ড. গুলশান আরা
মোয়াল্লেম জানালেন—সকালের নাস্তা সেরেই আমরা পবিত্র তায়েফ নগরী দেখতে যাবো। আপনারা রেডি হয়ে থাকবেন। শুনে আনন্দে মন যেন নেচে উঠলো— কার নাস্তা কে করে? আমরা রেডি।
মিসফালা ব্রিজের কাছে হেঁটে গিয়ে টেক্সিতে বসলাম। মক্কা নগরী ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। সামনে এগিয়ে চলেছি। দুই পাশের দৃশ্যে পাহাড়, পাহাড় এবং পাহাড়। যতই দেখছি কাছ থেকে কিম্বা দূরে ততই মুগ্ধ হচ্ছি। থরে থরে পাথর সাজানো পাহাড়—কোন কোনটি কেটে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হচ্ছে। মক্কা থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরে তায়েফ- যেতে সময় লাগছে। এক স্থানে গিয়ে গাড়িতে জ্বালানি নেয়া হলো—ড্রাইভার জানালেন—তায়েফের কাছাকাছি চলে এসেছি- বলতে গেলে এখান থেকেই তায়েফ শুরু।
অবাক করা বিচিত্র রঙের পাথর দিয়ে কে যেন পাহাড় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। সেই সব অনিন্দ্য সুন্দর পাহাড়ের পাদদেশ কেটে তৈরি হয়েছে দুই লেন বিশিষ্ট রাস্তা। একটি উপরে উঠার- অন্যটি নামার। পাথরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখছি আর উপরে উঠছি। উঠছি তো উঠছিই, উঠার যেন শেষ নেই! হাতের ডান পাশে পাহাড়—বাম পাশ শূন্য। দেখলে গা ছমছম করে। যদি হঠাৎ পড়ে যাই—কি হবে ধারণা করতেও ভয় লাগে। আগেই আমাদের বলা হয়েছিল—কেউ যেন নিচের দিকে না তাকাই। তাকালে মাথা ঘুরবে—বমি বমি লাগবে।
গাড়ি চলছে-চলছে এবং চলছেই। কোথা সেই তায়েফ নগরী? অবশেষে সমতলের মত জায়গায় উঠে এলো গাড়ি।—এই যে এটাই তায়েফ। সত্যি! পেলাম তা হলে তায়েফ!! যার দেখার জন্য এত আকুলতা।
বাম দিকে চোখ যেতেই দেখলাম সমৃদ্ধ এক নগর। পাহাড়ের উপর নগর- অথচ দেখে বুঝবার উপায় নেই, মনে হবে সমতলে গড়ে উঠেছে এক নগর সভ্যতা। যতই এগিয়ে যাচ্ছি চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ছে মুগ্ধতা। এত নগর নয়—যেন বেহেস্ত। কি চমত্কার স্নিগ্ধ বাতাস- আকাশ এমন নীল হতে পারে জানা ছিল না। সত্যিকারের নীল দেখতে হলে তায়েফের আকাশ দেখতে হবে। আসার পথে দেখেছি মেঘ রৌদ্রের খেলা। যেন পাহাড়ের পিঠ বেয়ে সূর্য মেঘের সাথে খেলতে খেলতে উপরে উঠছে। এখানে এসে দেখলাম শরতের আকাশ- সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াছে।
মাইলের পর মাইল পেরিয়ে এলাম—লোকজনের তেমন দেখা পেলাম না। পার্ক, শিশুপার্ক, বিশ্রামাগার কত কিছুই না পড়ে আছে ছবির মতন। কিন্তু সে সবে মানুষ নেই।
সুনসান নীরবতায় মসজিদ। আমরা নামাজ পড়লাম দুই রাকাত। তামীম ছবির পর ছবি তুলছে আপন মনে। আমাদের ছবিও তুললো ফুল সাজানো আইল্যান্ডের পাশে।
আমরা গাড়িতে উঠলাম—গাড়িতে বসে দেখলাম আঙুর বাগান, আনার বাগান।
গাড়ি এসে থামলো এমন জায়গায় যার কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। যে ইহুদী বুড়ি পথের মধ্যে কাঁটা পুঁতে রেখে নবীজী (সা:)কে কষ্ট দিতো—নবীর কষ্ট দেখে যে খিল খিল করে হাসতো সেই বুড়ির বাড়ির কাছে।
সামনে একটি মসজিদ- মনে হলো নবীর আমলে তৈরি এবং এখনও সেই আদলেই আছে। আমরা দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিলাম।
বুড়ির বাড়িটি একটু উপরে। ছোট বড় পাথর পেরিয়ে উঠতে হলো। এটিও বোধ হয় আগের ফর্মেই আছে। পাথরের ছোট্ট একটি ঘর- ছোট্ট দুটি কক্ষ। ছিল বাতি রাখার ত্রিভূজ আকৃতির জায়গা—সে দেয়ালটি অক্ষতই আছে। আমরা অতি উত্সাহে বুড়ির ঘরে ঢোকার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। বাড়ির সামনে খুবই চওড়া পাতার ফণি-মনসার ঝোঁপ, টস্টসে পাতায় অনেকেই নাম লিখে গেছে- আমরাও নিজেদের নাম লিখলাম- নেমে এলাম ঢালু পথে।
টেক্সি এবার ছুটলো যেখানে নবীজীকে রক্তাক্ত করেছিল অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থাকা তায়েফবাসী। তারা রসুলের দ্বীনের দাওয়াত গ্রহণ করেনি বরং তাঁকে নির্দয়ভাবে পাথর দিয়ে আঘাত করেছে! কিন্তু দয়ার নবী তাদের অভিশম্পাত্ করেননি- দোয়া করেছেন, তাদের হিদায়েত চেয়েছেন রাব্বুল আলামীনের দরবারে। সেখানেও অত্যন্ত চমত্কার একটি মসজিদ রয়েছে—কিছুটা আগের আদলেই সেখানেও নামাজ আদায় করলাম। অতি উত্সাহে একেবারে উপরে উঠে গেলাম। পা কাঁপছে—কিন্তু উত্সাহ এত প্রবল যে, ঐ কাঁপাকে থামাতে পারছে না- পিলারে পেঁচিয়ে ওঠা খাড়া সিঁড়ি।
এবার ফেরার পালা। পথে চোখে পড়লো প্রাচীন আমলের একটি পাত কুয়া। গাড়ি এগিয়ে চলেছে।
ঢালুতে নামতে গিয়ে পথের দৃশ্য আরো যেন দৃশ্যমান হলো। সর্পিল সেই পথ চোখের মণিতে এঁটে রইলো। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরছে ঝর্ণার পানি। প্রচুর বৃষ্টি হয় সে-পানি নেমে যাবার জন্য পথের মাঝে মাঝে ব্রিজ আছে। ড্রাইভার আমাদের উত্সাহ দেখে এক জায়গায় টেক্সি থামালেন। দেখলাম- পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে আরো জনবসতি রয়েছে।
উপর থেকে দেখা গেল দূরের পাহাড়গুলো যেন মেঘের মধ্যে ডুবসাঁতার কাটছে। কাছে গেলেই মেঘ ছোঁয়া যাবে।
এত মনোরম- নয়ন হরণ দৃশ্য অন্যকোন শহর বা পাহাড় থেকে দেখা যায় কি-না জানি না। সে কারণেই হয়তো তায়েফ আমার কাছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগর যা বারবার দেখলেও আবার দেখার সাধ জাগবে। সৌজন্যে : ইত্তেফাক