Skip to content

জগজাকার্তার জলকেল্লা

মঈনুস সুলতান
জগজাকার্তা শহরের দক্ষিণে ক্রাটন এলাকায় আসতে ট্যাক্সি ফেক্সির কোনো জরুরত হয় না। আমি প্রায় দুই কিলোমিটার পথ হেঁটেই এসেছি। এখানকার এট্রাকশন একটাই—সুলতান হামেনগক উবুউনোর ১৭৫৮ সালে তৈরি ওয়াটার ক্যাসোল বা জলকেল্লা। ১৮৬৭ সালের ভূমিকম্পে জলকেল্লার বিস্তর ভাঙচুর হলেও এর স্থাপত্যকলার দিকে তাকিয়ে সুলতানের যে পাশ্চাত্যের বণিকদের সাথে জবরজং দহরম মহরম চলছিল তার নমুনা পাওয়া যায়। জলকেল্লার মূল ইমারতটির নকশা করেন এক পর্তুগীজ আরকিটেক্ট। এখানে হরবকত কায়েম মোকাম ছিলেন সুলতানের মোট ২৭ জন ব্যক্তিগত নারী। একসময় এখানে কিসতি বেয়ে পরিখা অতিক্রম করে আসতে হতো। সে জামানা আর নেই, গড়খাইও শুকিয়ে গেছে অনেককাল, এখন পয়দলে দিব্যি ঢুকে পড়া যায় কেল্লার অন্দরমহলে। জলকেল্লার পোষাকি নাম হচ্ছে ‘তামানসারি বা পারফিউম গার্ডেন।’ সে আমলের ‘পুল-কঙ্গো’ বলে একটি বুড়ো বিরিক্ষ এখনো দায়েম আছে। আর তার ঝরা পাপড়ির উপর দাঁড়িয়ে আমি সৌরভে সতেজ হতে হতে ভাবি—যখন এখানে এ ধরনের অনেকগুলো বিরিক্ষ ছিল, তখন এ বাগিচার পরিবেশ বিকালের অস্তরাগে কাহাতক খুশবুদার হতে পারত?

Jalkella

জলকেল্লার পয়লা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পরস্পরের সাথে গড়খাই দিয়ে যুক্ত অনেকগুলো বাঁধানো জলাশয়। বাগিচার এ কনসেপ্ট ওয়াটার গার্ডেন বলে পরিচিত। আমি এ ধরনের একটি জলাশয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এ মুহূর্তে তার থির জলে আসমানের প্রতিফলন দেখছি। এক জামানায় এখানে ভাসত শাপলা শালুক, ফুটত পদ্মফুল, আর অবগাহন করতেন সুলতানের একাধিক নারী। তিনিও কিসতি বেয়ে চড়ে বেড়াতেন জলে। আর মর্জি হলে কোনো নারীর দিকে ছুড়ে দিতেন আধফোঁটা পদ্ম। এ পুষ্প নিক্ষেপ ছিল নিশীথে ‘হাবুনগান’ বা শরীরি ভালোবাসার সংকেতের মতো।

একসময় আমি সাউথইস্ট এশিয়ায় রীতিমতো কায়েম মোকাম ছিলাম। তখন মাঝেসাজে ইন্দোনেশিয়ায় আসতে হতো। আর জগজাকার্তা শহরে এসে বারকয়েক জলকেল্লায় অল্প স্বল্প সফরও করেছি। জল-বাগানের ডিজাইন আমাকে অ্যাট্রাক্ট করত। আজ অনেকদিন পর এখানে আসলাম সমপূর্ণ ভিন্ন কারণে। উথামা আব্দুর রহমানকে এক নজর দেখার কৌতূহল আমাকে আবার জলকেল্লায় নিয়ে আসলো। উতামা সম্পর্কে যা শুনেছি তাতে মনে হয় তিনি সুলতানি বংশের এক অধঃস্তন পুরুষ। একসময় ডাকসাঁইটে প্রশাসক ছিলেন। বয়স তাঁর তেমন হয়নি, তবে তিনি রিটায়ার করেছেন না চাকুরীচ্যুত হয়েছেন বলা মুশকিল। অনেক বছর হলো তিনি জলকেল্লার প্রাঙ্গণে আওয়ারা ঘুরে বেড়ান। মাঝে মাঝে জনান্তিকে ভবিষ্যত্বাণীও করেন। তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে অনেকেরই সন্দেহ আছে। তবে তাঁর কিছু কিছু ভবিষ্যদ্বাণী পরবর্তীকালে হুবহু মিলে গেলে তাঁকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায়ও লেখালেখি হয়েছে। এসব কিছু আমি লোকমুখে শুনেছি। বিষয় যে সম্পূর্ণ সত্য—এ বাবদে কোনো প্রমাণদির আমি তালাশ পাইনি। তবে কৌতূহলী হয়েছি।

