Skip to content

জল-ঝরনার বান্দরবানে…

রাকিব কিশোর
এবারে হুট করেই ছুটি মিলল দুই দিনের, সঙ্গে শুক্র-শনি মিলিয়ে মোট চার দিনের মামলা। ঠিক করি বান্দরবান যাব। কথায় বলে, লোভে একলা পড়া ভালো না, আরও দশজনকে নিয়ে পড়তে হয়। আমি দশজন পেলাম না, পেলাম একজনকে। লালমনিরহাটের নাসিরুল আলম মণ্ডল, তাঁকে বললাম, ‘আমি যামু, তুমি যাইবা?’ কই যাব, কোথায় যাব—এসব প্রশ্ন না করেই সে জানিয়ে দিল, যাবে।

চট্টগ্রাম বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারে বাস ওঠার আগেই দেখি, রাস্তা আগলে একজন দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর নাম নাহিদ ভুঁইয়া। বান্দরবানে তিনি চেনেন না এমন কোনো জায়গা নেই। সব পাড়াতে তাঁর আত্মীয়তা। চলতে চলতেই তিনি বললেন, পাহাড়ের মাথায় গিয়া কী করবেন, ‘চলেন, ঝরনা দেখতে যাই, গোপন ঝরনা, কেউ জানে না এইগুলার খবর!’ আমার আর মণ্ডলের সকালের ঘুম তখন রাতের আঁধারের মতোই ফুড়ুৎ করে হারিয়ে গেছে। চোখে তখন মেঘে ঘেরা ঠান্ডা ঝরনা দুলছে।

Bandarban

রুমা বাজারে একটুও সময় নষ্ট না করে আমরা উঠে গেলাম ইডেন পাড়ার পাহাড় বেয়ে, গন্তব্য মংপ্রু পাড়া। নাহিদ ভাইয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, মংপ্রু পাড়ায় যাওয়ার আগেই বাঁ দিকে পাহাড়ের নিচে একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে বয়ে চলেছে কয়েকটি ঝরনা, সেগুলোতে গিয়ে শরীর জুড়াব আমরা। ভরদুপুরে মাথা ফাটা রোদের মাঝে পাহাড় বাওয়া যে কী পরিমাণ অমানুষিক যন্ত্রণার কাজ, সেটা বোঝানোর মতো ভাষা এখনো আমি রপ্ত করতে পারিনি। সামনে যত দূর পথ যায় খালি খাড়া পথ, পিঠের ছোটখাটো ব্যাগটাও তখন মনে হচ্ছে আস্ত একটা পাহাড়। ঘাম ঝরে পড়ছে শরীরের ইঞ্চি ইঞ্চি বেয়ে। সঙ্গে করে নিয়ে আসা দুই বোতল পানি তখন সোনার চেয়েও দামি। কাঁচা আমের বাগান পেরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমরা যখন সহ্যের শেষ সীমায়, তখন বাঁ পাশে উঁকি দিল অনিন্দ্য সুন্দর টেবিল পাহাড়। এই পাহাড়ের চূড়াটা একেবারে ডাইনিং টেবিলের মতো সমান, তার ওপাশে সিপ্পির চূড়া। সিপ্পিতে যাওয়ার জঙ্গলটা নাকি খুব সুন্দর, হয়তো যাব একদিন সেখানে।

দুই পাহাড়ের চূড়া দেখে একরাশ আনন্দ নিয়ে আমাদের সামনের পথের দিকে যেই তাকালাম, অমনি যাবতীয় আনন্দ চুপসে গেল, উঠতে হবে আরও খাড়া পথ! ওপরে ওঠার একটা লাভ আছে, সেটা হলো ঠান্ডা বাতাস পাওয়া যায়, সেই লোভে আর সব কষ্টকে ঠেলে ফেলে উঠতে লাগলাম। দুই মিনিট উঠি তো ২০ মিনিট বিশ্রাম নেই—এমন অবস্থা আমাদের! একসময় হঠাৎ করে নামা শুরু করল সামনের পথ। সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকল তার চারপাশের সব দৃশ্যপট। এক পাশে কাশফুল, অন্য পাশে ঘাসফুল নিয়ে সেই পথ আমাদের নামিয়ে দিল একেবারে পাহাড়ের গোড়ায়। সেখানে এলোমেলো পাথর পড়ে আছে, মনে হচ্ছে কোনো এক মহাযুদ্ধ হয়েছিল এদিকে। ভাঙা পাথর, জুমের খেত, ফলবাগান, কৃষ্ণচূড়ার জঙ্গল—সব পেরিয়ে একসময় ভরদুপুরে ঝুপ করে আঁধার নামিয়ে দিল আকাশ সমান গাছের দল।

নাম না জানা এই গাছের পাতায় পাতায় বাতাসের টান, সেই টান আর পাখির গান ছাড়িয়ে আমাদের কান পেল নতুন এক প্রাণের শব্দ, অনেক অনেক পরিচিত এই শব্দ মুহূর্তেই ক্লান্তি দূর করে দিল, শরীরের সব কয়টা ব্যথাওয়ালা পেশি আনন্দে যেন নেচে উঠল। জঙ্গল, ঘাস, গাছ, লতা মাড়িয়ে ছুটে চললাম পানির উৎসের দিকে। পথে পড়ল এক পাহাড়ি পাড়া। অনেকগুলো ঘর আর নানান ফলবাগানে সাজানো এই পাড়ার নাম সানাক্র পাড়া। এখানকার একজনের কাছে জানতে চাইলাম, সামনে ঝরনা আছে নাকি, জবাবে তিনি যেদিকে হাত তুললেন সেদিকে ঘন জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই নেই। পাহাড়িরা ভুল করে না, এই তত্ত্বকে মেনে নিয়ে ফলবাগান মাড়ালাম, ফুলবাগান ছাড়ালাম, নাহিদ ভাইয়ের জিপিএস বলছে, আমরা ঠিক রাস্তাতেই যাচ্ছি। অবশেষে মিনিট দশেক হেঁটে পেলাম তাকে। দুই পাশে দুই বিশাল পাহাড়কে পাহারায় রেখে পাথুরে পথে জলের ধারা দিচ্ছে এই ঝরনা। কয়েক শ ফুট লম্বা অমসৃণ পাথরের ওপর দিয়ে ঝিরিঝিরি শব্দ তুলে কই যে ছুটে যাচ্ছে কেউ জানে না। দেখেই মনে হচ্ছে বরফ শীতল ঠান্ডা পানি! এতক্ষণ ধরে রোদে লাল হয়ে যাওয়া তিনজনের কাছে এর চাইতে আরামের জিনিস আর কিছুই হতে পারে না।

এই ঝরনার নাম বেল্ডিং খিয়াং, এখান থেকে উৎপত্তি বেল্ডিং ঝিরিপথের, সে পানি রুমা বাজার হয়ে আছড়ে পড়েছে সাঙ্গু নদীতে। নামের মতোই অদ্ভুত সুন্দর সে, এ পাথরে লেগে, ও পাথর ঠেলে ধাপে ধাপে নিচে গড়িয়ে পড়ছে ফেনা ওঠা সাদাটে পানি, নিচের পাথরে পড়েই পুরো এলাকাকে জড়িয়ে দিচ্ছে সাদাটে কুয়াশার চাদরে, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ছে হিম হিম ঠান্ডা মিষ্টি বাতাস। পরের গল্পটুকু লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে পড়ার, একনাগাড়ে ঘণ্টা দুয়েক ধরে ঠান্ডা পানিতে শীতে কাঁপতে থাকার, আর গনগনে সূর্যটাকে ঠান্ডা দৃষ্টি দিয়ে তাচ্ছিল্য করার। গোসল আর ছবি তোলার ফাঁকেই নাহিদ ভাই জানালেন, এর ওপরে আরও সুন্দর একটা ঝরনা আছে, মিনিট পাঁচেক এর পথ, নাম তার পলিখিয়াং ঝরনা। তাঁর কথা শেষ হতে দেরি, কিন্তু আমাদের ওদিকে হাঁটার আর কোনো দেরি নেই। সামনে দেখলাম, তরতর করে পানি আসছে এক জঙ্গলের মাঝ দিয়ে। উত্তাল পাহাড় যে জয় করে এসেছে দুর্ভেদ্য জঙ্গলে, তার কী ভয়! সুতরাং জঙ্গলে হারিয়ে গেলাম সবাই। মিনিট দু-এক হেঁটেই থমকে দাঁড়ালাম! জঙ্গলের নিস্তব্ধতা খান খান করে এক ঝরনা আছড়ে পড়ছে বুকসমান এক পুকুরে, সেখানে একটু থেমেই আবার ছুটছে আমরা একটু আগে যেদিকে গোসল করে এসেছি সেই দিকে। তাজ্জব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঝরনার নিচে, জীবনে অনেক ঝরনা দেখেছি আমি, কিন্তু এমন অদ্ভুত একটানা লম্বা ঝরনা আর দেখিনি, পুরো যেন ইংরেজি ‘আই’ অক্ষর, কোথাও এক ফোঁটা বেশকম নেই! মণ্ডল তো বলেই দিল, এমন একটা ঝরনাতে নিয়ে আসার জন্য নাহিদ ভাইকে নোবেল দেওয়া দরকার, আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। কারণ, কথা বলার মতো অবস্থা আমার নেই। কিছুক্ষণ আগে গা ঠান্ডা করে আসা মণ্ডল লোভ সামলাতে না পেরে আবার ঝাঁপ দিল এই ঝরনায়, এক সেকেন্ড মাত্র, এরপর থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এলেও আগের জায়গায়, এই পানি নাকি আগেরটার চেয়েও বেশি ঠান্ডা! আমি আর নাহিদ ভাই সে সাহস করলাম না। কিছু সৌন্দর্য দূর থেকেই দেখা শান্তির! পুরো দেশ যখন মাথা ফাটা গরমে অস্থির, সেখানে আমরা ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছি, পাহাড় এমনি রোমাঞ্চকর জায়গা।

কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে করে চলে যান বান্দরবান। বান্দরবানের রুমা বাসস্ট্যান্ড থেকে সকালের গাড়িতে উঠে রুমা চলে যাবেন। রুমা বাজার থেকে ডান দিকে ইডেন পাড়া হয়ে মংপ্রু পাড়ার দিকে হাঁটা শুরু করবেন। ঘণ্টা তিনেক পরে পৌঁছে যাবেন মংপ্রু পাড়ায় যাওয়ার রাস্তা, সেখান থেকে বাঁ দিকে নেমে গেলেই সানাক্র পাড়া, আর পাড়ার নিচেই রয়েছে এই ঝরনাগুলো। পাহাড়ে গেলে সব সময় একটা জিনিস খেয়াল রাখবেন, কোনো প্রকার প্লাস্টিক বা পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু ফেলে আসবেন না এবং কোনো বন্য প্রাণী দেখলে তার ক্ষতি করবেন না। সূত্র : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *