নাজমুল হোসেন
স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া প্রদেশের স্বায়ত্তশাসিত এলাকা বুনিয়ল শহরের পুরনো রীতি অনুসারে আগস্টের শেষ সপ্তাহজুড়ে সাংস্কৃতিক উৎসব চলে। আর এই উৎসবের মূল আকর্ষণ টমেটোর লড়াই। দুনিয়াজোড়া পরিচিতি পাওয়া এই টমেটো লড়াইয়ের নাম ‘লা টমাটিনা’।
অবাক করার বিষয় হলো এ উৎসবের শুরু হয় বুনিয়ল শহরের টাউনহলের এক কর্মকর্তার সাথে বিবাদের মাধ্যমে। এ কর্মকর্তার সাথে শহরের লোকেরা টমেটো ছুড়ে প্রতিবাদ জানায়। এরপর অনেকেই বিষয়টিকে মজার মনে করেন। আর তাই এর ধারাবাহিকতায় শুরু হয় টমেটো নিয়ে মজা করার এ আয়োজন।
শুরুতে যে টমেটো ছুড়ে প্রতিবাদ করা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কথিত আছে টমেটোবোঝাই একটি লরি রাস্তায় কাত হয়ে পড়ে গেলে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে ওই টমেটো লড়াই শুরু হয়েছিল; কিন্তু একটা বিষয়ে সবাই একমত, শহরের কোতোয়াল এসেই লড়াই থামিয়েছিল এবং পরের বছর শহরবাসী এই লড়াইয়ে উৎসাহী ছিল। আবার কেউ কেউ মনে করেন, মাপেটের মিছিলে কোনো এক বাজে গায়ককে উদ্দেশ করে টমেটো ছুড়ে মারা থেকে এই উৎসবের শুরু।
লা টমাটিনার এই জমজমাট অবস্থা অবশ্য এক দিনে হয়নি। ১৯৪৫ সালে শুরুর পর লাগাতার কয়েক বছর চলে এই টমেটো খেলার ঘটনা।
টমেটো খেলার অপরাধে বহু মানুষকে আটক করে জেলে পোরে শহর কর্তৃপ। এরপর পুলিশি নিষেধাজ্ঞা জারি করে বন্ধ করে দেয়া হয় টমেটো খেলা; কিন্তু কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর উৎসব চালু করার পে জনমত গঠনে এক ব্যঙ্গাত্মক কর্মসূচি হাতে নেয় শহরের মানুষেরা।
১৯৫৭ সালে লোকজন একটা কফিনের মধ্যে বিশাল একটা টমেটো রেখে ‘টমেটোর মৃত্যুতে’ শোক মিছিল করে। শোকসঙ্গীত গেয়ে গেয়ে পথচলা লোকে লোকারণ্য সেই মিছিল দেখেই শহর কর্তৃপরে টনক নড়ে। এরপর অনুমতি তো মেলেই, ধীরে ধীরে টাউন হলই এই টমেটো খেলার আনুষঙ্গিক আয়োজনের দায়িত্ব নিতে থাকে।
২০১২ সালে তো প্রায় ৪০ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল লা টমাটিনায়। ছোট্ট একটা শহরে জনসংখ্যার চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি মানুষের সেই ভিড় সামাল দেয়া আর শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পরের বছর থেকেই টিকিট ছাড়া শুরু করল কর্তৃপ। টিকিটের দাম মাত্র ১০ ইউরো, তবে এটা কেবল অনুমতিপত্র মাত্র। থাকা-খাওয়া আর যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হবে নিজেকেই। অবশ্য এ জন্য আছে ডজন ডজন বেসরকারি টুরিস্ট প্রতিষ্ঠান।
এবার লা টমাটিনায় ১০০ মেট্রিক টনের বেশি অতিপাকা টমেটো আনা হয়েছে গ্রামের খামারগুলো থেকে। মাত্র ঘণ্টাব্যাপী এই টমেটো লড়াইয়ের জন্য ব্যয় হচ্ছে আনুমানিক এক লাখ ৪০ হাজার ইউরো। সেই হিসাবে প্রতি মিনিটে খরচ দুই হাজার ৩০০ ইউরো।
বুনিয়ল শহরের জনসংখ্যা মাত্র ৯ হাজার। তবে এ বছরও টমেটো লড়াইয়ে অংশ নিতে দেশ-দেশান্তর থেকে বুনিয়লে উড়ে এসেছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। অবশ্য শহর কর্তৃপ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিয়ে টিকিট কাটার ব্যবস্থা চালু না করলে কী হতো, তা বলা মুশকিল।
সকালে বুনিয়লের শহরকেন্দ্র প্লাজা ডেল পুয়েবলোয় এসে জড়ো হয় পাকা টমেটোভর্তি ট্রাকের সারি। শহরকেন্দ্রের চত্বরে রাখা থাকে দোতলা সমান উঁচু একটা গ্রিজ মাখানো কাঠের থাম। ওই থামের শিখরে একটা হ্যাম রাখা থাকে। হ্যাম এক প্রকার মাংসজাত খাবার। আনুষ্ঠানিকতা অনুযায়ী কোনো এক সাহসী প্রাণ ওই তৈলাক্ত থাম বেয়ে শিখর থেকে হ্যামটা জিতে না নেয়া পর্যন্ত এই টমেটো লড়াই শুরু হওয়ার কথা নয়; কিন্তু বাস্তবে তা কখনোই হয় না! বরং টাউন হল থেকে ছোড়া জলকামানের জলজ গম্ভীর গোলার শব্দের সাথে সাথেই শুরু হয় এই মহা হুল্লোড়।
অনেকটা হোলি খোলার মতোই চলে এই আয়োজন। আর তাই শুরুর পরই সবাই নিজেকে রক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাগলামির মাত্রা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় মাঝে মধ্যে। আর এ কারণেই অংশগ্রহণকারী লোকজনের সবাইকে চোখ বাঁচানোর জন্য গোগলস পরে আসার পরামর্শ দিয়ে থাকে শহর কর্তৃপ। আর টমেটো তা যত পাকাই হোক, অন্যের দিকে ছুড়ে মারার আগে তা অবশ্যই হাতের চাপে চ্যাপটা করে নিতে হবে, যাতে কেউ ব্যথা না পায়। সাথে কোনো পানির বোতল বা গ্লাস আনা যাবে না। আর নারী বা পুরুষ কারো শার্ট, টি-শার্ট, জামা ছেঁড়া যাবে না; কিন্তু বাস্তবে লড়াইয়ের ময়দানে এই শেষ নিষেধটি কেউই যে মানেন না।
লড়াই শুরুর ঠিক এক ঘণ্টা পর আবারো শোনা যাবে জলকামানের গর্জন। আর তুনি শেষ লড়াই। এরপর আর কেউ কাউকে টমেটো নিয়ে তাড়া করতে পারবেন না বা নাজেহাল করতে পারবেন না। টমেটো লড়াই শেষের পর শুরু হয় আরেক যজ্ঞ। ১০০ টন পাকা টমেটোর রসে-রঙে পাল্টে যাওয়া শহর ধুয়েমুছে সাফ-সুতরো করার যজ্ঞ।
টমেটো লড়াইয়ের যোদ্ধাদের অনেককেই পাশের বুনিয়ল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ ছাড়া শহরের অলিগলির বাসাবাড়ির অনেক গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীকেও দেখা যায় হোসপাইপ নিয়ে দাঁড়িয়ে অতিথিদের গোসলে সহযোগিতা করতে।
বুনিয়ল শহরের টমেটো উৎসব ‘লা টমাটিনা’ এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, দুনিয়ার নানা প্রান্তে ইতোমধ্যেই এই উৎসবের আদলে টমেটো লড়াইয়ের উৎসব চালু হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কলম্বিয়া, চিলিসহ বেশ কয়েকটি স্থানেই এখন প্রতি বছর আয়োজন হয় টমেটো লড়াইয়ের উৎসব।
প্রতি বছরই লোকজনের প্রস্তুতি আগের চেয়ে বাড়ছে। এভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রতি বছরই একটু একটু করে জমে উঠছে ‘লা টমাটিনা’। সূত্র : নয়া দিগন্ত