উথামা সাহেবের সন্ধানে আমি জলকেল্লার ভেতরের কোর্টইয়ার্ডের দিকে পা বাড়াই। এখানকার একটি ত্রিকোণাকৃতির দেউড়িতে চুনসুরকির পলেস্তরায় খোদাই করে আঁকা রক্ষস খোক্ষসের মুখ ব্যাদান করা চিত্র। আমার জানাশোনা ইন্দোনেশিয়ানদের মুখে শুনেছি, উথামা সাহেব বিকালবেলা এখানে লোকজনদের সাথে কথাবার্তা বলেন। আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে এখানে দাঁড়িয়ে উথামা সাহেব হঠাত্ হু হু করে কেঁদে উঠেছিলেন। ইন্দোনেশিয়ায় যে জোর আন্দোলন হবে, এবং তাতে পুলিশি গুলিতে খুন জখম হবে বিস্তর আমজনতা—এ ভবিষ্যত্বাণীর সাথে সাথেই উথামা সাহেব নাকি খোদ রাষ্ট্রপতি সুহার্তোর পতনের সন তারিখ সঠিকভাবে বলে দিয়ে দিয়েছিলেন!

জগজাকার্তা শহরে আমার জনাশোনা জনাতিনেক মানুষ আছেন। এদের একজনের সাথে আমি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসে বছর কয়েক সতীর্থ ছিলাম। অন্য দুজনের সাথে অতীতে কাজের সূত্রে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। গতকাল তাদের সকলের সাথে একটি রেস্তোরাঁয় আমাদের রিইউনিওনের মতো হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে আমি উথামা আব্দুর রহমান সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। আমার সুহূদদের একজন বলেছেন—তাঁর বিষয় আশয় ও আচরণ আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক মনে হলেও ঊথামা সাহেবের কথাবার্তায় চিন্তার খোরাক আছে। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী যে ফলেছে এ ঘটনাটি সত্য। এ রকম ঘটেছেও একাধিকবার। সুতরাং এ বিষয়টিকে আর গুজব বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। একই আসরে আমার অন্য সুহূদ মন্তব্য করেছেন, উথামা সাহেব আচরণে উলুল ঝুলুল হলেও ভেতরে খুবই ডিগনিফাইড। নিঃসন্দেহে তিনি শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ।

তামানসারির দেউড়িতে উথামা সাহেবকে না পেয়ে আমি চলে আসি ‘উমবুল বিনানগুন’ বলে একসময়ের ফোয়ারার জল ঝরঝর জলাশয়ে। এ পুকুরের জল খানিকটা সবুজ হয়ে আছে। অনেক বছর হয় এখানে ফোটে না কোনো শাপলা বা পদ্ম, ভাসে না কৃত্রিম কোনো কচুরিপানা। কিন্তু এদিকে দাঁড়িয়ে আমি আনমনা হওয়ার অবকাশ পাই না একেবারে। এখানে আরেকটি প্রাচীন আমলের পুলে-কঙ্গো বিরিক্ষির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন জনাব উথামা। তাঁর নিপাট করে কামানো দাড়ি। চমত্কার একটি বাটিকের ফুলশার্টের সাথে মাথায় কালো টুপি পরেছেন বলে চোখে ভারী লেন্সের চশমায় তাঁকে একটু রাশভারী দেখায়। শেষ বিকালের রোদে তিনি মহিষের চামড়া কেটে তৈরি শ্যাডো পাপেটের ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। বার কয়েক পাপেটকে নানা প্রেক্ষিতে দাঁড় করিয়ে মনোযোগ দিয়ে ছায়ার মাপজোখ করে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলে আমি ‘সালামত্ সিয়াং বা গুড আফটারনুন’ বলি। যেন আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন এ রকমের সহবতে তিনি উঠে আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আপা খাবর বা আপনার খবর কী?’ আমি ‘খাবর বাইক বা সংবাদ ভালো’ বলি, তবে সম্মানার্থে তাঁর নামের সাথে ‘পাক’ শব্দটি ব্যবহার করে আরজ করি—যদি পাক উথামা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেন। উথামা সাহেব মাথা নেতিবাচকভাবে ঝাঁকিয়ে আসমানের দিকে পাপেটটি তুলে বলেন, ছায়ার মাপজোখে ঠিক মিলছে না, আজ আর মেঘমালার ওপার থেকে আসবে না কোনো সঠিক সংবাদ!

পাক উথামার সাথে আস্তে ধীরে হেঁটে চলে আসি আঙিনায়। একসময় গড়খাইয়ের রুপালি জলে চকমিলান এ অঙ্গন ভাসত এক চিলতে ডাঙার মতো। এখানে হররোজ সন্ধ্যাবেলা বসতো ধ্রপদী ঘরানার ‘সিরিমপি’ নৃত্যের জলসা। সে আমল গুজরে গেলেও এখনো পালাপার্বণে এখানে নাচ হয়। বছর পনেরো আগে আমি এখানে একদিন সন্ধ্যাবেলা ‘সিরিমপি’ নৃত্যের লাইভ পারফরমেন্স দেখেছিলাম। সে নৃত্যের মাঝে এমন একধরনের দরবারি পরিশীলন ছিল যে, অনেকবছর পর তা মনে পড়তেই স্মৃতির আবছা আঙিনা থেকে আমার সচেতনতায় ছড়ায় একধরনের এলিগেন্ট আভা। সিরিমপি নৃত্যের মুভমেন্টগুলো পরিকল্পিত হয় মৃদু লয়ে, শিল্পীর হাতের কারুকাজ ও দৈহিক দ্যোতনা ধুন ধরে চেয়ে দেখার মতো। এর নাজুক মুদ্রা এমন একধরনের মহিমা ছড়ায় যে, ঔপনিবেশিক জামানায় পাশ্চাত্য থেকে জগজাকার্তায় আগত এক বিখ্যাত বোদ্ধা এ ঘরানার নৃত্যকে অভিহিত করেছিলেন ‘এবসোলিউটলি গ্রেইসফুল’ বলে। অনেক বছর পর আবার তামানসারিতে ফিরে এসেছি। আবারও ইচ্ছা হচ্ছে এখানে কাটাই একটি সন্ধ্যা। মনোযোগ দিয়ে আবার দেখি সিরিমপি নৃত্যবিন্যাস।

পাক উথামা সাহেব কিছু বলছেন না। তিনি ধুন ধরে চেয়ে আছেন শ্যাডো পাপেটের দিকে। আমার ক্লান্ত লাগে, তাই বসে পড়ি তাঁর কাছাকাছি নোনা ধরা একটি সুনসুরকির বেঞ্চে। আর বহুকাল পর অসময়ে বৃষ্টির মতো ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে স্মৃতির জল। চোখের সামনে যেন যুগল নাচিয়ের জোড়া দেহ গামেলিওয়ন বলে একধরনের সমবেত বাদ্যে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নলোকে। আবার অনুভব করি সিরিমপি নৃত্যের মেডিটেটিভ কোয়ালিটি—যা আমার মনে তৈরি করে একধরনের আধ্যাত্মিক প্রতিবেশ। কেবলই মনে হয় কোথায় যেন নূড়িপাথর ভিজিয়ে ঝরঝরিয়ে ঝরছে ঝরনাজল।

Jalkella2

পাক উথামা আমার দিকে ফিরে তাঁর কালো টুপি অ্যাডজাস্ট করে খানিক বিষণ্ন হয়ে বলেন—কয়েক বছর আগে এ প্রাঙ্গণে শ্যাডো পাপেটের ছায়ার মাপজোখ মলে গিয়েছিল। তারপর খানিক নির্জনতার জন্য তিনি জলকেল্লার উপরের স্তরে যেখানে এক জামানায় সুলতানের মেডিটেশনের হুজরা ছিল ওখানে উঠে যান। নিশ্চুপ বসে থেকে তাঁর ঝিমানির মতো এসেছিল। তখনই জরুরি সংবাদ আসে স্বপ্নে। তিনি দেখতে পান দরিয়ার পানি জাহাজ নৌকা সব ডুবিয়ে ছুটে আসছে ডাঙায়, আর সয়লাবে ডুবে যাচ্ছে জনপদ। ওই দিন সন্ধ্যায় ইন্তেজাম হয়েছিল সিরাপমি নৃত্যের। সমবেত দর্শকদের পাক উথামা জোড় হাতে বলেছিলেন, ‘হুঁশিয়ার হও মানুষ, সমুদ্র আসছে, সুনামির সয়লাব থেকে নিস্তার পাবে না কিন্তু।’ দর্শকরা তার কথায় মৃদু হেসেছিল।

পাক উথামা অবশেষে আমাকে নিয়ে আসেন সুলতানের মেডিটেশনের হুজরায়। বরুজের মতো ছোট্ট এ কুঠুরির ছাদ ধ্বসে, পলেস্তরা খসে ভাঙচুরে বর্তমানে বেহাল। পাক উথামা ফিসফিস করে বলেন, ধ্রপদী নৃত্য আর জলাশয়ে ভাসমান কিসতি এসব ছিল জলকেল্লার বাইরের রূপ। অনেকটা নাটকের সেট-আপের মতো। কিন্তু গভীর গোপনে সুলতান এখানে ধ্যানে বসে পেয়ে যেতেন মেঘমালার ওপার থেকে আসা সব সংবাদ। এ পর্যন্ত বলে ঝরোকার পাশে দাঁড়িয়ে পাক উথামা আবার আসমানের দিকে তুলে ধরেন তার শ্যাডো পাপেট।

পাক উথামা অনেক্ষণ ধরে নির্বাক হয়ে আছেন। আমার ভারি বেচইন লাগে। একসময় তাঁকে আমি বিদায় জানাই। তিনি কোনো জবাব দেন না। আস্তে ধীরে হেঁটে চলে আসি উমবুল বিনানগুন বলে জলাশয়ের দিকে। দুটি ছোট্ট ছেলেমেয়ে, পাশ্চত্যের কোনো দেশ থেকে জগজাকার্তায় বেড়াতে আসা পর্যটক জুটির পুত্রকন্যা সিরিমপি নাচের পোশাক পরে পুকুরের সবুজ জলে তাদের ছায়া দেখছে। খানিক দূরে তাদের পিতামাতা ফেরিওয়ালার সওদাপাতি যাচাই করছেন। শ্বেতাঙ্গ শিশু দুটির গায়ে সিরিমপি নাচের পোশাক খুব কিউট দেখাচ্ছে। ভাবি, পর্যটক দম্পতির অনুমতি নিয়ে তাদের ছবি তুলব। তখনই হই হই, রই রই শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই। দেখি পাক উথামা সাহেব স্থানীয় জবানে কিছু বলতে বলতে পড়িমড়ি ছুটছেন। তাঁর পেছন পেছন ইন্দোনেশিয়ার জনা কয়েক আম জনতা। তারাও রীতিমতো দৌড়াচ্ছেন। এত দৌড়ঝাঁপের ভেতরও পাক উথামা আমাকে খেয়াল করেন। তিনি আমার দিকে চেয়ে এক হাতে হাইপাওয়ারের চশমা অ্যাডজাস্ট করতে করতে চেঁচিয়ে বলেন, ‘দেমাম দেমাম’। ঘটনা কী? ‘দেমাম’ শব্দটির অর্থ আমি বুঝতে পারি না, তাই জানতে চাই। পাশ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে একজন দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তর্জমা করেন ‘ফায়ার ফায়ার।’ তাঁর চোখমুখ দেখে মনে হয় তিনি আমাকে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছেন। ঠিক বুঝতে পারি না, কোথায় আগুন লেগেছে কিংবা ভবিষ্যতে লাগতে পারে? এবং এতে আমার জ্বলাপোড়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না? পাক উথামা জলবাগানের চারপাশে এমন অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করেন যে—তাতে রামায়ণের পালায় হনুমানের লেংগুড়ে আগুন লাগার দৃশ্যের কথা মনে আসে।

উথামা সাহেবের সাথে আমার মিথস্ক্রিয়া কোনো যৌক্তিক উপসংহারে আসে না। খানিক অতৃপ্তি নিয়ে একসময় ফিরে আসি গেস্ট হাউসে। দিন তিনেক পর ফ্লাই করে জগজাকার্তা থেকে বেরিয়ে আসার সময় প্লেনে পাইলট ঘোষণা করেন—ঘণ্টা দুয়েক আগে মাউন্ট মিরাপি নামক আগ্নেয়গিরিতে অগ্নি উদগীরণের কথা। পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসছে কিছু লাভা, প্রচুর ধোঁয়া ও ছাইভস্ম। তাই বিমানটি আজ একটু ঘুর পথে উড়বে ব্যাংককের দিকে। সূত্র : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *