Skip to content

দারাশিকোর পরিমহলে

:: সজল জাহিদ ::

কাশ্মীর নিয়ে প্রথম গুগলে সার্চ করতে গিয়ে নানা রকম লোভনীয় আর অবিরত চোখ আটকে যায়, এমন শত শত ছবির মধ্যে যে ছবিটা সবার আগে আর একদম আলাদা করে আমার দৃষ্টি কেড়েছিল, সেটা এক পুরোনো রাজমহল। চারপাশে বিশাল সব সবুজ পাহাড়ের মধ্যে বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে এক পাহাড়ের সবুজের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে নিজের মহিমা আর আভিজাত্য জানান দিচ্ছিল সেই বনেদি রাজমহলটি।

বেশ অনেকক্ষণ ছবিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। সেই সঙ্গে মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম যদি কোনো দিন কাশ্মীর যেতে পারি বা যাই, তাহলে অবশ্যই আমার নিজের জন্য নিজের কাছে প্রথম দর্শনীয় স্থান হবে এই পুরোনো আভিজাত্যের প্রতীক, পাহাড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এই বনেদি রাজমহল, সেটা যেভাবেই হোক। দরকার হলে পাহাড় ট্র্যাক করে ওখানে যাব। কিন্তু যাবই।

তবে তখনো সবুজ পাহাড় আর সাদা উড়ে বেড়ানো মেঘেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত নিজের আভিজাত্য জানান দিয়ে যাওয়া এই রাজমহলের নাম আমি জানতাম না। আর এটি যে আসলে কোনো রাজমহলই না, সেটাও জানা ছিল না সেই সময়। এমনকি যখন কাশ্মীরে যাই, তখন পর্যন্ত আর কিছু জানতে পারিনি।

এই রাজমহলের নাম জেনেছি আমি অনেক দিন পরে, তাও প্রায় দুই বছর পরে। বারবার নানা জায়গায় গুগলের ছবি দেখতে গিয়ে জেনেছি যে এটার নাম পরিমল আর এটি সম্রাট শাহজাহানের বড় ছেলে দারাশিকোর লাইব্রেরি ও একটি কয়েক স্তরের বাগান মাত্র! দারাশিকো এটি তৈরি করেছিলেন সেই ১৭ শতকের মাঝামাঝি। তার মানে এক মোগল রাজপুত্রের লাইব্রেরি ও বাগানবাড়ি বলা যায় এটিকে।

তো সেই থেকে বিশাল সবুজ পাহাড়ের মধ্যে নিজের রাজসিক উপস্থিতি জানান দিয়ে যাওয়া পরিমহল দেখতে যাওয়া কাশ্মীরে আমার একটি অন্যতম আকর্ষণ ছিল। যে কারণে পুরো একদিন আর দুটি নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ভীষণ ক্লান্ত আর অবসন্ন শরীরে যখন শ্রীনগরে পৌঁছালাম, তখন সবেমাত্র সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে। দিল্লি থেকে শ্রীনগরের উদ্দেশে আমাদের বিমান ছিল সকাল ছয়টায়। মাত্র এক ঘণ্টার উড়ান শেষে সাতটায় আমাদের বিমান শ্রীনগরে পৌঁছে যায়। ঘুমঘুম চোখে আগে থেকেই ঠিক করে রাখা গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

ডাল লেকের পাড়ে পৌঁছে গাড়ি থেমে যেতেই ঘুম ভেঙে গেল। সিকারায় করে নির্ধারিত হাউস বোটে গিয়ে পৌঁছাতেই আমার মনের মধ্যে পরিমহল দেখতে যাওয়ার বাসনা। কিন্তু সবাই দারুণ ক্লান্ত বলে ফ্রেশ হয়ে নাশতা করা পর্যন্ত চুপচাপ অপেক্ষা করলাম। কিন্তু নাশতা শেষ করতেই সবাই একটু নিজেকে এলিয়ে দিল হাউস বোটের নরম বিছানায়। কিন্তু আমার আর ঘুম আসে না, আমার মন তো সেই কখন থেকে পরিমহলে যাওয়ার জন্য ভেতরে-ভেতরে ছটফট করছে।

কিছু সময় পরে, সকাল প্রায় ১০টার দিকে সবার কাছে প্রস্তাব পেশ করা হলো পরিমহল আর আশপাশের মোগল বাগানগুলো দেখে আসার। সারা দিনের জন্য ৩ হাজার ৩০০ রুপির গাড়ি ভাড়া করা আছে। এখন না গেলে ওই টাকাটা পুরো জলে যাবে বলে সবাইকে সম্মত করলাম।

তারপর একটু ফ্রেশ হয়ে, রেডি হয়ে ডাল লেকের নরম জলের কোমল ঢেউ পেরিয়ে গাড়িতে করে ছুটে চলেছি কাশ্মীরে আমার নিজের কাছে অন্যতম আর প্রধান আকর্ষণ পরিমহলের দিকে। ভেতরে-ভেতরে আমি দারুণ উত্তেজিত আর রোমাঞ্চিত বোধ করছিলাম কাঙ্ক্ষিত সেই পরিমহলের কাছে যাচ্ছি বলে।

বিশাল সবুজ পাহাড়ের মধ্যে, সাদা মেঘেদের সঙ্গে মিতালি করে মাথা উঁচু করে শত শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারাশিকোর তৈরি আভিজাত্যে ভরপুর এই পরিমহল। আমাদের গাড়ি ডাল লেকের মাঝামাঝি গিয়েই ডানে বাঁক নিয়ে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে চলতে শুরু করল।

পথে যেতে যেতেই চোখে পড়ল নিশাত গার্ডেন আর চশেমশাহি নামে দুটি মোগল বাগানের প্রাচীন সৌন্দর্য। পরিমহল দেখে ফেরার সময় এই বাগানে আসব বলে ঠিক করে রাখলাম। আগে প্রথম আর প্রধান আকর্ষণ পরিমহল। প্রায় ১০ বা ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমাদের গাড়ি পরিমহলের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেল। ঠিক মনে নেই, ২০ বা ৩০ রুপি করে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম পরিমহলের অন্দরে।

পরিমহলে ঢুকেই একরাশ মুগ্ধতা যেন স্বাগত জানাল সবুজের গালিচা বিছিয়ে। সবুজের গালিচার চারপাশের বর্ণিল ফুলের আপ্যায়ন। একটু এগোতেই সবুজ গালিচা আর বর্ণিল ফুলের সঙ্গে যুক্ত হলো পরিমহলের ওপর থেকে ডাল লেকের টলটলে শরবতের মতো মিঠা জলের আহ্বান!

এ কী দেখছি পরিমহলে এসে! এসেছিলাম শুধু একটি প্রাচীন রাজমহল দেখব বলে। ইট, পাথরের কোনো এক পুরোনো, বনেদি স্থাপনা দেখব বলে। কিন্তু সেখানে এসে এমন রুক্ষ পাথরের কোনো এক স্থাপনার মধ্যে এমন সবুজের গালিচা, ফুলে ফুলে সুশোভিত বর্ণিল বাগান আর সেই বাগানের পাশের দেয়ালে বসে নিচের টলটলে জলের অপূর্ব ডাল লেকের দেখা মিলবে, স্বপ্নেও এমন করে ভাবিনি।

আর শুধু কি তা-ই? শুধু কি সবুজের গালিচা, ফুলের সমারোহ আর ডাল লেকের হাতছানি? পরিমহলের চারপাশজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ পাহাড়ের দেয়াল, পাহাড়ে পাহাড়ে মেঘেদের ওড়াওড়ি, আর কাছের সবুজ পাহাড়ের সিঁড়ি পেরিয়েই যেন পৌঁছে যাওয়া যাবে হাতছোঁয়া দূরত্বের তুষারে ঢাকা পাহাড়চূড়াদের ওপরে, নিমেষেই।

এমনই এক অপার্থিব পাহাড়ের দেয়ালে ঘেরা এক সবুজ পাহাড়ের মধ্যে, মেঘেদের ছোঁয়া আর ডাল লেকের দৃষ্টিসীমায় দাঁড়িয়ে নিজের আভিজাত্যের সবটুকু জৌলুশ ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে অবিরত এক অপার্থিব পরিবেশে অবস্থিত পার্থিব এক স্থাপনা— পরিমহল।

একটি চমৎকার মনে গেঁথে যাওয়ার মতো ঝলমলে দুপুর কাটিয়েছিলাম পরিমহলের সবুজের গালিচায়, ফুলের মধ্যে, ঝিরঝিরে বাতাসের স্পর্শে, ডাল লেকের দৃষ্টিসুখ, মেঘে ভেসে যাওয়ার মতো মিহি আর তুষারজড়ানো পাহাড়চূড়ার মতো অদ্ভুত আকর্ষণের সঙ্গে। প্রিয় আর কাশ্মীরের প্রথম আকর্ষণের পরিমহলে। সৌজন্যে: প্রথম আলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *