Skip to content

ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্য-লোকায়ন

Thakurgoan3

সামিল্যাহ সমরাট
টাঙ্গন পারে চায়ের আড্ডা চলছিল। সঙ্গী কামাল উদ্দিন আপেল ভাই। ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়ায় রবীন্দ্র ভারতী থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন নব্বইয়ের দশকে। দীর্ঘদিন থেকে ঠাকুরগাঁও অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছেন। আড্ডার বিষয়বস্তুও ওঁরাও সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা আর লোকজ ঐতিহ্য। একপর্যায়ে আপেল ভাই বললেন, ‘চলো, তোমাকে একটি সুন্দর জায়গা দেখিয়ে নিয়ে আসি।’ একটু অবাকই হলাম। ঠাকুরগাঁওয়ের সব কিছুই তো দেখা। তাহলে কোথায় নিয়ে যেতে চান তিনি। কথা আর বাড়ালাম না। তাঁর প্রিয় বাহন হোন্ডা ফিফটির পেছনে সওয়ার হলাম। প্রায় কিলো দুই এগিয়ে ছায়াঘেরা এক শান্ত বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালাম। দরজা খুলে দিলেন মাঝ বয়সী একজন। দুহাত এক করে নমস্কার জানালেন। একটু সামনে গিয়ে ডানে-বামে তাকিয়ে বুঝলাম এটা কোনো বাড়ি নয়, একটা ক্যাম্পাস। আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন আপেল ভাই। ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, চল। কাঠের তৈরি টিনশেড চৌচালা ঘর। বারান্দায় গাছের শুকনো ডালপালা দিয়ে বেড়া দেওয়া, দরজায় লেখা ‘লোকায়ন’। দরজাও খুললেন সেই একই ব্যক্তি। এবার পরিচয় পেলাম, নাম অনয় বর্মণ। দারোয়ান কাম পিওন।

লোকায়ন। একটি ব্যতিক্রমী জাদুঘর। আপেল ভাই-ই এই জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে সাজিয়ে রাখা প্রতিটি সংগ্রহের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে চলেছেন। লোকজ ঐতিহ্যের অনেক উপকরণ এখানে সংরক্ষিত, বিশেষ করে কৃষিজ দেশীয় অনেক যন্ত্রপাতি এখানে রয়েছে। যেমন লাঙল-জোয়াল, মই, ফলা, নিড়ানি, দা, কাস্তে, খুন্তি, মাথাল, ইঁদুর মারার ফাঁদ, গরুর মুখে দেওয়া আটুলি, জাঁতা, ঢেঁকি, ছাম-গাহিন, কোদাল, হাতুড়ি, শাবল। বাদ্যযন্ত্রের তালিকায় রয়েছে দোতারা, মাদল, বাঁশি, সানাই, একতারা, ঢাক, ঢোল। জিজ্ঞেস করে জানলাম এই জাদুঘরের উদ্যোক্তা শহিদুজ্জামান স্থানীয়দের কাছ থেকে এসব সংগ্রহ করে এনেছেন, অনেকেই স্বেচ্ছায় অনেক কিছুই দিয়ে গেছেন। ব্রিটিশ আমলের বেশকিছু হাতে লেখা অস্পষ্ট দলিল, চিঠিপত্র, পুঁথি ও জমিদারের খাজনা আদায়ের রসিদও সযতনে রাখা আছে।

তাকের একেকটি খোপে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাছ ধরার জাল, টোঁটা, পলো, চাঁই, কামারের হাঁপর, হুক্কা, বসার পিঁড়ি, বাঁশের মোড়া, কয়েক রকমের কেরোসিনের কুপি, তীর-ধনুক, তরবারি, ঢাল, মাটির বাসনকোসন, হাঁসুলি, হাতের চুড়ি, বালা, শত বছর আগের গুড়ের হাড়িসহ যাত্রাপালায় ব্যবহূত পোশাক-আশাক। বাদ যায়নি পুরনো ক্যামেরা, টাইপরাইটার, রেডিও, ক্যাসেটপ্লেয়ারও।

বাইরে একটা ঔষধি গাছের বাগানও আছে। সব মিলিয়ে এখানে ১২০ প্রজাতির ঔষধি ও ৭০ প্রকারের ফলের গাছ রয়েছে। পরিচিত অনেক গাছের পাশাপাশি অপরিচিত অনেক যেমন শালপনি, দাদ মর্দন, বেগুন হুরহুরি, মনসাগাছ দেখালেন আপেল ভাই।

শুধু সংগ্রহই নয়, শাশ্বত বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এখানে বিভিন্ন উপলক্ষে নিয়মিত বসে স্থানীয় লোকনাট্য ধামের গান, আদিবাসী নাচ-গান, কবিগান, গীত, বর্ষামঙ্গল, নবান্ন, শীতে পিঠা উত্সব। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *