বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ইয়াসমিন চৌধুরী। কাজ করছেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে। বাংলাদেশের ওপর তাঁর বিশেষ নজর। বিশেষ করে পোশাক, খাদ্য ও পর্যটনশিল্প তুলে ধরছেন উন্নত দেশগুলোর মানুষের কাছে। ইংল্যান্ডে গড়ে তুলেছেন ‘লাভদেশ’। লিখেছেন নাদিম মজিদ
তৃতীয় বিশ্ব বলতে ইউরোপ-আমেরিকা বোঝে দারিদ্রের হাহাকার। ইয়াসমিনও যখন বাংলাদেশ বলতেন তখন হয়তো অস্ট্রেলীয় একজন বলতেন-ফ্লাড, ফ্লাড। খারাপ লাগত ইয়াসমিনের। ভাবতেন সরষে ইলিশ কতই না মজার, সুন্দরবনের মতো জায়গা কোন দেশে কয়টা আছে। সেই সঙ্গে তিনি বিলাতে প্রবাসী বাঙালিদের দুর্দশাও দেখতেন। তাই ভাবতে বসলেন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে গড়ে তুলতে চাইলেন একটি জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। ২০১০ সালের মার্চে প্রতিষ্ঠা করেন দাতব্য সংগঠন আমকারিজা ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশন নিয়ে কিছুদিন কাজ করার পর বুঝলেন, বাংলাদেশের সৌন্দর্যকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন আরো বড় প্ল্যাটফর্ম, যেটি শুধু বাংলাদেশের কথা বলবে না, বলবে উন্নয়নশীল অন্য দেশগুলোর কথাও। সে লক্ষ্যে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা করেন লাভদেশ। এ প্রতিষ্ঠান পোশাক, খাদ্য ও পর্যটন নিয়ে কাজ করছে। ইয়াসমিন চৌধুরী বলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বকে উন্নত বিশ্বে তুলে ধরতেই লাভদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। কাজের ক্ষেত্র হিসেবে আমরা প্রথমে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছি। আমরা দেখাচ্ছি এখানকার লোকেরা কত কত বিষয়ে পারদর্শী।’

বাংলাদেশ ভ্রমণে ইয়াসমিন চৌধুরী
ইয়াসমিন চৌধুরীর জন্ম দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনে। পড়াশোনা ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্ট মিনিস্টারে। স্নাতক হয়েছেন ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ে। ইয়াসমিন চৌধুরীর বাবা আবদুল মুকিত চৌধুরীর আদি নিবাস সিলেটের আলীনগর গ্রামে। ২০০৪ সালে তাঁর বাবা মারা যান। এ সম্পর্কে বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর ২০১০ সাল পর্যন্ত আমার জীবনে প্রচুর ঘটনা ঘটেছিল, যেগুলো আমার জীবনকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। তবু কখনো কোনো খারাপ মুহূর্তকে নিজের ওপর ছড়ি ঘোরাতে দিইনি। বাবার মতো আমিও আমার হৃদয়ভূমি বাংলাদেশের জন্য একটা কিছু করতে চেয়েছি। আর তাই লাভদেশ নিয়ে এগিয়ে আসি এবং আজ পর্যন্ত একা একাই কাজ করে যাচ্ছি। তবে বাবার উপস্থিতিটা আমার পাশে সব সময় অনুভব করি। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর আত্মার যোগ। মাঝেমধ্যেই আসতেন। সম্ভাবনার নানা দিক খুঁজতেন। ভাবতেন, এ দেশের উন্নয়নের জন্য কিছু করা যায় কি না। বললেন, এখানে যে ভালো ভালো বিষয় রয়েছে, সেগুলো তুলে ধরা দরকার। উপকরণগুলোকে সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের সামনে সাজিয়ে-গুছিয়ে তুলে ধরলেই ভালো ফল পাওয়া যাবে। আমি তা-ই করে চলেছি। আমি চাই সেসব মনমাতানো দৃশ্য ও ভালো মুহূর্তগুলোকে তুলে নিয়ে ধরতে, যেগুলো আমি প্রতিবার বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় অনুভব করে এসেছি।
ইয়াসমিন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনে সাউন্ড লাউঞ্জ ফেস্টিভালে বাংলাদেশের কাঠের চুলায় রান্না করা খাবার প্রদর্শন করেছিলেন। মে মাসে বিবিসি এশিয়ান নেটওয়ার্কের সাংবাদিক নাদিয়া আলী তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচার করেন। একই বছরের ডিসেম্বরে ‘তৃতীয় বিশ্ব ভ্রমণে চল’ শীর্ষক একটি নতুন স্লোগান নিয়ে মাঠে নামেন। প্রচারণার অংশ হিসেবে পর্যটকদের লাভদেশ আর্মি ব্রেসলেট বিতরণ করা হয়।
এ দেশে পর্যটনের প্রচারণা কিভাবে সম্প্রসারিত করা যায় তা নিয়ে ইয়াসমিনের ভাবনা হলো-এ ক্ষেত্রে জড়িত সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং সম্ভাবনার যাবতীয় দিক সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে। শিহরণ জাগাতে হবে। সেই সঙ্গে টেকসই পর্যটনের দিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশে যাতে বারবার ভ্রমণ করতে আসে এ জন্য বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহী করার তরিকাটাও শিখতে হবে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, “লাভদেশকে বিশ্বময় পরিচিত করে তুলতে চাই এবং ‘তৃতীয় বিশ্বে ভ্রমণ কর’-এ কাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।” ২০১৩ সালে জিতেছেন ফ্রিঞ্জ ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল মার্কেট অ্যাওয়ার্ড। ইয়াসমিন চৌধুরী ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ব্রিটিশ-বাংলাদেশ পাওয়ার এবং ইনস্পিরেশন লিস্টে স্থান পেয়েছেন।
লাভদেশের কাজ
স্বল্পোন্নত দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে লাভদেশ। প্রধান দপ্তর লন্ডনে। কাজের প্রধান ক্ষেত্র বাংলাদেশ।
পোশাক : তৃতীয় বিশ্বে তৈরি করা পোশাক রপ্তানি হচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে। অনেক ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ কম মজুরি পেয়ে থাকে। পোশাকসামগ্রী নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে লাভদেশ প্রচারণা চালিয়ে থাকে। বিভিন্ন দেশে বাণিজ্য মেলায় অংশ নিয়ে দরিদ্র দেশগুলো থেকে নির্মিত পোশাক প্রদর্শন করে।
খাদ্য : ব্রিটেনে বাংলাদেশি কারিশিল্পের বেশ সুনাম রয়েছে। বাংলাদেশের খাদ্য ও ভ্রমণের অভিজ্ঞতা উন্নত দেশগুলোতে জানিয়ে থাকেন ইয়াসমিন চৌধুরী।
ভ্রমণ : নদীমাতৃক বাংলাদেশের পানিতে ভ্রমণের জন্য লাভদেশ আয়োজন করে থাকে ‘লাভদেশ ভয়েজ’। শহর থেকে দূরবর্তী অঞ্চলে লাভদেশ পর্যটকদের নিয়ে থাকে। পর্যটকরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সেদিকে নজর রাখা হয়। বাংলাদেশকে উন্নত দেশগুলোতে সর্বোচ্চ ভালোভাবে উপস্থাপন করতে চান ইয়াসমিন চৌধুরী। ছুটির দিনগুলোতে তৃতীয় বিশ্বে বেড়াতে আসার অফার দিয়ে থাকেন। কাঠের আগুনে তৈরি খাবার নিয়ে উড-ফায়ার কারি নাইট আয়োজন করেন ব্রিটেনে এবং শার্টের বাইরে জামদানির মতো ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশি ফ্যাশনের পোশাকের প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। সূত্র : কালের কণ্ঠ