Skip to content

টিকরপাড়ার কালো শিয়াল

Black-Fox
কালো শিয়াল প্রকৃতিতে একেবারেই বিরল এক ঘটনা। অনেক চেষ্টার পর সিলেট থেকে কালো শিয়ালের ছবি তুলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল খান। তাঁর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন
ইশতিয়াক হাসান

কালো শিয়াল রহস্য

কালো শিয়াল আলাদা প্রজাতির কোনো শিয়াল নয়। গ্রামে-গঞ্জে দেখা যাওয়া সাধারণ শিয়াল বা গোল্ডেন জ্যাকেলই ওগুলো। শরীরে মেলানিনের আধিক্যের কারণেই এদের গায়ের রং কালো। বাবা শিয়ালটার গায়ের রং কালো হওয়ায় কয়েকটা বাচ্চা কালো রং পেয়েছে। এ ধরনের প্রাণী পরিচিত মেলানিস্ট নামে। তবে প্রকৃতিতে এ ঘটনা একেবারেই বিরল। সাধারণত মেলানিনের আধিক্যের কারণে কালো হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায় বিড়াল গোত্রের প্রাণীদের মধ্যে—জানান মনিরুল খান। বাংলাদেশে একাধিকবার কালো চিতা দেখা যাওয়ার রেকর্ডও আছে।

বছর দুয়েক আগের ঘটনা। রাতে বাড়ি ফিরছিলেন আবদুল জব্বার। হঠাৎ অন্ধকারে সরু মাটির পথটার ওপর কী একটা প্রাণী নজর কাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে হাতের টর্চ জ্বালালেন। প্রথমে একটা কালো কুকুরই মনে হলো। খেয়াল করলেন টর্চের রশ্মি ফেলার পরও প্রাণীটা জায়গা ছেড়ে পালাচ্ছে না। কোথায় যেন একটা গরমিল আছে বলে মনে হলো। একটু পরে কালো প্রাণীটা চলে গেলে বাড়ি ফিরলেন আবদুল জব্বার। পরের কয়েক দিনে টিকরপাড়ার আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো। সিলেটের এই গ্রামটির সীমানা যেখানে শেষ, তার পরই পাহাড়ি এলাকার শুরু। পাহাড়ি এলাকার মাঝখানেই খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান। পাহাড়-অরণ্যের ধারে হওয়ায় টিকরপাড়ার লোকজন বন্যপ্রাণীর সঙ্গে ভালোমতোই পরিচিত। তাদের কেউ কেউও দেখেছে রাতে কালো কুকুরটাকে। কিন্তু এটা যদি কুকুরই হয়, দিনের বেলা কেন দেখা দেয় না—ভেবে অবাক হলেন আবদুল জব্বার।

প্রাণীটাকে নিয়ে তিনি রীতিমতো রহস্যে পড়ে গেলেন। এর মধ্যেই একদিন কী মনে করে গ্রামের শেষ বাড়িটায় গেলেন ওখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে। ওই বাড়ির পরেই একটু খোলা জায়গা, তার পরই পাহাড়ের শুরু। আর আসতেই যেন আলোর রেখা দেখতে শুরু করলেন। বাড়ির কত্রী জানালেন তাঁদের বাড়ির আশপাশে এঁটো-ঝুটো খেতে কয়েকটা শিয়াল আসে। কখনো সন্ধ্যায়, কখনো বেশ রাতে। এদের কোনো কোনোটার রং তাঁর কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এক রাতে ওই বাড়িতে আরো কয়েকজনসহ ওত পেতে রইলেন আবদুল জব্বার। আনুমানিক দশটা-সাড়ে দশটার দিকে দেখা দিল শিয়ালের পাল। মোট পাঁচটা। আর কী আশ্চর্য! এর মধ্যে তিনটাই কালো। এত দিন ধরে জঙ্গলের ধারে থাকছেন, কিন্তু এমন ঘটনা দেখা তো দূরের কথা, শুনেনওনি। এ সময়ই মাথায় এলো মাজহারুল ইসলাম জাহাঙ্গীর সাহেবের কথা। ইউএসএআইডির ক্রেল প্রজেক্টের এই ভদ্রলোক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেন। তাঁকে জানালে হয়তো এই কালো শিয়াল রহস্যের একটা সুরাহা হলেও হতে পারে।

Black-Fox2

জাহাঙ্গীর সাহেবই ফোনে বিষয়টা জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল খানকে। খবর পেয়ে রীতিমতো চমকে উঠলেন তিনি। কারণ প্রকৃতিতে এভাবে কালো শিয়াল দেখা যাওয়ার খবর তাঁরও জানা নেই। নিশ্চিতভাবেই মেলানিনের কারণে এটা হচ্ছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য একটি ছবি তুলে পাঠানোর অনুরোধ করলেন জাহাঙ্গীর সাহেবকে। শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের ধারের ওই বাড়ির কাছে মুরগির নাড়ি-ভুঁড়ির টোপ দিয়ে আবদুল জব্বার মোবাইলে তুললেন কালো শিয়ালের ছবি। ছবির মান অতটা ভালো না হলেও ওটা দেখেই মনিরুল খান সিদ্ধান্ত নিলেন টিকরপাড়া যাবেন।

শিয়ালগুলোকে যেন পাওয়া যায় তাই মনিরুল খান ও তাঁর দল যাওয়ার আগের দিন মুরগির নাড়ি-ভুঁড়ির টোপ দিয়ে দিয়ে বাড়ির কাছ পর্যন্ত টেনে নেওয়া হলো। তাহলে পরের দিন শিয়ালগুলো এই খাবারের লোভে আবার হানা দেবে।

২০১৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর শক্তিশালী টেলিল্যান্সসহ টিকরপাড়ায় হাজির হলেন মনিরুল খান। সঙ্গে জাহাঙ্গীর সাহেবসহ আরো কয়েকজন। তাঁরা পৌঁছালেন বিকেল ৪টায়। কারণ দিনের আলো থাকতে থাকতে যদি শিয়ালগুলোকে ক্যামেরাবন্দি করা যায়, তবে ভালো ছবি পাওয়া যাবে। গ্রামের ওই শেষ বাড়িটার উঠোনের পর একটু নিচু জায়গা। তারপর পাহাড়। ওই নিচু জায়গাটিতে দেওয়া হলো মুরগির নাড়ি-ভুঁড়ির টোপ। আর বাড়ির উঠানে কিছু কাপড় দিয়ে একটু আড়ালের ব্যবস্থা করে বসলেন মনিরুল খান, আবদুল জব্বার, জাহাঙ্গীর সাহেবসহ আরো কয়েকজন। কিন্তু বিধি বাম। সন্ধ্যার আগে দেখা দিল না শিয়ালের দল।

অন্ধকার নামার পর পাহাড়ের দিক থেকে প্রথম শোনা গেল শিয়ালের হাঁক। সাতটার পর থেকে শুরু হলো আনাগোনা। একে একে পাঁচটাই হাজির। টেলিল্যান্স ব্যবহার করে রাতে ছবি তোলা সহজ নয়। তার উপর আবার শিয়ালগুলো মোটেই স্থির থাকছে না। সব সময়ই নড়াচড়া করছে। মনিরুল খানের লক্ষ্য একটা সাধারণ শিয়ালের সঙ্গে আরেকটি কালো শিয়ালকে ক্যামেরার ফ্রেমে আটকানো, যাতে পার্থক্যটা তুলে ধরা যায়। খেয়াল করে দেখলেন দলের বাবা বা সর্দার শেয়ালটা কালো। তবে পেটে একটু সাদা ছোপ আছে। মা শিয়ালটা সাধারণ বাদামি। আর বাচ্চা তিনটার দুটি, যেগুলো এখন তরুণ, একেবারেই কালো। শেষ পর্যন্ত রাত বারোটা পর্যন্ত চেষ্টা করে তুলতে পারলেন মনমতো কিছু ছবি। এর মধ্যে কালো আর সাধারণ শিয়ালের যুগলবন্দি ছবিও আছে।

শিয়ালগুলোর ছবি তোলার সময়ই আরেকটা বিষয় চোখে পড়েছে মনিরুল খানের। মা শিয়ালটা মাঝেমধ্যেই খাবার নিয়ে একটু দূরে পাহাড়ের পাশের জঙ্গলে ঢুকছে। পাহাড়ের ধারের ওই বাড়ির লোকদের সঙ্গে কথা বলে সেই রহস্যও উন্মোচিত হলো। আরো কয়েকটা বাচ্চা ফুটিয়েছে মা শিয়াল। ওগুলো একেবারে ছোট হওয়ায় নিয়ে বের হয় না সহজে। তবে একদিন যখন ওগুলোকে নিয়ে বের হয়েছিল, তখন নাকি এদের মধ্যেও আরো খুদে কালো শিয়াল ছিল। তিনটা কালো শিয়াল, আরো কয়েকটা বাচ্চা কালো, প্রকৃতি কত বিস্ময় যে নিজের হাতায় লুকিয়ে রাখতে জানে ভাবলে অবাকই হতে হয়। তবে প্রকৃতির এই বিস্ময়গুলো টিকে থাকলেই হয়। কারণ মানুষের প্রবণতাই হচ্ছে কারণে-অকারণে বন্যপ্রাণী হত্যা। তবে আশার কথা, আবদুল জব্বারসহ অন্য গ্রামবাসীরা কথা দিয়েছেন এদের রক্ষা করবেন। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *