Skip to content

জল-জঙ্গলের সুন্দরবনে…

রাকিব কিশোর
বাংলাদেশের যে জায়গাটাতে সবুজের দল কখনো বুড়ো হয় না, যেখানে সারাটা দিন উড়ে উড়েও একটুও ময়লা হয় না শুভ্র বকের গায়ের পালক, যেখানে পাতার ফাঁকে ফাঁকে চোখ রেখে মায়ের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে দুষ্টু বানরের দল, সেই জায়গাটার নাম সুন্দরবন। আলো-আঁধারির শ্বাসমূলের এই বনে চার পায়ে হাঁটা বাঘের সঙ্গে প্রতিদিনই টেক্কা দেয় চিত্রা হরিণের ঝাঁক, জোয়ার-ভাটার এই বনে লুকিয়ে চলা শূকরের পাল ধরতে নাক ডুবিয়ে বসে থাকে ধূসর কুমিরের ছোট্ট ছানাটা আর এলোচুলে খোঁপা বেঁধে কোমল বাতাসে দুলতে থাকে বনের গাছেরা, তাদের ডালে ডালে চলে সাপের আনাগোনা। সুন্দরবনকে বলা হয় ভয়ংকর সুন্দর একটা জায়গা—যেখানে যেতে হয় শরীরের সবগুলো ইন্দ্রিয়কে জাগিয়ে নিয়ে, চলতে হয় তুমুল টেনশন আর কৌতূহলে দৌড়াতে থাকা শরীরের গরম রক্তকণাকে বুকে নিয়ে। বাঘ-হরিণের এই বনে আকর্ষণ যেমন আছে, তেমনি আছে বিস্ময় আর চোখ জুড়ানো ভালোবাসা। এই বনে ঢুকতে হলে বন বিভাগ থেকে বিশেষ ধরনের পাস নিতে হয়, যে-কেউ যখন ইচ্ছা মন চাইলেই এখানে ঢুকে পড়তে পারে না। তবে মাঝেমধ্যে বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান থাকলে বনে প্রবেশ করা যায়। এর মধ্যে একটি হলো রাসমেলা।

Sundarban3

রাসমেলা মূলত অনুষ্ঠিত হয় সুন্দরবনের সাগরঘেঁষা দুবলারচরে। এই চরটা খুব মজার। এখানে বছরের ছয় মাস থই থই পানি থাকে, আর ছয় মাস থাকে শুকনো বালুচর। স্থানীয় জেলেরা ওই ছয় মাসে এখানে এসে মাছের শুঁটকি বানায়। সুন্দরবনের নীলকমল বন ফাঁড়ির পরেই সাগর পাড়ি দিয়ে দুবলারচরের অবস্থান।

গেল বছর এই রাসমেলার কারণেই আমাদের সুযোগ হয়েছিল বনের একেবারে ভেতর দিয়ে ট্রলার নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর। সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ থেকে ২০ জনের এক বিশাল লটবহরসহ চকচকে নতুন এক ট্রলার নিয়ে আমরা ঢুকে পড়েছিলাম বেঙ্গল টাইগারের রাজত্বে। সারা দিন নৌকার ওপরে চুপচাপ বসে থাকব, সে উপায় নেই এই অরণ্যে। ডান পাশে শিং বাগানো এক হরিণ দেখা যায় তো বাঁ পাশে অবাক হয়ে উঁকি দিতে থাকে শূকরের দল, তাদের দিকে ক্যামেরা তাক করতে করতেই ঘোলা নোনা পানি ঠেলে দিনের রোদে গা গরম করতে পাড়ে উঠে আসে বুড়ো কুমিরটা।

বিস্ময়ের ঘোর দুপ করে কেটে যায় বানরের গাছ ঝাপটানোতে, আর ঠিক দুই হাত দূরত্বেই জ্ঞানী ভাব নিয়ে বসে আমাদের দেখে নানা রঙের মাছরাঙা। সারা দুনিয়ার মানুষকে অবাক করা রহস্যঘেরা এই সুন্দরবন কখনোই আমাদের একা থাকতে দেয়নি, কখনো সাপ দেখে চিৎকার করে উঠেছি, আবার কখনো হরিণের বাচ্চা দেখে খুব আদুরে মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। কখনো বানর থেকে নিজেরাই বাঁদরামিতে লাফিয়ে বেড়িয়েছি, আবার কখনো শুশুক দেখে চোখে দুরবিন লাগিয়ে আরও ভালো মতন বোঝার চেষ্টা করেছি যে আসলেই জিনিসটা কী। টানা তিন দিনের এই নৌকাভ্রমণে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল কয়েক শ সাদা বক আর নাম না জানা রঙিন পাখির দল।

Sundarban16

দিনের সুন্দরবন যতটা প্রাণবন্ত, রাতের সুন্দরবন যেন তার চেয়েও চাকচিক্যময় জৌলুশে ভরপুর। তারা ভর্তি আকাশের নিচে যখন শুয়ে শুয়ে তারা গোনার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা, ঠিক তখনই সবটুকু মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে জোনাকিরা। জীবনে যে জিনিস কখনো দেখিনি সেই অদ্ভুত জিনিসই দেখাল আমাদের তারা।

সবগুলো জোনাকি একটা নির্দিষ্ট গাছের পাতায় বসে মিটমিট করছে, এরপরের দুইটা গাছ পুরো অন্ধকার তিন নম্বর গাছটাতে আবার জোনাকির আসর বসেছে, পরের দুইটা গাছে তাদের কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু পরের তিন নম্বর গাছে আবার জমেছে তাদের আলোর আসর। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকগুলো ক্রিসমাস ট্রি শুধু জ্বলছে আর নিভছে।

ভোরবেলাতে নীলকমল বন বিভাগের অফিসে নেমেই পেলাম বাঘের দেখা, দুটো শূকরকে দিগ্বিদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে বনের রাজা। সেই দৃশ্য দেখার মতন পরিস্থিতিতে আমরা নেই, যে যার মতন পড়িমরি করে জান বাঁচাতে ছুটে গেলাম ওয়াচ টাওয়ারে, সেখান থেকেই সবাইকে মুগ্ধ করে দিল সকালের কুয়াশার চাদর মোড়ানো অপার্থিব সুন্দরবন।

দুবলারচরে যখন পৌঁছালাম তখন মাঝদুপুর। রাতে জমবে মেলার নাচ-গান, সুতরাং আয়োজন শুরু হয়ে গেছে সকাল থেকেই। বৈশাখী মেলার মতন স্টল বসেছে কয়েক শ! রাতে শুরু হলো গানের আসর, সে আসরে তাল মেলালাম শহর ফেরত আমরা কিছু তরুণ। এই চরে রাতের জ্যোৎস্না ছিল অপূর্ব, পুরো সাগরজুড়ে ছিল সেই পূর্ণিমার চাঁদের আনাগোনা, যার আলো ছড়ানো ছিল ভোরের সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত।

Sundarban17দুবলারচরের সমুদ্রসৈকতটা একেবারে নিরিবিলি আর ঝকঝকে নরম এক সৈকত, এখানে যত দূর চোখ পড়ে সব নারকেলগাছের সারি আর বালুর ডিবি দিয়ে ঘেরা সমুদ্রের পাড়। আর সেই পাড়ের ধার ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে শুটকিপল্লি। পুরো দ্বীপের বাতাস শুঁটকি মাছের গন্ধে ভারী। সঙ্গে সেই শুঁটকি খাবার জন্য জন্য জমেছে পাখিদের মেলাও।

যদি সুন্দরবনকে পরিপূর্ণভাবে দেখতে চান তাহলে রাসমেলা ভালো সুযোগ। কেননা এখানে যেতে হলে সুন্দরবনের মাঝ দিয়েই যেতে হবে। এবারও নভেম্বরের ২৪ ও ২৫ তারিখে সুন্দরবনে রাসমেলা অনুষ্ঠিত হবে। সাজানো হচ্ছে দুবলারচর, নতুন অতিথিদের চমকে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত চমকের ভান্ডার আমাদের সুন্দরবন।

যেভাবে যাবেন
রাসমেলায় যাওয়ার দুটি রাস্তা। প্রথমটি হলো সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ থেকে নীলকমল হয়ে দুবলারচর। এবং আরেকটি হলো মংলা হয়ে কটকা সৈকত ফেলে দুবলারচর। রাসমেলার মৌসুমে প্রচুর নৌকা ও ট্রলার এখন দুবলাতে যাচ্ছে। আপনাকে প্রথমেই বনে ঢোকার পাস নিয়ে নিতে হবে, সঙ্গে যে ট্রলারে যাচ্ছেন তার জন্য অতিরিক্ত পাস নিতে হবে। পুরো ট্রলার রিজার্ভ নিলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। কাজেই সুন্দরবনে একটা দল হিসেবে যাওয়াটা অনেক বুদ্ধিমানের কাজ। কেননা কিছু সৌন্দর্য আছে যেগুলো কখনো একা দেখতে হয় না, সৌন্দর্য সবাইকে নিয়ে দেখতে হয়।

Sundarban15

টানা তিন দিনের ট্রলার জার্নিতে দিনে ঘুমালেও রাতে চেষ্টা করবেন না ঘুমিয়ে থাকতে। কারণ সুন্দরবন রাতের বেলাতেই জেগে ওঠে। এর তারাভরা আকাশ এক কথায় অপূর্ব।

ভালো কথা, দুবলারচলে কোনো মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই, কাজেই পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই সেখানে যাবেন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো বনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় উচ্চস্বরে মাইক বাজাবেন না, এতে করে পশুপাখিদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। বনে অপচনশীল কিছু ফেলবেন না। বাঘের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করবেন না। সৌজন্যে : প্রথম আলো

Sundarban-Website

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *