Skip to content

থমকে যাওয়া প্যারিসের ডায়েরি

সুমন ইউসুফ প্যারিস থেকে
ফন্দাসিয়ঁ আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের আমন্ত্রণে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে যোগদানের জন্য আমার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে আসা। ৩ নভেম্বর পা রাখি প্যারিসের মাটিতে। তখন কি ভেবেছিলাম যে ঠিক ১০ দিন পর থেকে দেখতে হবে থমকে যাওয়া প্যারিস। সাধারণত প্যারিসে নভেম্বরকে বলা হয় ‘উৎসবের মাস’। এই মাসে আলোকচিত্র, পেইন্টিং, চলচ্চিত্র, গান, নাটক ইত্যাদি নিয়ে প্রদর্শনী চলে প্রচুর। সারা দিন ঘুরে ঘুরে শহরের বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শনী দেখি আর বিকেলে নিজের প্রদর্শনীর গ্যালারিতে সময় দিই।

Paris

প্যারিসের প্লাস দো লা রেপুবলিক চত্বরে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করছে। ছবি: সুমন ইউসুফ

১৩ নভেম্বর রাতে প্যারিসে ক্রমিক হামলার পর এ কদিন শহরের জীবনযাত্রা সত্যিই থমকে গেছে। শহরের রেস্তোরাঁ ও পানশালাগুলোতে আর ভিড় নেই। তরুণেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিচ্ছে না সেসব জায়গায়। বিনোদনকেন্দ্রগুলো ফাঁকা। অনেকেই ট্রমায় আক্রান্ত। মনে হচ্ছে এই বুঝি আবার হামলা হবে। কোথাও কোনো বিকট শব্দ হলেই সবাই ভয়ে ছোটাছুটি করছে। শহরের চারপাশ ঘুরে দেখলে মনে হয় যেন হঠাৎ কেউ একটা বিশাল আনন্দের মিছিল থামিয়ে দিয়েছে। ফরাসিরা যেন এক প্রাণহীন জীবন যাপন করছে।

Paris2

বাতাক্লঁ কনসার্ট হলের সামনে ফ্রান্সের জাতীয় পতাকায় সন্ত্র​াসী হামলার প্রতিবাদে লেখা স্লোগান পড়ছেন এক নারী।

ঘটনার দিন ১৩ নভেম্বর রাত নয়টায় প্যারিসের ‘বাঙালিপাড়া’ লা শাপেলে ছিলাম। চারদিকে তখনো হইচই, আনন্দ, উত্সব—ফ্রান্স বনাম জার্মানির ফুটবল খেলা নিয়ে। রাতের খাওয়াটা আমি এখানেই সেরে নিই। রাত ১০টার দিকে আমার রুমের উল্টো দিকে সিয়েন নদীর পাশে হাঁটছি। হঠাৎ রাস্তায় লক্ষ করলাম বেশ কিছু অ্যাম্বুলেন্স ইমার্জেন্সি সাইরেন বাজিয়ে ছুটছে। কিছুক্ষণ পরই একটা ভিভিআইপি স্কট। আমার মনে হলো কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে শহরের কোথাও। রুমে ফিরে গিয়ে ফেসবুক খুলতেই আমার এক ফরাসি বন্ধুর বার্তা পেলাম ‘আর ইউ সেফ?’। সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক আমার প্রোফাইলে একটা ‘সিকিউরিটি অ্যালার্ট’ দিল—‘আর ইউ সেফ ইন প্যারিস?’ অর্থাৎ আমি প্যারিস শহরে নিরাপদ আছি কি না। আমার ঘরে টিভি নেই। ইন্টারনেটে বিবিসি লাইভ স্ট্রিমিং খুলতেই দেখলাম প্যারিসের তিনটি জায়গায় সন্ত্রাসী হামলায় ২০ জন নিহত। এর মধ্যে বাতাক্লঁ কনসার্ট হলে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। রাত দুইটা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে গেল। আক্রান্ত স্থানের সংখ্যা তখন ছয়। সকালে ছবি তুলে ঢাকায় অফিসে পাঠাব—তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম।

ভোরে বেরিয়ে পাতাল ট্রেনে উঠব, এমন সময় আমার কর্মস্থল প্রথম আলো থেকে ছবি পাঠানোর নির্দেশ এল। গাহ্ দো নর্দ স্টেশনে নেমে আমি হতভম্ব। রাস্তায় মানুষ নেই। চারপাশ দেখে মনে হচ্ছে একটা বড় ঝড় গেছে গত রাতে এই শহরের ওপর দিয়ে। যাই হোক, দেড় মাইল হেঁটে ঘটনাস্থল বাতাক্লঁ কনসার্ট হলের সামনে পৌঁছালাম। প্রায় ৪০০ গজ জায়গা নিরাপত্তাবেষ্টনী দিয়ে রাখা হয়েছে। দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, ফটোসাংবাদিক ভিড় করছেন বেষ্টনীর সামনে ছবি তোলার জন্য, সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। বিবিসি, সিএনএনসহ ফ্রান্সের স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলো একটু পরপর লাইভ আপডেট দিচ্ছে। আমি ছবি তুললাম।

Paris3

হামলার খবর জানাচ্ছেন এক সংবাদকর্মী

বেশ কিছুক্ষণ পর গেলাম প্লাস দো লা রেপুবলিক চত্বরে। সকাল থেকে শত শত মানুষ এসে ফুল আর মোমবাতি জ্বালিয়ে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। কেউ কাঁদছে। কেউ নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেল গত রাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সে এই প্রথম কোনো সন্ত্রাসী হামলায় একসঙ্গে এত মানুষ মারা গেল।

ছবি তোলার একপর্যায়ে দেখা হয়ে গেল মার্কিন আলোকচিত্রী জন লোয়েনস্টেইনের সঙ্গে। তিনি নেদারল্যান্ডসের এনওওআর ফটো এজেন্সির জন্য কাজ করেন। জন প্যারিস এসেছেন তাঁর বাগদত্তার সঙ্গে দেখা করতে। আগের দিন মাত্র পা রেখেছেন প্যারিসে। জনের মতে, পৃথিবীজুড়ে এই যে ঘৃণ্য জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলায় সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে, এর বিরুদ্ধে আমাদের সব শ্রেণির মানুষকে এক হতে হবে। আলোকচিত্রী হিসেবে শুধু ঘটনা ঘটার পর ছবি তুলে গেলে চলবে না। এই ছবি দিয়ে মানুষকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুলতে হবে।

Paris4

আক্রান্ত ক্যাফের জানালায় বুলেটের আঘাত,বাতাক্লঁ কনসার্ট হল, সেই রাতে কনসার্ট চলার সময় এখানেই সবচেয়ে বেশি মানুষ হতাহত হয়,নিরাপত্তার কারণে বন্ধ ছিল ল্যুভ মিউজিয়াম। গতকাল শুক্রবার আবার খোলা হয়েছে ,ফ্রান্সের শীর্ষস্থানীয় প​িত্রকা ও সাময়িকীতে হামলার খবর

প্যারিস সময় দুপুর নাগাদ ঢাকার অফিসে ছবি পাঠিয়ে দিলাম। এই শহরে আমার পরিচিত বাঙালি-অবাঙালি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। এর মধ্যে ফন্দাসিয়ঁ আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের প্রেসিডেন্ট জেহম ক্ল্যামোঁ সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, ‘আমরা গভীরভাবে শোকাহত। তবে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা ফ্রান্সের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করতে পারবে না। ফরাসিরা আরও সোচ্চারভাবে তাদের প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা ও মেধা দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করবে।’

এদিকে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সে পাঁচ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯ নভেম্বর রাতে সরকার জরুরি অবস্থার মেয়াদ আগামী তিন মাসের জন্য বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। বিশেষ নিরাপত্তাজনিত কারণে আইফেল টাওয়ার থেকে শুরু করে সব জাদুঘর, ঐতিহাসিক স্থান, নিদর্শন, দুর্গ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় ঘটনার পরপরই। তবে ল্যুভ মিউজিয়াম খুলে দেওয়া হয়েছে গতকাল শুক্রবার থেকে। আর বাকিগুলো ২৩ নভেম্বর থেকে খোলো হবে।

সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে রাস্তায় পুলিশি তল্লাশি চলছে। এখনো এ তল্লাশি রয়েছে। পাতাল ট্রেনে বিশেষ নিরাপত্তার জন্য সেনা মোতায়েনও রয়েছে। পাতাল ট্রেন স্টেশন, বাস স্টেশন, রেলস্টেশন ও বিমানবন্দরে একটু পরপর পুলিশের জরুরি সাহায্য পাওয়ার ফোন নম্বরসহ ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।

Paris5১৬ নভেম্বর বিকেলে সিয়েন নদীর ওপর ‘লাভার ব্রিজ’ দিয়ে হাঁটছি। প্রেমিক-প্রেমিকারা নিজেদের ভালোবাসার বন্ধন অটুট রাখতে লাভার ব্রিজের রেলিংয়ে তালা ঝুলিয়ে রাখে। হঠাৎ দেখলাম অসংখ্য টিভি ক্যামেরা নত্র দাম গির্জার দিকে তাক করা। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম সন্ধ্যায় প্যারিসের সবচেয়ে বড় এই গির্জায় নিহত ব্যক্তি-দের জন্য বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। আমি সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিলাম গির্জার দিকে।

নত্র দাম গির্জার ভেতরে মানুষের জায়গা না হওয়ায় হাজার হাজার মানুষ বাইরে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা সভায় অংশ নিচ্ছে। কোনোমতে ভিড় ঠেলে পুলিশি নিরাপত্তা পেরিয়ে গির্জার মূল ফটকের কাছে যেতেই আমাকে দুজন নিরাপত্তাকর্মী বললেন, ‘আপনার প্রেস কার্ড দেখান। প্রথম আলোর পরিচয়পত্র দেখাতেই ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলল। অসংখ্য ফটোসাংবাদিক ছবি তুলছেন। এর মাঝে একনজর চোখে চোখে কুশল বিনিময় হয়ে গেল ইতালীয় আলোকচিত্রী পেওলো পলগ্রিনের সঙ্গে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাগনাম ফটোস এজেন্সির সঙ্গে কাজ করেন।

Paris6

প্লাস দো লা রেপুবলিকের ভাস্কর্য

ফ্রান্সের এই সময় নিয়ে ফরাসি শিল্পী ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা জন ফিলিপ পারনো বললেন, ‘আমাদের বদলাতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তাধারা বদলাতে হবে। সন্ত্রাসী হামলা ফ্রান্সে হয়েছে বলে শুধু ফ্রান্সই ঝুঁকিতে আছে, তা নয়। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীর সব দেশের ভবিষ্যৎকেই অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। সবার আগে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে।’

আমার অনেক পুরোনো এক বন্ধু আছেন প্যারিসে—শাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারলাম, ফরাসি সরকার খুব ভালোভাবে জানে এ ঘটনা কারা কী উদ্দেশ্যে ঘটিয়েছে এবং অচিরেই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে।

ফ্রান্সের সবচেয়ে পুরোনো ও বড় শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠান ‘সিতে আন্তারনেসিওনাল দেজ আর্ত’ প্যারিসের পোঁ মারি এলাকায়। এই প্রতিষ্ঠানের একটি রেসিডেন্সিতে আমি থাকি। সন্ত্রাসী হামলার পর দুদিন এখানকার সব কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা হয়। আমাদের আলোকচিত্র প্রদর্শনী বন্ধ থাকে। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক জন ইয়েভ লংলে বলেন, ‘প্রতিবছর নভেম্বর মাসের জন্য আমরা অধীর আগ্রহে বসে থাকি। এই মাসে সব ধরনের শিল্পমাধ্যমের প্রদর্শনী ও উত্সবে মেতে থাকে প্যারিসের মানুষ। এই অপ্রত্যাশিত সন্ত্রাসী হামলা আমাদের শিল্পমনকে চরমভাবে আঘাত করেছে। ফ্রান্সবাসী একটা কঠিন দুঃসময় পার করছে। আমার বিশ্বাস, আমরা অচিরেই এই দুঃসময় কাটিয়ে উঠব এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে আমরা সেদিকে বিশেষভাবে সতর্ক হব।’

ফ্রান্স শিল্প ও সাহিত্যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছে পৃথিবীজুড়ে। বিশেষ করে ইউরোপজুড়ে তাদের উন্নয়ন সব ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো। ফরাসি শিল্পী, কবি ও লেখক, সংগীত ও স্থাপত্যবিদ্যা পৃথিবীতে এক দৃষ্টান্ত। এমন একটি দেশে চরমপন্থীদের দৌরাত্ম্য কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সৌজন্যে : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *