Skip to content

দিল্লিদর্শন!

আসফিয়া আজিম
‘দিল্লি কা লাড্ডু’ খেয়ে পস্তাব, কি না খেয়ে—এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলের মধ্যে এসে পৌঁছালাম ভারতের রাজধানীতে। আমাদের সাতজনের এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দল। কারও ভালো লাগে প্রকৃতি, কারও পছন্দ ঐতিহাসিক স্থান, কেউ ভালোবাসে খেতে, আর কারও বা স্বাচ্ছন্দ্য মুঠোফোনের গেমে। দিল্লিও যেন তাই প্রস্তুত সবার আগ্রহ আর ভালো লাগাকে জায়গা করে দিতে।

India-Visit9

সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিক্ষেত্র।

দিল্লি মানেই ইতিহাস। তাই শুরুতেই উপস্থিত হই মুঘলদের আগের সিকান্দার লোধির আমলের এক মাজারে। আসলে জোড়া কবর। ‘জামালি-কামালি’ নামে পরিচিত লাল চুনাপাথর আর মার্বেলের সংমিশ্রণে তৈরি সূক্ষ্ম কারুকাজের অপূর্ব সুন্দর এই ছোট্ট মাজারটি। যত দূর জানা যায়, জামালি ছিলেন লোধি সাম্রাজ্যের একজন জনপ্রিয় সুফি কবি। উর্দুভাষী এই কবির কবিতার নিদর্শন পাওয়া যায় তাঁর মাজারের দেয়ালে, কবরখানার জানালায়। তবে রহস্য ঘিরে আছে পাশের কবরটি নিয়ে। কামালি নামের এই কবরটি কার, কেনই বা এই অজানা মানুষটি জায়গা করে নিয়েছেন সুফি কবির পাশে, তা নিয়ে আছে নানা মতান্তর আর জল্পনা।

অবশ্য রহস্যের এখানেই শেষ নয়। ‘জামালি-কামালি’ থেকে বেরিয়ে কুতুবমিনার দেখতে গিয়েও পেলাম আরেক অলৌকিকের সন্ধান। কুতুবমিনারের পাশেই সটান দাঁড়িয়ে আছে লোহার একটি স্তম্ভ। প্রত্নতাত্ত্বিক ও ধাতু বিশেষজ্ঞদের কাছে এই স্তম্ভটি এক পরমাশ্চর্যের বিষয়। দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝড়ে-জলে টিকে থাকা লোহার এই স্তম্ভটিতে কোনো এক অদ্ভুত কারণে কখনো মরচে পড়ে না। আর তাই পর্যটকদের কাছে এর আকর্ষণ অন্য রকম। স্তম্ভটিতে প্রাচীন লিপিতে লেখা আছে কিছু কথা। তাতে বাংলা অঞ্চলের নাম দেখে তো গর্বে আমাদের বুক ভরে গেল।

India-Visit10

সবুজ পটভূমিতে পদ্মফুলের মতো লোটাস টেম্পল

প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা ছেড়ে এরপর এগোই পুরোনো দিল্লির পথে। পুরোনো দিল্লির অলিগলির কাছাকাছি পৌঁছতেই নাকে এল কাবাব ভাজার অপূর্ব সুগন্ধ। রাস্তার পাশেই ছোট ছোট ভ্যানগাড়িতে ভাজা হচ্ছে হরেক পদের কাবাব। পরিচিত চিকেন টিক্কা, শিককাবাব, খিরি ও গুর্দার কাবাব তো আছেই, এসবের পাশাপাশি আরও বত্রিশ রকমের ভাজা। কাকরি, টেংরি, কস্তুরি, হারিয়ালি কত শত বাহারি নামের কাবাব। দিল্লিবাসী পথচলতি মানুষ প্লাস্টিকের প্লেটে কয়েক টুকরো কাবাব মুখ পুরেই রওনা হয়ে যাচ্ছে আপন গন্তব্যে। কতকটা যেন শীতের ঢাকায় ভাপা পিঠা কিনে খাওয়ার দৃশ্য।

নয়াদিল্লির পেটের ভেতরেই বিশাল এক উদ্যান। নাম ডিয়ার পার্ক। প্রাতর্ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পরদিন ভোরে ঢুকলাম এই পার্কে। নামের সার্থকতা প্রমাণ করতেই যেন পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য হরিণ। বোনাস হিসেবে রাজ্যের ময়ূর। বেশ অনেক রাজহাঁসও সঙ্গী হচ্ছে তাদের। বিস্ময় আরও বাকি ছিল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই দেখি চারপাশ জুড়ে আট-দশটি ময়ূর একসঙ্গে পেখম মেলেছে। প্রকৃতি-প্রেমিকদের জন্য বিশেষ দর্শনীয় এই পার্ক। কী নেই এখানে? বিরাট এক লেক, বাগান, রেস্তোরাঁ, স্বাস্থ্যচর্চার ব্যবস্থা, শিশুদের খেলার পার্ক—সব মিলিয়ে সারা দিন আলস্যে কাটিয়ে দেওয়ার মতো অপূর্ব এক জায়গা।

India-Visit6

ইন্ডিয়া গেট

আজ আমাদের গন্তব্য মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিক্ষেত্র। বিশাল এলাকা জুড়ে পারস্য ঘরানার বাগান আর ফোয়ারা। তার মাঝখানে লাল বেলেপাথর আর সাদা মার্বেলের সমাধিস্তম্ভ। এই সমাধিস্তম্ভের হাত ধরে মুঘল স্থাপত্যের সূচনা। অপূর্ব কারুকার্যময় এই সমাধিস্তম্ভই নাকি ছিল শাহজাহানের তাজমহল সৃষ্টির প্রেরণা। হুমায়ুন যেন আমাদের টানছেন। সমাধিক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আমরা যাই পুরানা কিল্লা দর্শনে। এর ভেতরেই সেই গ্রন্থাগার, যার সিঁড়ি থেকে তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে মৃত্যু ঘটেছিল সম্রাট হুমায়ুনের। ষড়ভুজ আকৃতির লাল বেলেপাথরের ছোট একটি গ্রন্থাগার। এতই সাধারণ, দেখে মনেই হয় না, কোনো বাদশার পদধূলি এখানে পড়তে পারে।

দিল্লি শহরের খ্যাতি তার স্ট্রিট ফুডের জন্য। তাই পানিপুরি, পাপড়ি চাট, পাও ভাজি—এসব চাখতে চাখতে ফেরা।

Delhi-Mosque

দিল্লি শাহী জামে মসজিদ

ইতিহাস-পর্ব শেষ করে পরদিন আমরা যাই অত্যাধুনিক স্থাপনা দেখতে, বাহাই ধর্ম অনুসারীদের উপাসনালয় লোটাস টেম্পলে। পদ্মফুলের আকৃতি নিয়ে পুরো স্থাপনাটি আকাশের দিকে উন্মুক্ত হয়ে আছে। সব ধর্মের মানুষের জন্য এই উপাসনালয়ের দরজা খোলা। সারি বেঁধে দলে দলে লোক ঢুকছে। ঘুরেফিরে দেখছে অনন্য এই স্থাপনাটি। আবার ফিরেও যাচ্ছে সারি ধরে। এর সবটাই হচ্ছে নিঃশব্দ প্রসন্নতায়, অনুপম শৃঙ্খলায়। বেরিয়ে আসি প্রশান্ত মন নিয়ে।

যাত্রা আবার পুরোনো দিল্লি। এবারের গন্তব্য নিজামুদ্দিন আউলিয়া আর কবি মির্জা আসাদুল্লাহ গালিবের মাজার। গন্তব্য মাজার, কিন্তু উদ্দেশ্য ‘করিমস’-এ মন ভরে খাওয়াদাওয়া করা। বলা হয়ে থাকে, দিল্লিতে গিয়ে ‘করিমস’-এ না খেয়ে যে ফেরত আসে, তার দিল্লি সফর ষোলো আনাই মিছে। ‘করিমস’ ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে খাদ্যরসিকদের রসনা তৃপ্ত করে আসছে। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে ভ্রমণ-অনুরাগীদের প্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল টিএলসি পর্যন্ত ‘করিমস’-এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিশ্বজুড়ে পত্রিকার পাতায় আর টিভি পর্দায় বারবার জায়গা করে নেয় ‘করিমস’।

India-ad

‘করিমস’-এর খ্যাতি তার কাবাব, মাংসের বিচিত্র রান্না আর বিরিয়ানির স্বাদে। সরু গলির ভেতরে আরও তস্য গলির মাথায় একেবারে গোবেচারা দর্শনের এই রেস্তোরাঁ থেকে বিরিয়ানি, চিকেন টিক্কা, তন্দুর, বিফ বাদামি পসন্দ আর কাবাব প্ল্যাটার খেয়ে যখন বেরোলাম তখন বিকেল। আজ আর কোনো ঘোরাঘুরি নয়। পরদিন অতি ভোরে রওনা দিতে হবে আগ্রার দিকে।

কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে প্লেনে সরাসরি দিল্লি যাওয়া যায়। যদিও ভাড়া কিছুটা বেশি, জনপ্রতি প্রায় ৩৫ হাজার টাকার মতো। কম খরচে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে ট্রেনে কলকাতা গিয়ে সেখান থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি যাওয়া যায়। জনপ্রতি খরচ পড়বে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার টাকার মতো। আবার ঢাকা থেকে ট্রেনে কলকাতা গিয়ে সেখান থেকে প্লেনে দিল্লি যেতে পারেন। খরচ এ ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি হবে, আনুমানিক ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকার মতো।

কোথায় থাকবেন
দিল্লিতে মাঝারি মানের হোটেলে খরচ দিনপ্রতি প্রায় চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে। তবে চাণক্য পুরির কাছাকাছি বিশ্ব যুব কেন্দ্রে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলে খরচ অনেক কম পড়বে। অনলাইনে বুক করার সুবিধা আছে। এ ছাড়া কারোলবাগে সস্তায় কিছু হোটেল পাওয়া যায়। সৌজন্যে : প্রথম আলো

Web-Design-&-Developmen

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *