Skip to content

তাঁবুর শহর মিনা

অন্য সময় গাড়িতে করে মিনায় পৌঁছাতে ২০ মিনিট লাগে। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। বুধবার লাগল দুই ঘণ্টা। তবে হজযাত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। বাসের হজযাত্রীদের মুখেও ছিল তালবিয়া ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক লা শারিকা লাকা।’

কেউ কেউ দোয়ার বই পড়ছিলেন। আর যাঁরা অপেক্ষা করতে চাননি, তাঁরা হেঁটেই রওনা হচ্ছেন। কাঁধে ছোট ঝোলা। অনেক বৃদ্ধকে হুইলচেয়ারে যেতে দেখা গেল। নিরাপত্তার জন্য অনুমতিপত্র ছাড়া মিনায় কেউ প্রবেশ করতে পারে না। শুধু স্টিকারযুক্ত গাড়িতে করে হজযাত্রী আনা-নেওয়া করা হয়।

নোয়াখালীর সোনাপুর থেকে আগত মাইনুল আজম বললেন, ‘ভাবতে ভালো লাগছে; যে মিনার সারি সারি তাঁবু ছবিতে দেখেছি, কত গল্প শুনেছি, আজ আমি মিনায়। আল্লাহ তাআলার সে এক অসীম রহমত। লাখ লাখ হাজিদের ভিড়ে, এমন রহমত তো সবার জন্য আসে না, প্রথমবার যাঁরা হজ করছেন, তাঁদের অনুভূতি অনেক বেশি আবেগময়। মিনায় হজযাত্রীর কাজ মিনায় অবস্থান করে ওয়াক্তমতো নামাজ পড়া।

মিনার যেদিকে চোখ যায়, তাঁবু আর তাঁবু। মিনা যেন তাঁবুর শহর। পবিত্র হজের অংশ হিসেবে হজযাত্রীরা মিনায় এসে পৌঁছেছেন। চৌচালা ঘরের মতো এসব তাঁবুতে থাকবেন তাঁরা। এ সময় মিনায় আগুন জ্বালানো নিষেধ। কারণ, এতে তাঁবুতে আগুন লেগে যেতে পারে। ফলে এত লোকের খাবারও বাইরে থেকে রান্না করে নিয়ে আসতে হয়।

শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এসব তাঁবুতে আছে বাতি, বাথরুম। কিছু দূর পর পর আছে খাবারের দোকান। এই দোকানগুলো বছরে পাঁচ দিনের জন্য খোলা থাকে। মোয়াল্লেমের কাছ থেকে দরপত্রের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা দোকান নেন। অল্প সময়ের দোকান বলে জিনিসপত্রের দামও কয়েক গুণ বেশি। বেশির ভাগ দোকানদার ভারতীয় ও পাকিস্তানি। আল্লাহর মেহমানদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, সে জন্য দিন-রাত হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে।

তাঁবুগুলো দেখতে একই রকম হওয়ায় অনেক হাজির পক্ষে পথঘাট ঠিক রেখে নিজের তাঁবুতে যাতায়াত করা কঠিন হয়। এর জন্য এখানে আছে স্কাউট, হজ গাইড। বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ের পক্ষ থেকে হজযাত্রীদের সহায়ক আরাফাত, মিনার তাঁবু নম্বর-সংবলিত মানচিত্র বিতরণ করা হয়েছে। মিনায় জোন রয়েছে মোট সাতটি। ২, ৫, ৬ নম্বর জোনে বাংলাদেশিদের তাঁবু। আমাদের তাঁবু ২ নম্বর জোনে, তাঁবু নম্বর ২৪ থেকে ৬২। মাকসুদ বিন সায়িদ জানালেন, এখানে কোনো গাড়ি চলে না, শুধু চলে পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুলেন্স।

হজের ৫ দিন ছাড়া মিনা খালি পড়ে থাকে
হজের এই পাঁচ দিন ছাড়া মিনার পুরো এলাকা খালি পড়ে থাকে। চারপাশের প্রবেশদ্বারও তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় বৈদ্যুতিক সংযোগ, পানির লাইন, টেলিফোন সংযোগ। হজের দুই দিন আগে মিনা এলাকার ফটক খোলা হয়। হজের দুই দিন পর আবার সব বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মিনার মসজিদের নাম বাংলায়ও লেখা
মিনায় অবস্থান করা হজের অংশ। হজযাত্রীরা মিনার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখছেন। মিনার কাছেই সৌদি বাদশাহর বাড়ি, রাজকীয় অতিথি ভবন। হজযাত্রীরা মোয়াচ্ছাসা (হজের সার্বিক বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ) কার্যালয়, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখছেন। ঢাকার সবুজবাগ থেকে হজ করতে এসেছেন আবদুল হামিদ ও ফাতেমা হামিদ দম্পতি। জানালেন, মিনার মসজিদ মসজিদে খায়েফের সামনে গিয়ে বেশ ভালো লাগল। কারণ, সেখানে বাংলায় লেখা মসজিদে খায়েফ। আরও কয়েকটি ভাষায়ও মসজিদের নাম লেখা আছে। মসজিদে খায়েফ ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন হজযাত্রী কবির আল মামুন, ‘স্ত্রীকে ছেড়ে ঈদ করব, একটু খারাপ লাগছে। তবে পবিত্র হজ পালন করতে এসেছি, এটাই সুখের কথা।’

মিনায় আরও একটা মসজিদ আছে, নাম কুয়েতি মসজিদ। মসজিদের কাছে কথা হলো সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দের জুবায়ের আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘হজে এসেছি, এটাই বড় শান্তি। কষ্ট মনে করলে কষ্ট না মনে করলে কিছু না।’ প্রথমবার হজে আসা মো. সাইদুর রহমান বললেন, ‘হজে আসতে পেরেছি, এর জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাই। সামান্য এই ঘোরাফেরার বাইরে হাজিরা সারা দিন নিজ নিজ তাঁবুতে নামাজ আদায়সহ ইবাদত-বন্দিগি করছেন।

৯ জিলহজ ফজরের নামাজ আদায় করে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করবেন। আরাফাত থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে মুজদালিফায় রাত যাপন ও পাথর সংগ্রহ করবেন হাজিরা। ১০ জিলহজ হাজিরা মিনায় বড় শয়তানকে পাথর মারবেন, কোরবানি দেবেন, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছেঁটে মক্কায় গিয়ে কাবা শরিফ তাওয়াফও সাফা মারওয়া সাঈ করবেন। তাওয়াফ, সাঈ শেষে আবার মিনায় ফিরে ১১ ও ১২ জিলহজ অবস্থান করবেন। সেখানে প্রতিদিন তিনটি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবেন তাঁরা। প্রত্যেক শয়তানকে সাতটি করে পাথর মারতে হয়।

মসজিদে খায়েফ থেকে মক্কার দিকে আসার সময় প্রথমে জামারায় সগির বা ছোট শয়তান, তারপর জামারায় ওস্তা বা মেজ শয়তান, এরপর জামারায় আকাবা বা বড় শয়তান। জনশ্রুতি আছে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ সন্তান ইসমাইলকে (আ.)-কে কোরবানি করার জন্য মিনায় নিয়ে যাচ্ছিলেন। জামারায় পৌঁছালে শয়তান তাঁকে ধোঁকা দেয়। তখন শয়তানকে লক্ষ্য করে তিনি পাথর নিক্ষেপ করেন। তিন শয়তানকে তাকবিরসহ পাথর নিক্ষেপ করা হজের অপরিহার্য অংশ। শয়তানের প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এই পাথর নিক্ষেপ করা হয়।

জামারা কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত, এখানে তাপমাত্রা থাকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য জামারার ভেতরে একাধিক ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা আছে। রয়েছে পর্যাপ্ত টয়লেট, খাবারের দোকান ও সেলুন। জরুরি প্রয়োজনে হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য রয়েছে হেলিপ্যাডও।

পাথর নিক্ষেপের সুবিধার্থে মিনার পূর্ব দিক থেকে আসা হাজিরা আসবেন নিচতলা ও দোতলায়, মক্কা থেকে আসা হাজিরা তৃতীয় তলায়, উত্তর দিক ও মোয়াইসিম থেকে আসা হাজিরা চতুর্থ তলায় এবং আজিজিয়া থেকে আসা হাজিরা পঞ্চম তলায় উঠে পাথর নিক্ষেপ করবেন। ১২টি করে ঢোকার ও বের হওয়ার পথ আছে এখানে। এখন হাজিদের পাথর মারার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া আছে। মোয়ালেম নম্বর অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পাথর মারতে হয়। সৌজন্যে: প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *