:৩০ মিনিট এবং দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সপ্তাহের সোম থেকে শুক্রবার চাইলেই যে কেউ প্রবেশ করতে পারবেন। তবে এখানে যে কোনো পরিচয়পত্র প্রদর্শন করে তবেই প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায়। ভিনদেশিদের জন্য পাসপোর্টই পরিচয়পত্র।
পুত্রা মসজিদ : মসজিদটি মনোরম গোলাপি বর্ণের। এখানে ১৫০০০ লোক একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। এর প্রধান মিনারটি দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ মিনার। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত মসজিদটি সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রার্থনার সময় মুসলমান বাদে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়। জানা গেছে, এই মসজিদটির অর্থায়ন করেছেন ওসামা বিন লাদেন।
পুত্রজায়া ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার : পুত্রজায়া বুলেভার্ডের শেষপ্রান্তে এই স্থাপনা। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিসের সম্মেলনের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল এটি। ভবনটিতে মালয় ঐতিহ্যের ছাপ রয়েছে, যা সব দর্শনার্থীর নজর কাড়ে।
ক্রুজ তাসিক পুত্রজায়া : প্রমোদ নৌবিহারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী ৪-৬ আসন বিশিষ্ট গন্ডলা ধাঁচের পেরাহু নৌযানে ঘুরে দেখা যায় পুত্রজায়া। ৭৬ আসন বিশিষ্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রমোদতরীও রয়েছে এখানে। যানটি বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে যাত্রাবিরতি দিয়ে পুরো পুত্রজায়া ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। ছুটির দিন হলে বাড়তি কিছু খরচ হবে। নৈশভোজের সুযোগ মিলবে নৌযানেই। এজন্য অবশ্যই বুকিং দিতে হবে।
সেরি পের্দানা : মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনিক ভবন সেরি পের্দানা। বরাবরই পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু স্থানটি। সর্বসাধারণের অবাধ যাতায়াত বন্ধ। তবে জাতীয় দিবসগুলোতে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
উইসমা পুত্রা : স্থাপনাটি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন। সেরি পের্দানায় বিধিনিষেধ আরোপের পর দর্শনার্থীরা ভিড় জমান এখানে।
স্তানা মেলাওয়াতি এবং ইস্তানা দারুল ইহসান : স্থান দুটি পর্যায়ক্রমে দেশটির রাজা এবং সেলাংগোর প্রদেশের সুলতানের বাসভবন। পর্যটকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে বিশেষ দিবসে প্রবেশ করা যায়।
ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভ : প্রবাসী দূতাবাসের জন্য বরাদ্দকৃত স্থান এটি। এই স্থান পরিদর্শন করেই অনেক পর্যটক হাতের সময়টুকু ব্যয় করেন।
পের্দানা লিডারশিপ ফাউন্ডেশন : সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রাত্যহিক কাজের জন্য বরাদ্দকৃত স্থান এটি। বর্তমানে এটি ড. মাহাথির মুহাম্মাদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হয়।
তামান পুত্রা পের্দানা : খুবই নীরব পাহাড়ের চূড়ায় বসে পুত্রা পের্দানা ভবনটি উপভোগ করা যায়। অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে কৃত্রিম ভবনের এক অসাধারণ মেলবন্ধন।
মিলেনিয়াম মনুমেন্ট : স্থানটি মালয়েশিয়ার ইতিহাসের স্মারক হয়ে রয়েছে। ভাস্কর্যটি কিছু থামের সাহায্যে ফুলের আকৃতি পেয়েছে।
পুত্রজায়া বুলেভার্ড : ১০০ মিটার চওড়া এবং ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রাজকীয় পথটি মূলত বিশেষ জাতীয় দিবসের প্যারেডের জন্য। বাকি সময় স্থানটি থাকে উন্মুক্ত। আরও আছে বোটানিক্যাল গার্ডেন। খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। ছুটির দিনে খোলা থাকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত।
আকাশচুম্বী কে এল টাওয়ারে সেলফি
কুয়ালালামপুর যাবেন, আকাশচুম্বী কে এল টাওয়ারকে নিয়ে সেলফি তুলবেন না— তা কি হয়? প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এখানে এসে সেলফি তুলছেন। সকাল থেকে রাত অব্দি জমজমাট এই আকাশচুম্বী টাওয়ার। ‘পেট্রোনাইজ টুইন টাওয়ার’ বলেও ডাকেন অনেকে। আবার ‘সেলফি জোন’ বলেও ডাকেন অনেক পর্যটক। এখানে পাওয়া যায় সেলফি স্ট্রিক ও ক্যামেরা। টাওয়ারের দুই পাশের ফোয়ারাও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। কে এল টাওয়ারে একটি ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁ ও একটি পর্যবেক্ষণ ডেক আছে। যার ওপর থেকে পুরো মালয়েশিয়া দেখা যায়। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত হাজার হাজার পর্যটককে প্রতিদিন কে এল টাওয়ার ভ্রমণ করতে দেখা যায়। সন্ধ্যার পর কে এল টাওয়ারের অন্য রূপ দেখা যায়। পুরো টাওয়ারে আলোর ঝলকানিতে দৃষ্টি কাড়ে ভ্রমণপিপাসুদের। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কে এল টাওয়ার উন্মুক্ত থাকে। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন