শাহীন আখতার
আমরা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) কৃষি অনুষদের প্রথম বর্ষের একদল ভ্রমণবিলাসী তরুণ। জীবনানন্দের রূপসী বাংলাকে ঘুরে দেখার জন্য আমরা ক্লাসের বন্ধুরা মিলে গড়ে তুলেছি একটি ভ্রমণদল। সে ভ্রমণ দলের নাম দিয়েছি ঘেপসি ৭। ঘেপসি শব্দের আঞ্চলিক অর্থ ফাঁকিবাজ। আমরা পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে একটু সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের সকল বিভাগ দেখতে বেরিয়ে পড়ব বলেই এই ধরনের নাম। আর ৭ মানে প্রথমে এই গ্রুপের সদস্য সংখা ছিল সাতজন। তবে এখন ছেলেমেয়ে মিলে এই গ্রুপের বর্তমান সদস্য সংখ্যা সাতের অনেক ওপরে।
ময়মনসিংহের বেশ কিছু জায়গা ঘুরে দেখার পর এবার আমরা ঘুরে এলাম সিলেটের কয়েকটা দর্শনীয় স্থান। আমাদের সিলেট ভ্রমণের যাত্রা শুরু হয় ট্রেনের মাধ্যমে। ময়মনসিংহ থেকে যাত্রা শুরু করে ঢাকা হয়ে সিলেটে যাই আমরা। যাবার পথে ট্রেনের উপর পুরোটা পথ আমাদের চঞ্চলতায় মুখর ছিল ট্রেনের কামরা। গান, গল্প এবং হাসি-তামাশায় সর্বদাই উচ্ছ্বাসিত ছিলাম আমরা। ট্রেনের মধ্যে থাকা অবস্থায় শুরু হয় বৃষ্টি। ধুম বৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা সকালবেলা সিলেটে পৌঁছাই। তারপর সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দর্শনের মাধ্যমে আমাদের সিলেট ভ্রমণের সূচনা হয়। এরপর আমরা ঘুরতে গেলাম জাফলংয়ে। একটা লেভুনা (গাড়িটা অনেকটা টেম্পোর মতো) গাড়ি ভাড়া করে ছুটে চললাম জাফলংয়ের পথে।
এবার জাফলংয়ে সৌন্দর্য সম্পর্কে কিছু কথা বলি। সেই আশির দশকের দিকে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে নৌপথে জাফলং যেত। আমরা জাফলং যাচ্ছি জাফলংয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের পিপাসা মেটাতে। উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান মালনীছড়ার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে যা চোখে পড়ে তা কখনও ভুলবার নয়। প্রায় অনেকটা পথ জুড়েই ছিল মেঘালয়ের আকাশচুম্বি সারি সারি পাহাড় আর দিগন্ত বিস্তৃত নদী। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছিল সাদা মেঘেদের পাকানো কুণ্ডলী। সেই পাহাড়ের গা বেয়ে একটু পরপরই ঝরনার মতো বয়ে পড়ছিল সাদা রঙের জলের ধারা। নদীর নীল আর পাহাড়ের সবুজাভ নীল যেন মিশে একাকার হয়ে গেছে। ভোলাগঞ্জে যাবার পর পৌঁছে গেলাম একেবারে সীমানার শেষ প্রান্তে। অদূরেই ছিল ধলাই নদীর উজানে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জি। খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত প্রকৃতি কন্যা হিসাবে খ্যাত সিলেটের জাফলং। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি এই জাফলং। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আরও আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ভারতীয় পাহাড়ি টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবাহমান জলপ্রোপাত ঝুলন্ত ডাউকি ব্রীজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি, উঁচু পাহাড়ে গহীন অরণ্য ও শুনশান নীরবতার কারণে এলাকাটি আমাদের দারুণভাবে মোহাবিষ্ট করেছে। সিলেট ভ্রমণে এসে জাফলং না দেখে গেলে ভ্রমণটাই যেন অপূর্ণ থেকে যেত বলে মনে হয়েছে। আমরা যেহেতু সেখানে গিয়েছি বর্ষার একেবারে শেষ দিকে। ধূলি ধূসরিত পরিবেশগুলো হয়ে উঠেছিল স্বচ্ছ। স্নিগ্ধ পরিবেশে এক আশ্বর্য সজীবতা বিরাজ করছিল। খাসিয়া পাহাড়ের সবুজাভ চূড়ায় তুলার মত মেঘরাজির বিচরণ এবং যখন-তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পাহাড়ি পথ হয়ে উঠে কর্দমাক্ত আর বিপদ সংকুল। সেই পাহাড়ের উপর গড়ে ওঠা বাড়ি-ঘরগুলো সত্যিই আশ্চর্যের এক মহামূল্যবান নিদর্শন। যা দেখে সহজে চোখ সরিয়ে নেয়া সহজ নয়। সেই সঙ্গে কয়েক হাজার ফুট উপর থেকে নেমে আসা সফেদ ঝরনাধারার দৃশ্য দেখেই আমাদের সবার নয়ন জুড়িয়ে গেল। আর ঝরনার পানিতে গোসল করে মনে হয়েছিল সিলেট ভ্রমণ সার্থক। এছাড়াও সুরমা নদীর উপরে ক্বীন ব্রীজ না দেখলে যেন সিলেট ভ্রমণ অনেকটাই অপূর্ণ রয়ে যেত। সূত্র : ইত্তেফাক