Skip to content

তরী ভিড়ল

পীযূষ সিকদার
এ এক ভ্রমণের গল্প। হ্যাঁ গল্পই আমার কাছে। যদিও এ গল্প গল্পের ফ্রেমে বাঁধা নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে আমার পথচলা হয়নি কখনো। তাই যখন এ ভ্রমণ বৃন্তান্ত নিয়ে লিখতে বসেছি, তখন এটিকে গল্প বললে বাড়িয়ে বলা অথবা মিথ্যা বলা হবে না।

শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌ ভ্রমণে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলাম। গুলশান ১-এর গাইড ট্যুরস লিমিটেড এই নৌ ভ্রমণের আয়োজন করে। বেলা আড়াইটার দিকে গুলশানের গাইড ট্যুরের অফিসে গেলাম। সেখানে কিছু পরিচিতজনের সাথে দেখা হলো, আবার নতুন অনেকের সাথে পরিচয়ও হলো। যদিও শেষ পর্যন্ত কারো সাথেই আমার কথা এগুলো না। তবে কথা এগোয় নিজের সাথে নিজের। এর মধ্যে কেউ একজন বলল গাড়ি রেডি। গাড়ি চলতে শুরু করল। কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি পরিবর্তন করা হলো।

একটি মাইক্রোতে উঠলাম। মাইক্রো থামল রূপগঞ্জ থানার কাঞ্চন ব্রিজের গোড়ায়। তারপর সোজা হেঁটে বিনোদ তরী। শীতলক্ষ্যা নদী। বিনোদ তরীতে বসে আছেন সুইডেনের পর্যটক ও পর্যটন শিল্পের ভিন্নধারার উদ্যোক্তা ক্রিশ্চিয়ান জুটভিক ও তার স্ত্রী ব্যোয়েল মারিয়া, পাশে বসে আছেন বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের পথিকৃত্ হাসান মনসুর। এই হাসান মনসুর নামটির সাথে আমার আধো পরিচয় আগে থেকে। আজ এই তরীতে তার সাথে আমার পূর্ণ পরিচয় হলো। ক্রিশ্চিয়ান জুটভিকের সাথেও পরিচয় হলো।

Tourist

হাসান মনসুর আর ক্রিশ্চিয়ান জুটভিক দুজনেই পর্যটন শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত। পরিচয় হলো হাসান মনসুর সাহেবের ছোট ছেলের স্ত্রী এলিজাবেথ ফারনি মনসুর ও তার ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ে শান্ত ডিলান মনসুর, আমাইয়া মার্লে মনসুর। পরিচয় পর্ব শেষ হতেই গাইড ট্যুরের তরী ছাড়ল। বাঃ কী অপূর্ব সুন্দর শীতলক্ষ্যা! নদীর বাতাসে, ঢেউয়ে, আনন্দে মনটা খলবল করে নেচে উঠল।

জীবনানন্দের কবিতার চরণ মনে পড়ল, ‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না…।’ সত্যিই তা-ই! আবার নতুন করে বাংলার রূপ দেখে নিলাম। জুটভিক গল্প বলতে শুরু করলেন আর তার সাথে হাসান মনসুর কখনো ইংরেজিতে কখনোবা বাংলায় কথা যোগ করছিলেন। জুটভিক কিভাবে নিজেকে পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িয়ে ফেললেন, কিভাবে তার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন এরই ইতিবৃত্ত বললেন। হাসান মনসুর বন্ধু জুটভিকের অনুপ্রেরণায় এ পেশায় জড়িয়ে ফেললেন নিজেকে।

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুললেন দ্য গাইড ট্যুরস লি.। চা এলো। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এলো। গল্প জমে উঠল। আষাঢ়ে গল্প। যদিও আষাঢ় শেষ হয়ে শ্রাবণের শেষের দিক চলছে। হঠাত্ বৃষ্টিতে আড্ডা শিথিল হয়। হাসান মনসুর সাহেব হাফ প্যান্ট পরলেন। জুটভিকও তাই। হাসান মনসুর জলে লাফ দিলেন সাই করে। জুটভিক ও তার স্ত্রীও দিলেন লাফ জলে। মিতুও। পল্লব আর দেরি না করে জলে লাফিয়ে পড়ল। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। ফিরে গেলাম আমার শৈশবে। বৃষ্টি বাড়ে। বৃষ্টির ছবি তোলা চাই। আমি বৃষ্টি আর নদীর ছবি তুললাম। শান্ত ডিলান মনসুর মাছ ধরতে ব্যস্ত হলো। ছোট ডিলানের জালে একটি মাছও আটকা পড়ল না। তারপরও ওর আনন্দ যেন ধরে না। একসময় বৃষ্টি থামে। আবার জমে ওঠে আড্ডা।

বলে নেওয়া প্রয়োজন, ক্রিশ্চিয়ান জুটভিক ও হাসান মনসুর দুজন বন্ধু। তাদের পরিচয় ঘটেছিল ১৯৭৭ সালে প্লেনে ঠাকুরগাঁ যাওয়ার পথে। সে সময়ে জুটভিক সুইডিশ অ্যাম্বাসির সিডাতে প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর হিসেবে বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন। হাসান মনসুর বিএডিসির কর্মকর্তা ও বাড়তি রোজগারের জন্য ব্যবসা করতেন। একসময়ে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কাঁচা পাটের ব্যবসা শুরু করেন। তারপর বন্ধু জুটভিকের অনুরোধে অথবা ভালো লাগার জায়গা থেকে পর্যটন শিল্পের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। অনেক বছর পর জুটভিক ঢাকায় এসেছেন হাসান মনসুরের আমন্ত্রণে। তাই তো বিনোদ তরীতে বন্ধুদ্বয়ের আড্ডা। আড্ডায় যুক্ত হলাম আমরা।

আদিম গন্ধ নাসারন্ধ্রের পথ বেয়ে ঢোকে। কাঁচা মাংস পোড়ানোর আয়োজন চলে। খাবারে আয়োজন শেষ হয়। হাটাবো থেকে বিনোদ তরীর নোঙর তোলা হলো। খেতে খেতে প্রকৃতি আর নদীর ঘ্রাণ নিতে নিতে কাঞ্চন ব্রিজের কাছে তরী ভিড়ল। আমরা নেমে পড়লাম। গাড়িতে করে বাসায় ফিরলাম। রাতে শুতে শুতে শীতলক্ষ্যাকে মনে পড়ল। মনে পড়ল রবি ঠাকুরে গানের একটি কলি, ‘তরী ভিড়ল…’।

জুটভিকের প্রেরণায় হাসান মনসুরের হাতে গাইড ট্যুরস লি.-এর মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল। তা আরও গতি পাক। গতি পাক এ দেশের অর্থনীতি। এক গল্পের মধ্যে আরেক গল্প জমে উঠুক দুইবন্ধুর পথযাত্রায়। সূত্র : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *