মো. মনির হোসেন
কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিল হাওর নিয়ে; হাওরের সৌন্দর্য, জ্যোৎস্না বিলাস, হিজল বাগান নিয়ে। যেই হিজল ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন- ‘পিছল পথে কুড়িয়ে পেলাম হিজল ফুলের মালা/কি করি এ মালা নিয়ে বল চিকন কালা।’ হাওর বিষয়ে বহুমাত্রিক গল্প শুনে শুনে আমিও হাওরে যাওয়ার নেশায় ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। শুরু করলাম দল গোছানোর কাজ। আমার মতো ভ্রমণপাগল আরো কয়েকজন পেয়ে গেলাম। বাহন মাইক্রোবাস। ১০ সেপ্টেম্বর সকালে গাজীপুর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। সাড়ে ১১টায় পৌঁছে গেলাম কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার চামড়া বন্দরে। সেখান থেকে দুই হাজার টাকায় একটি ট্রলার ভাড়া করলাম সারা দিনের জন্য। মাঝির সঙ্গে পাকা কথা বলে নিলাম-আমরা ইটনা, মিঠামইন, গোপদীঘি যাব।
শুরু হলো আমাদের হাওরযাত্রা। চামড়ার ঘাট হাওর পাড়ি দিয়ে আমরা চলে গেলাম ঘোড়াউত্রা নদীতে। নদীতে জাহাজ চলছে। মাঝে মাঝে ঘোমটা দেওয়া শুশুক পানির নিচ থেকে ওপরে উঠে জানান দিচ্ছে এটা ঘোড়াউত্রা নদী ও এর গভীরতাও অনেক। বর্ষাকালে বড় হাওরে নৌকা ভাসালে মনে হয় অকূল দরিয়া পার হতে হচ্ছে। কূল নাই কিনার নাই, শুধু অশান্ত ঊর্মিমালা ওঠানামা করছে বিরামহীন। সকালে যখন সূর্য ওঠে, তখন এই ঢেউয়ের ছন্দদোলায় মনে হবে রক্তলাল সূর্য একবার পানির নিচে ডুবছে, আবার ভেসে উঠছে। বর্ষাকালে হাওরের রূপ অন্যরকম। চারদিকে কেবল পানি আর পানি, মাঝে মাঝে পানির ওপর ভাসমান দ্বীপ গ্রাম। আর ভাসমান গ্রামের ওই বাড়িগুলোকে আমি নাম দিয়েছি ‘জলবাড়ি’। বর্ষাকালে হাওর এলাকায় নৌকায় উঠে যেকোনো একদিকে রওনা দিলে অনেকটা আকাশে বিমান নিয়ে ঘোরাফেরার মতো মনে হয়।
হাওর ভ্রমণে লাভ শুধু আনন্দেই নয়, এতে শিকড়েরও সন্ধান মেলে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হাওর কোনো স্থায়ী জলাশয় বা জলাধার নয়। বর্ষায় যেখানে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি, শুষ্ক মৌসুমে সেখানেই মাইলের পর মাইল চোখজুড়ানো সবুজ ধানের ক্ষেত। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে, ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও, এইডাই উজানবাডির বাও’। হাওরের পরিধি নিয়ে মতান্তর রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৮০ লাখ হেক্টর ভূমিতে হাওরের অবস্থান। আবার অনেকে বলেন, এর চেয়েও বেশি। মতান্তরে প্রায় এক কোটি হেক্টর ভূমিতে হাওর বিস্তৃত। কিশোরগঞ্জে ১২২টি হাওর রয়েছে। কিশোরগঞ্জের অপরূপ সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠতে পারে একটি পর্যটনকেন্দ্র।
হাওরের পানির অন্যতম আকর্ষণ হিজলগাছ। মিঠামইন উপজেলার বিভিন্ন হাওরে হিজলগাছ বা হিজলগাছের বাগান দেখা যায়।
ঘোড়াউত্রা নদী পাড়ি দিতেই আমরা ভাসলাম গোপদীঘি হাওরে। মাঝেমধ্যে দ্বীপগ্রাম আর ভাসমান হিজল বাগান মনকে অন্যরকম আনন্দ দিতে শুরু করল। হিজলের লম্বা ডাঁটায় গোলাপি রঙের অসংখ্য ফুল ঝুলন্ত অবস্থায় ফোটে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুল ফোটা শুরু হয়। সকালের আলোয় ঝরে যায়। হিজলতলায় সকালে গেলে মনে হবে গোলাপি বিছানা পাতা। হিজলতলার কাছে কিংবা দূর থেকেও এর মাদকতাপূর্ণ মিষ্টি ঘ্রাণে মাতাল হয় আশপাশ।
হিজল বাগান দেখতে দেখতে চামড়া ঘাট থেকে রওনা করার এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম গোপদীঘি বাজারে। বাজার ঘাটে বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার হাসিবুর রহমান ও তাঁর সহধর্মিণীসহ কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের আপ্যায়ন করার জন্য। তাঁদের বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজ শেষে আমাদের নৌকা ভাসালাম ডুফির হাওরে। এই হাওর পাড়ি দিয়ে গেলাম ঐতিহাসিক কামালপুর গ্রামে। ঐতিহাসিক বলার কারণ, এটাই হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেটের বাড়ি। আমাদের কথা শুনে রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের অনুজ বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক নুরুও চলে এলেন কলেজ থেকে। তিনি স্থানীয় কলেজের অধ্যক্ষ। তিনিও আমাদের সঙ্গে চা আড্ডায় মেতে উঠলেন। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