Skip to content

তুরং ছড়ার পথে

Turangchara

মো. জাভেদ হাকিম
বৃষ্টিভেজা গভীর রাত। আমাদের গাড়ি ছুটছে সুনসান নিরিবিলি রাজপথ ধরে। বাসের একঘেয়ে যান্ত্রিকতা ছাড়া সব নিশ্চুপ। তবু কেন জানি ঘুম আসে না চোখে। অগত্যা সারা রাত সহযাত্রীদের সঙ্গে চলল নানা গপসপ। একরকম নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকাল ৯টার মধ্যে পৌঁছে যাই সিলেটের বাদাঘাট। আগে থেকেই সেখানে আমাদের জন্য নোঙর করা ছিল বিশাল এক বালুর কার্গো। সেটা এতটাই বিশাল যে তাতে সহজেই এটে যাবে কয়েক শ যাত্রী। ৯ জনের এক দলের জন্য—এ যেন মশা মারতে কামান দাগানো।

বাদাঘাট থেকে কার্গো যাত্রা করে ডাকাতি হাওরে এসে পড়ে। বর্ষায় হাওরটা অপরূপ সাজে সেজেছে। একসময় তো মনে হলো সিলেট নয়, সুন্দরবনের কোনো খাল দিয়ে যাচ্ছি। হাওর পেরিয়ে ধলাই নদীতে এসে উঠল আমাদের কার্গো। চারদিকে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। যেদিকে তাকাই, যা দেখি, তাই ভালো লাগে। এটাই বর্ষা ঋতুর জাদু।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর কোম্পানীগঞ্জের দয়ারবাজারে পৌঁছি। সিলেট ট্যুরিস্ট ক্লাবের জামান ভাই খেয়াঘাটে এসেছেন ‘দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ’র বন্ধুদের স্বাগত জানাতে। অল্প কয়েক দিনের পরিচয় তবু আমাদের জায়গা দিলেন তাঁর বাড়িতে।

জুমার নামাজ পড়ে আর খেয়েদেয়ে বিকেলটা কাটাই মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ—ভোলাগঞ্জের জিরো পয়েন্টের সাদা পাথরের রাজ্যে। সঙ্গী-সাথিরা উজান থেকে নেমে আসা হিমশীতল পাথুরে ধলাই নদীতে জলকেলিতে মেতে ওঠে। গত তিন বছর আগে যখন এসেছিলাম, জায়গাটা বেশ পরিষ্কারই ছিল। আর এখন পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় জায়গাটার অবস্থা বেশ খারাপ। চারপাশে চিপসের প্যাকেট আর প্লাস্টিকের খালি বোতল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিদঘুটে এক অবস্থা। শেষে স্থানীয় কালাম ভাই ও অন্যদের সহযোগিতায় জায়গা কিছুটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি। ভ্রমণে গিয়ে যদি কমবেশি সবাই এ কাজে একটু সময় দিই, তাহলে আমাদের পরিবেশের জন্যই ভালো হবে।

একসময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। মাগরিবের নামাজ শেষে দয়ারবাজারের পথ ধরি। দয়ারবাজার এসে চাল-ডাল, মুরগি, তেল-মসলা কিনে জামান ভাইদের বাড়ির বিশাল উঠানেই চলে বারবিকিউর প্রস্তুতি। সঙ্গে ‘লেটকা খিচুড়ি’। আহা! খেয়েদেয়ে যাই এবার ঘুমোতে।

পরদিন সকালে হোটেলে নাশতা সেরে ছুটি হালের ক্রেজ হতে যাওয়া উত্মা ছড়ার পথে। কিছুটা পথ চলার পরেই চোখ আটকে গেল অধরা পাহাড়ের সবুজ গালিচায় মোড়ানো ক্যানভাসে। আরো কিছুটা পথ এগোলেই চোখে পড়ল পাহাড়ের গা বেয়ে অবিরাম ধারায় নেমে আসা ঝরনাধারা। মোটরবাইক থেকে নেমে আশ্চর্য হয়ে যাই—এমন চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশটাও ময়লা জিনিসপত্র ফেলে নষ্ট করে ফেলেছে। কী আর করা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এখানেও কিছুটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চালাই। সে পর্ব শেষ হতেই নেমে যাই একবারে মেঘালয়ের সীমান্ত ঘেঁষা এক পাহাড়ি ছড়ায়। এখানেই কেটে যায় বেশ খানিটা সময়। দেরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে এবার ছুটি তুরং ছড়ার পানে।

Turangchara2জায়গাটার খোঁ জ দিয়েছেন ভোলাগঞ্জের স্থানীয় ফারুক ভাই। যতই এগিয়ে যাই, ততই যেন মুগ্ধতা বাড়তে থাকে। সে এক অপার্থিব অনুভূতি। একে একে দৃশ্যপটে হাজির হয় আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে থাকা দিগন্ত ছোঁয়া পাহাড়, আবার সেই পাহাড়ে ভেসে থাকা শুভ্র মেঘের ভেলা, বিস্তৃত ফসলের মাঠ।

মোটরবাইক ছেড়ে এবার গ্রামের মেঠোপথ ধরি। সামান্য কিছুটা পথ মাড়িয়ে হাজির হই তুরং ছড়ার জমিনে। চারপাশটা বেশ নিরিবিলি। নিঝুম নিস্তব্ধতার তুরং ছড়ার একমাত্র সঙ্গী পাথরের গা ভিজিয়ে অবিরাম ধারায় ধেয়ে আসা স্বচ্ছ পানির কলকল ধ্বনি। এমন নয়নজোড়ানো প্রকৃতির কাছে হার মেনে আবারও নিজেদের সমর্পণ করি ছড়ার হিমেল জলে। পানির স্বচ্ছতা এতটাই যে হাঁটু সমান পানির নিচের পাথরগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এই ছড়াকে অনেকে আবার ‘কুলি ছড়া’ নামেও চেনে। এখনো এখানে পা পড়েনি প্রকৃতি বিনষ্টকারী পর্যটকদের। ফলে জায়গা বেশ পরিষ্কারই আছে। সবুজ বৃক্ষ, লালচে-বাদামি রঙের পাথর—সব মিলিয়ে তুরং যেন অন্য এক জগৎ। তুরংয়ের সৌন্দর্যেই কিনা পথ ভুলে আমাদের দলের একজন ছড়া ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিল ভারতের চেরাপুঞ্জিতে। যখন সে তার ভুল বুঝতে পারল তখন তার অবস্থা ‘ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি’। অবশ্য কোনো ঝামেলা ছাড়াই আবার সে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন(!) করতে পারল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। বন্ধুটি ফিরে এসে সে জায়গার যে বর্ণনা দিল তাতে আমার আফসোস বাড়ে। এবার বিদায়ের পালা। আজই ছুটব বড়লেখার উদ্দেশে।

কিভাবে যাবেন
ঢাকার গাবতলী ও সায়েদাবাদ থেকে সিলেটে যাওয়ার বিভিন্ন বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৪৫০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। এ ছাড়া ট্রেনে ৩৬০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা। সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে সিএনজিতে কোম্পানীগঞ্জ দয়ারবাজার। ভাড়া জনপ্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। এ ছাড়া বর্ষায় সিলেটের বাদাঘাট থেকে নৌপথে দয়ারবাজার যাওয়া যায়। ভাড়া জনপ্রতি ২২০ টাকা। সেখান থেকে আবারও সিএনজিতে ১২ কিলোমিটার দূরবর্তী চড়ারবাজার যেতে হবে। ভাড়া জনপ্রতি ৪০ টাকা। বাজার থেকে ১০ মিনিট হাঁটলেই দেখা মিলবে উত্মা ছড়ার। আর তুরং ছড়া যাওয়ার জন্য কোনো বাহন নেই, দুই পা-ই সম্বল। উত্মা ছড়া থেকে তুরংয়ের দূরত্ব দুই কিলোমিটার। যাঁরা ঢাকা বা অন্য কোনো জেলা থেকে মাইক্রোবাস নিয়ে যাবেন, তাঁরা অবশ্যই গাড়ি সিলেট শহরে রেখে সিএনজি কিংবা ট্রলারে কোম্পানীগঞ্জ যাবেন। কারণ রাস্তার অবস্থা খুবই শোচনীয়। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *