প্রকৃতির অপার মায়ায় বিছানো জল-পাথরের মেলা। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এ জায়গাটি বেশ বিস্ময় আর রোমাঞ্চকর। ভরা বর্ষায় পুরো বিছানা সাজে মেঘ-বাদলের জলের খেলায়। নিরিবিলিতে কয়েক দিন কাটিয়ে আসার জন্য আদর্শ।
বিছানাকান্দিতে যেতে নরম সবুজের চাদরে ঢাকা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হবে। মেঘালয়ের বুক চিরে আসা ঝরনার হিম-শীতল জল ভ্রমণপ্রিয় মানুষের মনে এনে দেয় প্রশান্তি। হিম জল পাথরের সারি আর আশপাশের পাহাড়ি সৌন্দর্য যেন এক রূপকথার রাজ্য। একেবারে বাংলাদেশের শেষ প্রান্ত। ওপারে ভারতের হিমালয় আর এপারে ঐতিহাসিক সিলেট শৈলশহর। গরমকালে শীতের আদুরে স্পর্শ আর তার ঠিক পরই বর্ষায় বিছানাকান্দি হয়ে ওঠে আরও সুন্দরী।
সিলেট বিমানবন্দর রোড ধরে বিছানাকান্দির পথ। বিমানবন্দর পর্যন্ত রাস্তাটি অনেক সুন্দর। চারপাশে শুধু সবুজ চা বাগান। নীল আকাশ আর সবুজ কার্পেটের ওপর যেন তাঁবু টাঙিয়েছে। সিএনজিতে বসেই দেখা মিলবে ছবির মতো আঁকা মেঘালয়ের পাহাড়গুলো। মাঝে মাঝে পাহাড়ের গায়ে মেশানো সাদা রেখার ঝরনাগুলো প্রকৃতিকে আরও অপরূপ করে তুলেছে। বিছানাকান্দি, সীমান্তহীন মেঘ, নীল আকাশ এখানে বড় উদার, নিজেকে মেলে ধরেছে। সিলেটের বিছানাকান্দিতে বর্ষায় নামে অপরূপ জলধারা। ভারত থেকে আসা শীতল স্বচ্ছ জল পর্যটকদের মন কাড়ে। সীমান্তঘেঁষা মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঠাণ্ডা জলের স্রোত থরে থরে সাজানো পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলে। ঠিক যেন পাথুরে নদী। নৌকা করে বিছানাকান্দি আসার পুরো পথটা অসম্ভব রোমাঞ্চকর। স্বচ্ছ আর ঠাণ্ডা জল ঠেলে নৌকার এঁকেবেঁকে বয়ে চলা মনে এনে দেয় অদ্ভুত আনন্দ। তার ওপর বাড়তি পাওনা হিসেবে তো আছে আশপাশের গগনচুম্বী পাহাড় আর মাথার ওপর শুভ্র-শান্ত নীলাকাশ।
পথ যত কমতে থাকে অস্পষ্ট পাহাড়গুলো স্পষ্ট আকার নিতে থাকে আর তখন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে হয়। যেন কোনো শিল্পীর আঁকা ছবির মতো এ দৃশ্য, প্রতিটি খাঁজে রয়েছে অপার সৌন্দর্য আর নিখুঁত কারুকার্যের নিদর্শন। পথে চলতে চলতে দুধারে দেখা মিলতে পারে আদিবাসীদের। এমনি করে চলতে চলতে কখন যে পথ শেষ হবে তা বলা মুশকিল। কিন্তু পথ শেষ হলে যে সৌন্দর্য শেষ তা কিন্তু নয়! অপরূপ বিছানাকান্দিতে পৌঁছে মনে হবে পাহাড় যেন আকাশে মিশে গেছে। কিন্তু পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে এ ভাবনাটুকু কখন যে তলিয়ে যাবে বুঝতেই পারবেন না। পা রাখতেই টের পাওয়া যাবে কেন বিছানাকান্দিতে আসা। স্বচ্ছ আর হিমশীতল জল নিচে যেন শত শত পাথরের মেলা বসেছে। নানা রঙের, নানা আকারের আর বিচিত্র সব উপাদানের পাথরে ভরপুর এ জায়গাটিকে রূপকথার পাথরের রাজ্য বললে ভুল হবে না। শুধু পা ভিজিয়ে ক্ষান্ত থাকেন না এখানে আসা মানুষগুলো। শরীর এলিয়ে দিয়ে যখন চোখ বুজে আসে তখন একে পাথরে ভরা বাথটাব বলেই মনে হয়। বর্ষার সময়টাতে জলে টইটম্বুর থাকে বিছানাকান্দি। তখন একে তুলনা করা হয় কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা দেওয়া তরুণীর সঙ্গে। অপরূপ চোখজুড়ানো মোহনীয়তায় যেন আবিষ্ট করে রাখে ভ্রমণপ্রেমীদের। তবে শীতকালে বিছানাকান্দি ভ্রমণ না করাই শ্রেয়।
বিছানাকান্দি ভারত এবং বাংলাদেশের বর্ডার এলাকায় অবস্থিত। প্রায় ১০০ গজ দূরে থাকা লাল পতাকাগুলোর সারি জানান দেয় যে ওপাশেই ভারত। এখান থেকে সহজেই ভারতীয় জলপ্রপাতগুলো দেখা যায় যা থেকে পানি বয়ে আসে বিছানাকান্দি পর্যন্ত। একটি কাঠের ব্রিজ বাংলাদেশের বর্ডারের মধ্যে পড়েছে যা পানিপ্রবাহের বিপরীত দিকে অবস্থিত উচ্চভূমি আর সমতল ভূমির মধ্যে সংযোগ স্থাপনের কাজ করে। এর ফলে আদিবাসীদের গবাদিপশু চারণের বিশেষ সুবিধা হয়েছে। জল, পাথর, পাহাড় আর নীল আকাশ নিয়েই যেন বিছানাকান্দি। এখানে আসার পর যে কথাটি সর্বপ্রথম মনে হয় তা হলো প্রশান্তি। এই প্রশান্তিটুকু নিমিষেই ভুলিয়ে দেয় নিত্যদিনের ব্যস্ততা।
প্রকৃতির সৌন্দর্যের কাছে যেন হার মানতেই হয় নাগরিক সভ্যতাকে। আর এই চরম সত্যটুকু উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে চলে আসতে হবে বিছানাকান্দিতে।
কীভাবে যাবেন
ট্রেনে কিংবা বাসে সিলেট যেতে হবে। সিলেট শহরের যে কোনো স্থান থেকে রিজার্ভ করা সিএনজি নিয়ে হাদার বাজার যেতে হবে। তা ছাড়া আম্বরখানা হয়েও আসা যায়। হাদার বাজার নেমে নৌকায় বিছানাকান্দি।
মনে রাখা প্রয়োজন
সময় থাকলে পান্তুমাই থেকেও ঘুরে আসতে পারেন। বিছানাকান্দির পাশেই অবস্থিত এ স্পটটিও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।
পাথরে চলার সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা ভালো। নয়তো পা পিছলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
খাবারের পর্বটুকু হাদারপাড় থেকে সেরে আসা ভালো। বিছানাকান্দিতে খাবারের দোকান পাওয়া দুর্লভ। ছোটখাটো কিছু দোকান ছাড়া তেমন কিছু নেই। তবে চাইলে সিলেট শহর থেকেই খাবার প্যাক করে নিয়ে আসতে পারেন।
প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টির রক্ষায় পানিতে কোনো ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না।
বিছানাকান্দি যেহেতু জিরো পয়েন্টে অবস্থিত তাই ভ্রমণকারীদের বর্ডারের আশপাশে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
অনেক সময় বর্ষায় এখানে আকস্মিক বন্যা হয়। তাই যাওয়ার আগে আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য জেনে নেওয়া উচিত।
আবাসন ও রেস্তোরাঁ
এখানে থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা নেই। তবে, সিলেট শহরে উন্নতমানের হোটেল রয়েছে। বিছানাকান্দিতে দিনে গিয়ে দিনে ফেরা যায়। হোটেল হিল টাউন, ব্রিটানিয়া হোটেল, হোটেল দরগা ইন ছাড়াও অনেক ভালো মানের হোটেল রয়েছে। এ ছাড়া খাবার সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন। ওখানে একটা বাজার থাকলেও দুপুরে খাওয়ার তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। টুকটাক নাশতা সারতে পারেন। আর কোনোমতে পেট ভরাতে চাইলে স্থানীয়দের রান্না করা রেস্টুরেন্টগুলোতে ঢুঁ মারতে পারেন। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন