:: মুহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ::
গ্রামের বুক চিরে চলে গেছে ইটের আঁকাবাঁকা সরু পথ। দুই পাশে তৈরি করা হয়েছে গোলাপের বাগান। উঁচু জমিগুলো ছেয়ে আছে গোলাপে। লাল, হলুদ, সাদা- কত বর্ণের যে গোলাপ তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গ্রামের পর গ্রাম একই নান্দনিক দৃশ্য। বাতাসে ভেসে আসা ফুলের সৌরভ মন মাতাবে আপনার।
ঢাকার একেবারে কাছে। তুবও পথটা নদীঘোরা। রাজধানীর উপকণ্ঠে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নে তুরাগ নদের কোলঘেঁষে অন্তত ছয়টি গ্রামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হয় গোলাপের। বছরজুড়েই এ ছয় গ্রামে ফুল থাকে। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় সাদুল্লাপুর গ্রামে। এই গ্রামে কৃষি অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এই গোলাপের চাষ। এখানকার কৃষকের ৯০ ভাগই গোলাপ চাষ করছেন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। প্রান্তিক চাষিরাও এখন ঝুঁকছেন গোলাপ চাষে।

গোলাপের বাগানে বৃষক।
ঢাকার মিরপুর দিয়াবাড়ি ট্রলার ঘাট থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের পথ, তারপর সাদুল্লাপুর গ্রাম। ট্রলার থেকে নেমে রাস্তার দুই পাশে সারি সারি গোলাপ বাগান।
সাদুল্লাপুর গ্রামে মূলত মিরান্ডা প্রজাতির লাল গোলাপের চাষ হয়। এজন্য গ্রামটি লাল গোলাপের গ্রাম বলে পরিচিতি পেয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে সাদা গোলাপ, জারবেরা ও গ্ল্যাডিওলাস ফুলের বাগান।
ঢাকার আশেপাশে অল্প সময়ের জন্য কোথাও ঘুরে আসতে চাইলে সাদুল্লাপুর হতে পারে উপযুক্ত জায়গা। যাত্রা পথে যেমন নদীর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায়, তেমনি গোলাপের সৌন্দর্যও দেখা যায় কাছ থেকে। আর হেঁটেই ঘুরে দেখা যায় পুরো গ্রাম।
যাওয়ার পথ: রাজধানীর যেখানেই থাকুন প্রথমে আসতে হবে দিয়াবাড়ি বটতলা ঘাটে। এই দিয়াবাড়ি কিন্তু উত্তরার দিয়াবাড়ি নয়। এটি মিরপুর বেড়িবাঁধে। যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, ফার্মগেট হয়ে মিরপুর বেড়িবাঁধে যাওয়ার বাস সার্ভিস আছে। এছাড়া মিরপুর এক নম্বর সেকশন অথবা মিরপুর-১০ কিংবা গাবতলী থেকে রিকশায় সহজেই যাওয়া যায় দিয়াবাড়ি বটতলা ঘাট। এখান থেকে শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকা ১০ মিনিট পরপর ছেড়ে যায় সাদুল্লাপুরের দিকে। স্পিডবোট, কোষা নৌকা, শ্যালো নৌকা চুক্তিতে ভাড়া নিয়েও যাওয়া যায় সাদুল্লাপুর। হেঁটেই পুরো সাদুল্লাপুর চক্কর দেয়া যায়। আবার গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া পিচঢালা পথে রিকশা নিয়েও ঘোরা যায়। সবচেয়ে ভালো রুট হচ্ছে বিরুলিয়া ব্রিজের রুট। কারণ এই পথে দারুণ সব গোলাপের ক্ষেত রাস্তার দুপাশ জুড়েই। একেবারে পুরো রাস্তা। অটো থামিয়ে থামিয়ে সবগুলো গোলাপের বাগান দেখা যাবে। আর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে মিরপুর বেড়িবাঁধ ধরে বিরুলিয়া ব্রিজ হয়ে সোজা গেলে আকরান বাজার। বাজার থেকে বাঁয়ের পথ ধরে এগোলেই দেখা মিলবে গোলাপ রাজ্যের।

গোলাপ যাচ্ছে হাটে।
গোলাপের হাট: স্থানীয় ফুল চাষিরা নিজেদের প্রয়োজনে এ গ্রামেই গড়ে তুলেছেন হাট। শ্যামপুরে প্রতি সন্ধ্যায় বসে গোলাপের হাট। সেখানকার আবুল কাশেম মার্কেটের সামনে সন্ধ্যায়ই শুরু হয় ফুল ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য ব্যবসায়ী এসে ভিড় জমান সেখানে। জমতে থাকে বেচাকেনা। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। এ ছাড়া মোস্তাপাড়ায় রয়েছে সাবু মার্কেট। এ মার্কেটেও গোলাপ বেচা কেনা হয়। পরে এই ফুল ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয়ে থাকে। ভ্রমণকারীরা চাইলে বাগান থেকে সরাসরি ফুল কিনে নিতে পারেন। নিজের পছন্দমতো ফুল কাটিয়ে নেয়া যায়। খুচরা কিনলে দাম পড়ে পাঁচ টাকা করে। সাধারণত ফুল বিক্রি হয় মুঠি হিসেবে। এক মুঠিতে থাকে ৫০ থেকে ১০০ গোলাপ। ফুলের আকার এবং সিজন ভেদে দাম ওঠানামা করে। গোলাপের চাহিদা থাকে সব সময়। তাই চাষিরাও সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ উৎসবের দিনগুলোতে চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ।
খাবার: দুপুরের খাবার সাথে নিয়ে যাওয়াই ভালো। তবে সাদুল্লাপুর ঘাটের কাছে হোটেল আছে। ঘাটের বটতলার হাটে মিরচিনি, মুরালি, দই, মিষ্টিসহ অসাধারণ সব খাবার পাবেন। গরুর দুধের চা ও দুধ মালাইয়ের স্বাদ নিতে পারেন। মনে রাখার মতো স্বাদ। দল বেঁধে গেলে হোটেলের লোকদের আগেই রান্না করার কথা বলতে হবে।
যেভাবে শুরু: স্থানীয়দের দেয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় ২৫ বছর আগে সাভারের অজপাড়া মোস্তাপাড়া গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে গোলাপ ফুলের চাষ শুরু হয়। এলাকার মাটি ফুল চাষের জন্য বেশ উপযোগী হওয়ায় এখানে গোলাপ চাষে সাফল্য আসে। ক্রমে এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ বাড়তে থাকে। ১৯৮১ সালের দিকে হল্যান্ড থেকে মিরান্ডি জাতের বীজ এনে রাজধানীর মিরপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বপন করা হয়। তখনই এ দেশে মিরান্ডি ফুলের চাষ শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে বোটানিক্যাল গার্ডেনের একজন গবেষক মোস্তাপাড়া গ্রামে মিরান্ডি ফুলের বীজ বপন করেন। এরপর এ অঞ্চলে শুরু হয় গোলাপ ফুলের চাষ ও ব্যবসা। পরে তা সাভার, সিংগাইরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

বিক্রির জন্য বাগান থেকে তোলা হচ্ছে গোলাপ।
লাভ ও খরচ: কৃষকরা জানিয়েছেন, জৈব ও রাসায়নিক সার, বীজ, কীটনাশকসহ বছরে প্রতি হেক্টর জমিতে ফুল চাষে খরচ হয় প্রায় সাত লাখ টাকা। শীতে পোকামাকড়ের প্রকোপ কম থাকলেও গরমে বেশি থাকে। এ কারণে কীটনাশক দিতে হয়। নিয়মিত পানি সেচ, সার ও পরিচর্যা ছাড়া ভালো গোলাপ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। প্রতি হেক্টরে বছরে ১৫ লাখ ফুল উৎপাদন হয়। গড়ে একটি ফুল এক টাকা করে বিক্রি করলে পাওয়া যায় ১৫ লাখ টাকা। বর্তমানে ফুলের পাইকারি দাম তিন থেকে সাড়ে তিন টাকা। কিন্তু কখনো কখনো প্রতিটি ফুল এক টাকায়ও বিক্রি করা যায় না।
গ্রামের সবাই ভাড়া থাকেন: সাদুল্লাপুর গ্রামটি নবাবদের বাইগুন বাড়ি নামে খ্যাত। এটি ছিল ঢাকার নবাবদের সংরক্ষিত শিকার কানন। বাইগুন বাড়িতে নবাবদের একটি প্রাসাদ ছিল। নবাব আহছানউলাহ নির্মিত একটি মসজিদ ছিল। এখন আর সেসবের কিছুই নেই। শুধু কাছারি ঘরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। পুরো সাদুল্লাপুর এখনো নবাব এস্টেটের আওতাভুক্ত। তাই গ্রামবাসীর নিজস্ব কোনো জায়গাজমি নেই। এমনকি তাদের বসতভিটার মালিকও তারা নন। এস্টেট থেকে জায়গা ইজারা নিয়ে তারা বাস করছেন, আবার চাষবাসও করছেন। এক কথায় বলতে গেলে, সাদুল্লাপুর একটি ভাড়ার গ্রাম। বাংলাদেশে এমন কোনো গ্রাম আছে বলে জানা নেই।
সতর্কতা : গোলাপের বাগান ঘুরে দেখার সময় প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি ফেলে আসবেন না।