Skip to content

দুই চাকায় চকরিয়া টু আলীকদম

বাবর আলী
ইয়াংছা বাজারের পরে মিরিঞ্জার পাহাড়টা চোখের সামনে আসতেই আমার আর ইশতির গলা শুকিয়ে গেল। এই ভয়াল দর্শন পাহাড়টা বেয়ে উঠতে হবে আমাদের? আরিফ ভাই যথারীতি নির্বিকার।

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই পথে খালি আপহিল আর আপহিল পড়ছে। নিজের পা দুটোর দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হতে লাগল। চোখের সামনে যে আপহিলটাই আসুক না কেন, মনে মনে ভেবে নিতাম এটাই বুঝি শেষ আপহিল। এর পরই নিশ্চয়ই দেখা মিলবে আকাঙ্ক্ষিত সেই ডাউনহিলের। সে আশায় গুড়েবালি। কোনো রকমে একটা আপহিল পার হতেই দেখতাম আমাদের পথ চেয়ে আছে আরো বিকট দর্শন কোনো আপহিল। ট্রেকিংয়ের সূত্রে এই রাস্তায় অবশ্য বহুবার আসা-যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আগের প্রত্যেকবারই এ রাস্তাটা হয় চান্দের গাড়িতে নতুবা বাসে বসেই পাড়ি দিয়েছি। চান্দের গাড়ির ছাদে বা বাসের জানালার ফাঁক গলে উপভোগ করেছি সবুজ কার্পেটে মোড়ানো উঁচু-নিচু পাহাড়ের সারি, বিস্তীর্ণ তামাক ক্ষেতের ওপর সকালের প্রথম আলোর কিরণ কিংবা শেষ বিকেলে পাহাড়সারির পেছনে মুখ লুকানো সূর্যদেবকে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাইকপ্যাকিং (সাইকেলে করে ক্যাম্পিংয়ের জন্য বের হওয়া) করার নিয়ত এবার। প্রাথমিক পরিকল্পনা চকরিয়া থেকে পাহাড়ি পথে সাইক্লিং করে লামা হয়ে আলীকদম যাওয়ার। রাতটা কাটানোর ইচ্ছা কোনো এক উঁচু পাহাড় চূড়ায় ক্যাম্পিং করে।

Alikadam2

পরিকল্পনামাফিক সাইকেল, তাঁবু, ব্যাক-প্যাকসমেত সকাল-সকাল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে হাজির ইশতি আর আরিফ ভাই। ওদের সঙ্গে যোগ দিলাম শাহ আমানত সেতুতে। সাইকেলগুলো বাসের পিঠে তুলে দিয়ে ঢুকে গেলাম ওটার পেটে। মোবাইলের গুগল ম্যাপে সাইক্লিং রুটটা ঠিকঠাক করতে করতেই বাস চকরিয়ায় নামিয়ে দিয়ে গেল। এবার শুরু হলো আমাদের পেডেল মারা। প্রথমদিকের রাস্তাটা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ধরেই। বেশ মসৃণ। বেশ আরামেই ইশতি আর আমি সামনে-পেছনে করে এগোচ্ছি। আর আরিফ ভাই যথারীতি সবার পেছনে। সাইক্লিং ট্রিপে দলের সদস্যরা যদি সমস্যায় পড়ে, তাহলে তার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার জন্যই আরিফ ভাই সব সময় পেছনে থাকেন। মিনিট পনেরো যেতেই মহাসড়ক ছেড়ে হাতের বাম পাশের রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। ফাঁসিয়াখালী হয়ে এই রাস্তাটাই পরে লামা-আলীকদমে গিয়ে মিশেছে। এদিকে রাস্তায় গাড়ি চলাচল খুব একটা নেই বললেই চলে। হঠাৎ হঠাৎ অল্পস্বল্প মোটরসাইকেল আর চান্দের গাড়ির দেখা মিলছে। প্রকৃতি এ দিকটায় বেশ উদার। চারপাশের গাছগাছালিতে সবুজ রঙের উপস্থিতি বর্ষার আগমনধ্বনিই ঘোষণা করছে যেন। সাইকেল চালাতে চালাতেই রাস্তার দুই পাশের গাছগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিয়ে যেতে লাগলেন আরিফ ভাই। হঠাৎ রাস্তার পাশেই চোখে পড়ল একটা দোতলা ওয়াচ টাওয়ার। পাশেই থাকা সাইনবোর্ডে লেখা সাবধানবাণী, ‘সাবধান, হাতি চলাচলের পথ!’ বন্য হাতি দেখার আশায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও থাকলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিফল মনোরথে আবার উঠে বসলাম সাইকেলে।

ছোট ছোট কিছু আপহিলের দেখা মিলছে। মোটামুটি নির্বিঘ্নেই সেসব পার হচ্ছি। হঠাৎ পেছন থেকে আরিফ ভাইয়ের ডাক। থামতেই দেখি কম্মো সাবাড়। ওনার চাকার টিউব লিক! আরিফ ভাই তড়িঘড়ি করে তাঁর ব্যাগ থেকে টিউব সারানোর যন্ত্রপাতি বের করলেন। দক্ষ হাতে সাইকেল সারাইয়ে বসে গেলেন আরিফ ভাই। আমরাও পেয়ে গেলাম অনাকাঙ্ক্ষিত একটা বিরতি। তবে সেটা তেমন একটা দীর্ঘ হলো না। অল্পক্ষণের মধ্যেই কাজ সেরে ফেললেন আরিফ ভাই। আবার শুরু হলো সাইক্লিং। মাঝখানে একবার আপহিল উঠতে গিয়ে গিয়ার শিফটিংয়ের সমস্যায় পড়লাম। আরিফ ভাইয়ের হস্তক্ষেপে সেটাও ঠিক হলো নিমিষেই। পেডেল ঘুরিয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ইয়াংছা বাজারে।

বাজারের এক দোকানে পাহাড়ি কলা ঝুলছে, দেখামাত্রই তিনজনে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ব্যাক-প্যাকের মধ্যে থাকা হাইড্রেশন প্যাকটা (পিঠে ঝোলানো পানির ব্যাগবিশেষ) পানিতে কানায় কানায় ভরে ফেললাম। বাজারঘেঁষা বেইলি ব্রিজটা পার হতেই উঁকি দিল সেই ভয়ালদর্শন মিরিঞ্জার পাহাড়।

All-Tour

আমাদের আর পাহাড় চূড়াটার মাঝে কয়েক কিলোমিটার লম্বা একটা আপহিল। আপহিল দেখে শুকিয়ে যাওয়া গলাটাকে হাইড্রেশন প্যাকের মাউথপিসে মুখ রেখে ভিজিয়ে নিলাম। ‘কী আছে জীবনে!’-এই আপ্তবাক্যটা মনে মনে জপে সাইকেলে চড়ে বসলাম। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘কী আছে জীবনে’ বাক্যটার স্থলাভিষিক্ত হলো ‘প্যারা আছে জীবনে’ বাক্যখানি! কিছু দূর উঠতেই রীতিমতো জিহ্বা বের হয়ে যাওয়ার দশা। পাশে তাকিয়ে দেখি ইশতির অবস্থাও তথৈবচ। আমাদের দুজনেরই পাহাড়ি পথে প্রথম লং রাইড এটা। পাহাড়ি রাস্তায় সাইক্লিং যে কী চিজ, সেটাই যেন আমাদের দুজনকে মর্মে মর্মে অনুধাবন করানোর চেষ্টায় নেমেছে এই আপহিলটা। অন্যদিকে খাড়া রাস্তাটা আরিফ ভাই নির্বিকারচিত্তে তরতর করে উঠে যাচ্ছেন। ভাইজানের অবশ্য অভিজ্ঞতাও কম নয় সাইক্লিংয়ে। তিন পার্বত্য জেলায় সাইক্লিংয়ের পাশাপাশি তিনি তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফও পাড়ি দিয়েছেন দুই চাকায় চেপেই। তাঁর তুলনায় আমরা দুজন একেবারেই নবিশ। শরীরের সব শক্তি একত্র করে পেডেল মেরে একটু একটু করে উঠছি আর হাঁপাচ্ছি। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে পিঠে জগদ্দল পাথরের মতো যেন চেপে বসেছে তাঁবুসমেত ভারী ব্যাকপ্যাকটা। যতই পেডেল মেরে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে যেতে চাই না কেন, ভারী ব্যাকপ্যাক ততই টেনে নিচে নামিয়ে নিতে চায়। বেশ কিছু জায়গায় সাইকেল থেকে নেমে ঠেলতেও হলো। আর অল্প কিছু দূর উঠতেই শরীরের সব তেল শেষ। হাইড্রেশন প্যাক আর বোতলের পানিও একই সঙ্গে শেষ। কিন্তু তখনো যে বেশ কিছুটা পথ বাকি। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। পরের পথটুকু আবার সেই সর্বশক্তি মেরে পেডেলিং, কিছু জায়গা সাইকেল থেকে নেমে ঠেলে ওঠার রিপ্লে দৃশ্য। এই করে করে যখন মিরিঞ্জার যাত্রী ছাউনিতে পৌঁছালাম, তখন ইশতি আর আমি আক্ষরিক অর্থেই কাইত!

পা দুটোতে যেন কোনো শক্তিই পাচ্ছি না। আরিফ ভাইয়ের হাতের জাদু তথা ম্যাসাজে সচল অবস্থায় এলো আমাদের পাগুলো। পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হতেই আরেক দফা হামলা চালালাম পাহাড়ি কলাদের ওপর। মিরিঞ্জা পাহাড়ের পরের পথটুকু দেখে আমার আর ইশতির খুশি দেখে কে! জীবনে চলার পথে দুঃখের পরে যেমন আসে সুখ, তেমনি পাহাড়ি রাস্তায় চলার পথেও আপহিলের পরে আসে ডাউনহিল। কয়েক কিলোমিটার লম্বা সেই ডাউনহিল নামার সময় মনে হলো, ইহজনমে এহেন শান্তির কাজ আর বোধ হয় দ্বিতীয়টি নেই। কী এমন ক্ষতিই বা হতো, যদি দুনিয়াটা এমন ডাউনহিলময় হতো! আপহিল ওঠার সময় আমরা কচ্ছপের গতিকে হার মানালেও সেই আমরাই ডাউনহিলগুলো নামলাম টর্নেডোর গতিতে। আহ! কী শান্তি। নামতে নামতে একেবারে সমতল একটা জায়গায় এসে পড়লাম। ছাগলখাইয়া বাজারের একটু পরেই ডানপাশে জুমের আগুন দেখে কিছুক্ষণ থামলাম। সামনে সবুজ জমিনের ফসলের ক্ষেত, আর তার ঠিক একটু ওপরের পাহাড়টাতে জুমের আগুনের টকটকে লাল শিখা। সূর্যদেব ততক্ষণে তার রোজকার অফিস শেষ করে বাড়ি ফেরার মতলব করছে। তড়িঘড়ি করে আবার পেডেল ঘোরালাম। মিনিট বিশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। আলীকদমে আমাদের প্রিয়মুখ উইলিয়াম মারমা মামার বাসায় সাইকেলগুলো রেখে পাশের পাহাড়টায় ক্যাম্পসাইটের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। সেই ক্যাম্পিংয়ের গল্প না হয় আরেক দিনের জন্যই তোলা থাক। সূত্র : কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *