মো. সাদনান হোসেন
প্ল্যানের সূচনা হয় রাহাদের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে। রাহাদ ‘ক্রস ক্রান্ট্রি’ রাইড দিবে। মানে টেকনাফ টু তেুতলিয়া সাইকেল চালিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে সাধারণত টার্গেট থাকে ৬ দিনে ১০০০ কিলোমিটার চালানো। প্রত্যেক সাইক্লিস্টের একটি স্বপ্নের রাইড এটি। অনেক সাধনার পর সবাই এই সুযোগ পায়। সে হিসেবে আমরা খুবই নতুন। তখনও ১০০ কি. মি. বেশি রাইড আমরা দেইনি। তাও একবারই। সেই স্ট্যাটাসে নারায়ণগঞ্জের সায়মন ভাই যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। তার অবশ্য অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা একদিন সময় করে গেলাম নারায়ণগঞ্জে তার সাথে দেখা করতে। ‘ক্রস ক্রান্টি’ রাইডের কথা বাদ দিয়ে কথা হলো সিলেটে ৪/৫ দিনের একটি ট্যুর দিলে কেমন হয়, তা নিয়ে। তার কয়েক দিনে পর সায়মন ভাই মুন্সীগঞ্জে আসলো ফাইনাল ডিসিশন ও ডিসকাশনের জন্য।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ৫ এপ্রিল ভোরে রওনা দিব। মূলত লং রাইডের আগে বেশি কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন। প্রথমত ফিটনেস। নিয়মিত সাইক্লিং করা, আশেপাশের জেলাগুলোতে রাইড দেওয়া। এভাবে নিজের শরীরেকে প্রস্তুত করে তোলা। মূলত এক্সপার্টরা লং রাইডের আগে এইটাই সাজেস্ট করেন।
পাশাপাশি মৌসুম অনুযায়ী প্রস্তুতির একটা ব্যাপার থাকে। আমরা যেহেতু বর্ষার শুরুর দিকে যাচ্ছি, এই মৌসুমে যেকোনো সময়ই বৃষ্টিতে ভিজতে হতে পারে, তাই ঐরকম প্রস্তুতিরও দরকার। কিন্তু হঠাৎ প্ল্যান ও আমার এবং রাহাদের পূর্বে লং রাইডের অভিজ্ঞতা না থাকায় আমাদের তেমন সরঞ্জামও ছিল না। আর হাতে খুব বেশী সময়ও ছিল না। মাত্র কয়েক দিন। আর এত স্বল্প সময়ে আমাদের সবকিছু যোগান দেওয়া সম্ভব ছিল না। অপর দিকে সায়মন ভাই অভিজ্ঞ হওয়ায় আমাদের খুব একটা চিন্তা করতে হয়নি। তিনি নিজ দায়িত্বে সব কিছুর যোগান দিয়েছেন। যেমন – রেইন কভার, সেলফি স্টিক, ক্যামেরার পাশপাশি ভাল মানের মোবাইল ছবি ও এন্ডোমন্ডো চলানোর জন্য, পাওয়ার ব্যাংক ইত্যাদি সবকিছুই। এছাড়া সাইকেলের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিও।
আমরা শুধু টিউব, প্যাচকিট, সলিউশন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কিছু সরঞ্জামগুলো নিয়েছিলাম।

স্বপ্নের এডভেঞ্চারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু
পূর্বের কথা মত আমরা পাঁচ তারিখ রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। আমার চিন্তা ছিল রাহাদকে নিয়ে, কারণ ও সবসময় বড় রাইড গুলোর আগের রাতে ওভার এক্সাইটেড থাকার কারণে ঘুমাতে পারে না। তবে এই রাইডটি আমাদের দেওয়া পূর্বের রাইডগুলোর মত নয়। কারণ, সেখানে মাত্র একদিনেরই ব্যাপার ছিল। রাতের ঘুম খুব একটা প্রভাব ফেলে না, আর প্রভাব পড়লেও তখন হয়তো রাইড শেষ। তবে ঘটনা পুরো উল্টো হল।
চার তারিখ রাতে হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়ে আমাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতেই রাত ১০টার বেশি বেজে গেয়েছিল। আর ঝড়ের কারণে বিদ্যুৎও ছিল না। রাতে কোনো রকম ব্যাগ গোছাতেই প্রায় ১টার বেশি বেজে গেল। অথচ আমাদের কথা ছিল দুপুর ১২টার মধ্যে ব্যাগ গুছিয়ে সায়মন ভাইকে কনর্ফাম করা। আমরা ৪ ঘন্টারও কম সময় পেলাম ঘুমানোর।
সাড়ে চারটা, পৌনে পাঁচটায় বের হওয়ার কথা ঘর থেকে। পুরো প্ল্যান প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়লো বৃষ্টির কারণে। অবশেষে পৌনে ৬টার দিকে বাসা থেকে বের হলাম। আমাদের স্বপ্নের এডভেঞ্চারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল। আমাদের সাথে কাঠপট্টি পর্যন্ত সঙ্গী হয়েছিল পারভেজ।
আমাদের দুই জনের কাছে পথগুলো ছিল অচেনা। সায়মন ভাইয়ের কাছে হয়তো চেনা ছিল। ৮টা ৩৫ মিনিটে রূপগঞ্জের কোনো একটা জায়গায়, ছোট্ট একটা দোকানে থেমে তিনজনে মিলে প্রথম ফেসবুকে চেকইন দিলাম।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নরসিংদীর কোনো একটা জায়গায় থেমে নাস্তা করলাম। নাস্তা শেষে পৌনে দশটার দিকে আবার সাইক্লিং শুরু করলাম। হঠাৎ রাহাদ ক্লান্ত হয়ে ড্রিফটিং শুরু করলো। সায়মন ভাইতো পুরা ফায়ার।

৮টা ৩৫ মিনিটে রূপগঞ্জের কোনো একটা জায়গায়
সাড়ে ১২টায় কিশোরগঞ্জ পৌঁছে আবার চেকইন করলাম। কিছুক্ষণ চালানোর পরই পেলাম ভৈরব ব্রিজ। ১২টা ৫৩ মিনিটে সেখানেও চেকইন করলাম।
ব্রিজে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাস স্ট্যান্ড ছেড়ে অনেক অনেক দূর যাওয়ার পর পথিমধ্যে এক আপু হাত উঠিয়ে আমাদের সিগনাল দিল। আমি সাইকেল থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার? তিনি প্রশ্ন করলেন – আমরা কেন এরকম সাইকেল নিয়ে ঘুরি, প্রায়ই দেখেন এই রাস্তা দিয়ে এরকম অনেক সাইক্লিস্ট যাচ্ছেন। তার মনে এসব দেখে অনেক কৌতুহল জাগে। আমি বললাম পিছনে আমাদের বড় ভাই আছেন, উনার সাথে কথা বলেন। সায়মন ভাই খুব সুন্দর করে তাকে বুঝিয়ে বললেন। তারপর আবার আমরা প্যাডেলিং শুরু করলাম, আপুর কারণে আমাদের ছন্দ পতন হয়েছিল বটে। দুপুর ৩টা বা সাড়ে ৩টার দিকে মোটামুটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শেষ সীমান্তে এসে একটা হোটেলে দুপুরের খাবার শেষে বেশ কিছুক্ষণ সময় বিশ্রাম নিলাম। এরমধ্যেই আকাশের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকলো। বৃষ্টির আভাস দেখা যাচ্ছিল। বিশ্রামের ফাঁকে আমার আর রাহাদের ব্যাগের জন্য ছোটখাট প্রটেকশনের ব্যবস্থা করলাম। তারপর আবার প্যাডেলিং করতে না করতেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হল।

ভৌরব ব্রিজ
তখন আমরা হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় পৌঁছে আবার ফেসবুকে চেকদিন দিলাম। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে প্রায় দেড় দুই ঘন্টা সাইক্লিং করলাম। বৃষ্টিতে ভিজে লং রাইড, আমার আর রাহাদের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা। এখন প্রায়ই সুযোগে থাকি বৃষ্টিতে ভিজে সাইক্লিং করার। আর বাতাসের কথা নাই বা বললাম। বাতাসের মধ্যে সাইক্লিং যে কি পেইন, তা শুধু তারাই বুঝবে যারা করেছেন। যদিও বৃষ্টি হওয়াতে একটা উপকার হয়েছিল, একটু ফ্রেশ লাগছিল, এনার্জিও বেড়েছিল। জনমানব শূন্য রাস্তা সন্ধ্যার মধ্যেই পাড় করে ফেললাম। সন্ধ্যা নাগাদ শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছলাম। সরকারি রেস্ট হাউজ বা ডাকবাংলোতে থাকার ব্যবস্থ্যা করতে না পেরে একটা হোটেলে উঠলাম। আমার আর রাহাদের সবচেয়ে বেশি কিলোমিটার চালানো হয়েছিল সেদিন। আমরা সর্বমোট চালালাম ১৬৮ কি.মি. আর নারায়ণগঞ্জ থেকে শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত সায়মন ভাই ১৫০ কি.মি-এর মতো সাইক্লিং করলো। পরের দিনের টার্গেট ছিল মাধবপুর লেক হয়ে, সিলেট শহর। দূরত্ব ১৫২ কিলোমিটার।
দ্বিতীয় দিন ভোরে বৃষ্টির শব্দতে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ফ্রেশ হয়ে, রেডি হয়ে আমরা রুম থেকে বের হয়ে আবার প্যাডেলিং শুরু করলাম। শায়েস্তাগঞ্জ চৌরাস্তা পেরিয়ে একটু সামনে গিয়েই একটা ব্রীজে দাড়ালাম, ছবি তোলার জন্য। সকালে বৃষ্টি হওয়ায় ব্রীজের বিভিন্ন স্থানে পানি জমে ছিল, এমন সময় হঠাৎ আমার পেছনের চাকার দিকে তাকিয়ে দেখি চাকা দিয়ে বুদবুদ বের হচ্ছে। একটু সামনে এগিয়ে টিউব চেঞ্জ করে আবার প্যাডিলিং শুরু করলাম।
তখনই প্রায় পৌনে আটটা কি আটার মত বেজে গিয়েছিল। প্রায় ৩০ কিলোমিটার চালানোর পর একটা হোটেল যেয়ে নাস্তা করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। তারপর আবার শুরু হল পথচলা। কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ল ‘চা বাগান’। ফিনলের চা বাগান দিয়ে শুরু হল, এই প্রথম চা বাগান দেখলাম। চা বাগানের সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা কিভাবে দিব? আজ না-হয় না-ই দিলাম। কিছু দূর যেতেই চোখে পড়লো ‘চায়ের দেশে স্বাগতম’ লেখা একটি বড় ভাস্কর্য। সেখানে থেমে কিছু ছবি তুললাম।

টিউব পরিবর্তনের একটি দৃশ্য। যারা বলেন রাস্তায় কোনো সমস্যা হলে আমরা কি করি? তাদের জন্য এই ছবিটি
স্থানীয় একজনকে পেলাম, তিনি আমাদের দেখে এগিয়ে আসলেন, তাকে সাথে নিয়েও ছবি তুললাম। এর মধ্যেই ধীরে ধীরে রাস্তা উঁচু-নিচু হওয়া শুরু করেছে। কোথাও আপ হিল আবার ডাউন হিল। প্রথম দিকে ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল যে রাস্তা কোথায় উঁচু হচ্ছে আর কোথায় নিচু হচ্ছে। ডাউনহিলে ৩৬+ স্পিড উঠে যাচ্ছে প্যাডেলিং ছাড়াই। মনে হচ্ছে বাতাসের মধ্যে মুক্তারপুর ব্রীজ দিয়ে নামছি। মূলত সিলেটের রাস্তা গুলো আমাদের এদিকের চেয়ে উঁচু।
তবে গাড়িতে গেলে হয়তো আপ হিল-ডাউন হিল শ্রীঙ্গলের রাস্তা ছাড়া বোঝা সম্ভব না। হাইওয়ে গুলো যে খুব সুক্ষ্মভাবে উঁচু হয়ে গেছে তা খুব সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে বোঝা যায় না। গাড়িতে গেলেতো না-ই।
এভাবে প্রায় ১১ কিলোমিটার মাউন্ট বাইকিং করলাম ৪৯ মিনিটে। মাধবপুর যাওয়ার আগেই পরলো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। আমরা সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে ছবি তুললাম। মাধবপুর লেকে যাওযার জন্য আমাদের আপ-ডাউনে আরও ২০ কিলোমিটার রাস্তা বেশি চালাতে হল। মূলত মাধবপুর লেকের যাওয়ার জন্যই আমরা শর্টকাট ৯০ কিলোমিটারের রাস্তা রেখে ১৫০ কিলোমিটারের রাস্তা ধরে সিলেট যাওয়ার প্ল্যান করি।
সেখানে যেয়ে উপরের টিলায় উঠলাম। উপর থেকে পুরো লেক দেখলাম। দূরে ইন্ডিয়ার পাহাড় গুলো আবছা আবছা দেখা যাচ্ছিল।
লেক ঘুরে নিচে নেমে চা খেলাম (ন্যাশনাল টি) কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম, চেকইন করলাম, আবার ছবি তুললাম। এবার টার্গেট সিলেট যাব।
দুপুর ৩ টা নাগাদ আমরা মৌলভীবাজার নির্বাহী প্রকৌশলী’র অফিসের সামনে দাড়িয়ে ছবি তুলছি চেকইন দেওয়ার জন্য, এমন সময় একজন ভদ্রলোক তার মটরসাইকেলটি আমাদের সামনে থামালো। কথা শুনেই বুঝতে পারলাম উনিও সাইক্লিস্ট। তখন পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার চালিয়েছি আরও ৬৭ কিলোমিটার বাকি তখনও।
উনার অফিসে গেলাম, হালকা খাওয়া দাওয়াও হল। সেদিন দুপুরে আর খাওয়া দাওয়া হলো না। মৌলভীবাজার সাইক্লিস্টের ছিদ্দিকুর ভাই আমাদের ফেঞ্চুগঞ্জ ধরে সিলেট যাবার রাস্তাটা পর্যন্ত দেখিয়ে দিয়ে আসলেন। তখন প্রায় বিকাল হয়ে যাচ্ছিল, আমরা মৌলভীবাজার ক্রস করে সিলেট সড়কে প্রবেশ করলাম। কিছু দূর এগিয়েই আমরা থামলাম। সেখানেই আমাদের হিট ছবি ক্যাপচার করা হলো।
রাস্তার দুই ধারে বেশ ভলো ফাঁকা জায়গা ছিল। রাহাদ সাইকেল থামিয়েই বসে পড়ল, ওর দেখাদেখি আমিও বসলাম। সায়মন ভাই আমাদের ডিরেকশন দিলেন, বললেন – শুয়ে পর। রাহাদ শুয়ে পড়লেও আমি একটু ইসতস্ত করছিলাম। পরে আমিও শুয়ে পড়লাম, সায়মন ভাই কয়েকটা টুস-টুস-টুস কিক্ল করে আপ করে দিল। সেই ছবিতে যা কমেন্ট হয়েছে তার চেয়ে বেশি রিপ্লে দিতে হয়েছে সবার সাথে দেখা হওয়ার পর।

মাধবপুর লেক
আমরা পথে আরও বেশ কয়েক বার থেমেছি। সায়মান ভাই আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল, সন্ধ্যার পর আমি আর রাহাদ একা একা সরু হাইওয়েতে সাইক্লিং করছি। রাস্তার দুইপাশে গাছ, খাল ও ক্ষেত ছাড়া অন্য কিছু নেই, কোনো মানুষও নেই। অনেক দূরে একটা বাজারে পৌঁছে সায়মান ভাইকে পেলাম। তার পর ঠিক কত কিলোমিটার চালিয়েছি বা কতক্ষণ চালিয়েছি ঠিক মনে নেই। অন্ধকারে কিছুই খেয়াল করতে পারিনি। ঠিক সময় মনে নেই কয়টা বাজে আমরা হুমায়ুন রশিদ চত্বরে গিয়ে পৌছলাম। সেখান থেকে আমরা গেলাম সুবিদ বাজার, গিয়ে উঠলাম বন কলাপাড়ায় রাহাদের কাজিনের বাড়িতে। এভাবেই আমাদের দ্বিতীয় দিনের সমাপ্তি ঘটলো। রাতে ফ্রেশ হয়ে রাহাদের আঙ্কেল, আন্টি, কাজিন সবার সাথে আমাদের পরিচয় হলো। আঙ্কেল, আন্টির কথা অন্য দিন বলবো। আকাশ, হৃদয় ও ছোট ভাইটার কথা কি বলব? অসম্ভব রকমের ভাল, ট্যালেন্ট আর কি কি বলবো? যাই হোক, রাতে আমাদের প্লানের কিছুটা পরিবর্তন হল।
সকালে উঠে নাস্তা করে বেরুতে আনুমানিক প্রায় দুপুর ১২টা বেজে গেল। উদ্দেশ্য শহর ঘুরে দেখবো। আমি ভেবেছিলাম এদিকে বোধ হয় চা-বাগান আর আপ-হিল, ডাউন হিল দেখতে পাব না। তবে এয়ারপোর্ট রোডের দিকে যেতে মালনিছড়া নামে একটা চা বাগান ও উঁচু নিচু রাস্তা পেলাম।

ন্যাশনাল টি
তারপর ক্যাডেট কলেজ, স্টেডিয়ামের সামনে দিয়ে ওসমানী আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরে গেলাম।এয়ারপোর্টের পিছনের দিকে গেলাম।
এখন অবশ্য এয়ারপোর্টের পেছনের রাস্তায় সাইকেল নিষিদ্ধ। ফেরার পথে সিলেট স্টেডিয়ামে গেলাম,। স্টেডিয়াম ঘেষে আরেকটা চা বাগান। আমরা চা বাগানের টিলার উপরে উঠলাম। সেখানে থেকে স্টেডিয়ামের গ্রীন গ্যালির ও প্যাভিলন দেখা যায়। সেখানেও বেশ কিছু ছবি তুললাম ও সময় কাটালাম প্রকৃতির সাথে। ওহ আরেকটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি ‘আইসফি’ তুলতে কিন্তু আমরা ভুল করিনি। রাবার গাছ দেখলাম, কোন পদ্ধতিতে রাবার সংগ্রহ করে তা দেখলাম, কুড়িয়ে একটা রাবার ফলও পেলাম। এভাবে ঘুরে আমরা বিকাল চারটার দিকে বাড়িতে পৌছলাম। দুপুরের খানাপিনা সেরে ছাদে উঠে শহরটা দেখলাম। স্টেডিয়াম ঘেষে চা বাগান, স্টেডিয়ামের লাইট টাওয়ার ও হযরত শাহলাল (র:) মাজারে মিনার দেখা যাচ্ছিল ছাদ থেকে। বিকালে আমরা বের হলাম আরও কিছু জায়গা ঘোরার জন্য। বিকালে গেলাম শাহজালাল ইউনির্ভাসিটিতে রাহাদের বন্ধুর সাথে দেখা করতে।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে
ঐখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে যাওয়ার পথে ‘বাইক ভেঞ্চার’ নামে একটি বাইসাইকেল শপে আমরা থেমে ছিলাম। সেখানে তাদের সাথে ও স্থানীয় সাইক্লিস্টদের সাথে আলাপ হলো। রাহাদের সাইকেলও সার্ভিসিং হলো। আজিজুল ভাইয়ের সাথেও আলাপ হলো, উনার নানী বাড়ীও মুন্সীগঞ্জে। কোথায় মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের লোক নেই? সবখানে আছে। তারপর আমরা গেলাম ক্বীন ব্রিজে, পাশেই সিলেট সার্কিট হাউজ। নদীতে দেখলাম একটা বোর্ট যাচ্ছে – ভ্রাম্যমাণ রেষ্টুরেন্ট।
সেখান থেকে গেলাম পাঁচ ভাই রেষ্টুরেন্টে ‘চাপ’ খেতে। সুস্বাদু একটা খাবর।
সেখান থেকে বেরিয়ে জানতে পারলাম প্লানে একটু চেঞ্জ হয়েছে। পাশেই নায়ক সালমান শাহ’র নানা বাড়ি, আমরা সেখানে যাচ্ছি। বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি গেট বন্ধ। দিনের বেলায় সবাই ঢুকতে পারে। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি এমন সময় দারোয়ান এসে গেট খুললো। আমি বললাম ‘ভাই আমরা ঢাকা থেকে এসেছি সিলেটে ঘুরতে, ভিতরে কি একটু ঢোকা যাবে? ঘুরে দেখবো . . .। মনে হলো বেচারী খুব চিন্তাই পড়েছিল, রাতের বেলা ঢুকতে দিল আমাদের। আমরা ভিতরে ঢুকে ছবি তুললাম। খুব সম্ভবত সামনের রুমে সবাই প্রবেশ করতে পারে। আমরাও বিনা বাধায় প্রবেশ করলাম। ভিতরে সালমান শাহকে নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদের কাটিং ও ছবি টাঙানো। হঠাৎ ভিতরে থেকে বেরিয়ে এলেন সালমান শাহর মামা। উনি আমাদের খোঁজ খবর নিলেন এবং বললেন আমাদের চা নাস্তা দেওয়ার জন্য। এই প্রথম কাউকে পেলাম যিনি আমাদের এপ্রিসিয়েট করলেন ও অনেক দিক নির্দেশনামূলক কথা বললেন এবং আফসোস করলেন উনাদের সময় এমনটা ছিল না বলে। রাত বলে আমরা বক, মুরগী দেখতে পাই নি। তবে জার্মানি শেপার্ড টা ঠিকই দেখেছি। আমাদের সময় করে দিনের বেলাও আসতে বললেন তিনি। আমরা ভিতরের রুমে কথা বলছি এমন সময় তিনি রুমে প্রবেশ করলেন এবং আমাদের ভিতরে আরেকটি রুমে নিয়ে গেলেন। সালমান শাহ যে রুমে এবং যে খাটে জন্ম গ্রহণ করেছেন ১৫০ বছর পুরনো সেই খাট দেখালেন। (খাটগুলো সালমান শাহ্’র জন্মেরও আগের।)

১৫০ বছর পুরনো এই খাটেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন সালমান শাহ। উনার কুমকুম মামার সাথে আমরা
এখনও তারা সেই খাট ব্যবহার করছেন। পুরনো এসি, টেলিফোন ইত্যাদি। এমনিকি ঘরটাও অনেক পুরোনো। এখনো দেয়ালের মাঝে পাটখড়ি দেওয়া। কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই। আমাদের ভিতরের আরেকটা রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে যে খাট আছে সেটাও প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ বছর পুরানো। তা অবশ্য খাটের ডিজাইন দেখলেই বোঝা যায়। আলমারী খুলে কিছু বই দেখালেন। সামনের দিকের একটা বই আমার চোখে পরলো আয়ুব খানের লেখা। অনেক পুরনো, সেই আমলের। ভিতরের আরেকটা রুমে নিয়ে গেলেন আমাদের সেখানেও প্রায় কয়েকশ বছর আগের ব্যবহৃত বাসন-কোসন। শুধুমাত্র সাইক্লিস্ট বলেই আমরা এই অসাধারণ একটা সুযোগ পেয়েছি। ফলে আমরা সাইক্লিস্ট হিসেবে খুবই ভাগ্যবান কারণ এই সুযোগ অন্য কোন সাধারণ দর্শনার্থী পাবেন না। এবং আকাশকে ধন্যবাদ আমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বিদায় নেওয়ার সময় কুমকুম মামা জিজ্ঞেস করলো আমাদের থাকা-খাওয়া নিয়ে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা। এবং বললেন শাহাজালাল (র:) মাজার ঘুরে যেতে। সেখানে মাজারের যে খতিব আছেন তাকে গিয়ে তার কথা বলতে এবং বলতে শাহজালাল (র:) যে ব্যবহৃত জিনিসপত্র ভিতরে সংরক্ষিত আছে সেগুলো যেন আমাদের দেখান। আমরা যখন মাজারে পৌঁছি তখন প্রায় রাত সাড়ে নয়টা, পৌনে দশটার মত বাজে। আমরা বাইরে থেকেই ঘুরে বাড়িতে চলে আসলাম। এভাবে প্রায় ৭০/৮০ কি.মি. চালিয়ে তৃতীয় দিনের সমাপ্তি ঘটলো।
চতুর্থদিন আমাদের লক্ষ্য নিয়ে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। বিছনাকান্দি যাব নাকি জাফলং?
সাধারণত কেউ সিলটে গেলে জাফলং যায়। বিছনাকান্দি খুব কম লোকই যায়। এই সংখ্যা অবশ্য ইদানিং বাড়ছে। তাই অনেক চিন্তা ভাবনার পর আমারা সিদ্ধান্ত নিলাম বিছনাকান্দি যাব। উপরে ‘বাইক ভেঞ্চার-এর কথা বলেছিলাম, মনে আছে?। তারা বলেছিল, পুরোটাই অফরোড। আসলেই তাই, কিছু কিছু রাস্তার খুবই খারাপ অবস্থা, আর কিছু রাস্তা মোটামুটি চলে আর কি। আর সকালে বৃষ্টি হওয়ার কারণে আরও খারাপ অবস্থা হয়েছিল। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি সকালে সিলেটে বৃষ্টি হলেও গতরাতের ঝড়-বৃষ্টিতে মুন্সীগঞ্জের লণ্ডভণ্ড অবস্থা প্রায়। আমরা এগুতে থাকলাম। খুব সম্ভবত ৪০/৪২ কিলোমিটার, আপ-ডাউনে ৮০/৮২ কি.মি.। শেষের পাঁচ কিলোমটার রাস্তাতো পুরাই অফরোড। সাইকেল নিয়ে যাওয়ায় চালিয়ে যেতে পেরেছি।

শেষের পাঁচ কিলোমিটার পথের একটি দৃশ্য
শুকনো মৌসুমে সাধারণ দর্শনার্থীদের হেটে যেতে হয়, আর অন্য কোন রাস্তা নেই। তবে বর্ষায় কোন পর্যন্ত পানি থাকে ঠিক বলতে পারছি না। অবশ্য বিছনাকান্দিতে বার মাসই ঝরণা থেকে পানি নামে। বৃষ্টি হলে ঝরণা স্পষ্ট দেখা যায়। অবশেষে পৌঁছলাম সাড়ে বারোটা ১টার দিকে বিছনাকান্দি জিরো পয়েন্টে। সেখানে গিয়ে আমরা ছবি তুললাম। পাহাড়ের কাছে অর্থাৎ বর্ডারের কাছে মাত্র একটাই দোকান আছে, তাদের সাথে কথা বললাম, গোসল করলাম, ঝরণার পানি পান করলাম। সেখানে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে আমরা রওনা করলাম। এতক্ষণ শুধু আমরা ছবি, গোসল ও স্থানীয়দের সাথে গল্পগুজব করলাম। একজন বিজিবি সৈনিকও এসেছিল সেখানে।
প্রটোকলের কারণে ছবি তুলতে রাজি হলেন না তিনি। তারপর আবার আমরা রওনা করলাম বিছনাকান্দি থেকে। বিছনাকান্দির সৌন্দর্য্যরে বর্ণনা আমি দিতে পারব না।
শেষের পাঁচ কিলোমিটারের কথা বলেছিলাম মনে আছে? এই পাঁচকিলোমিটার পথ হচ্ছে অনেকটা মরুভূমির মত। ফেরার পথে আমি আর রাহাদ একসাথে। সায়মান ভাই একটু পিছনে ছিল। সেই পাঁচ কিলোমিটার পথের কোথাও মাঝপথে আমি রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। আমি ডানদিকে পাহাড়ের অনেক কাছে চলে গেলাম। বাড়ি-ঘরে টপকে রাস্তায় উঠলাম। আমি দেখছি রাহাদ আর সায়মন ভাই অনেক দূরে। প্রায় চলে এসেছি এমন সময় খুবই বাজে একটা রাস্তার সামনে পড়লাম। কাদার মধ্যে চাকা আটকে গেলো। আর মাটিতে পা নামাতেই জুতো কাদায় দেবে গেলো। কোনো রকম নাড়াচড়াও মুশকিল, যেই একটু নড়াচড়া করলাম সাথে সাথেই স্লিপ! কোনো রকম সাইকেলে ভর দিয়ে উঠে রাস্তার ধারের মাঠে নেমে গেলাম। ঐখানে স্থানীয় কিছু ছেলেপেলে খেলাধুলা করছিল, ওরা দূর থেকে আমাকে ডাকছিল। ওদের সাথে কথা বলে আবার হাটু পর্যন্ত কাদামাটি আর পানি ভরা একটা ছোট জায়গা পার হয়ে চলতে থাকলাম। আমার আর আমার সাইকেল সব কাদায় কাদাকার। তারপর কিছু দূর যেতেই দেখলাম সায়মান ভাই ও রাহাদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। যেতে আমাদের যতটুকু সময় লেগেছিল তার চেয়েও কম সময় লাগলো ফিরতে। পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আমরা বাড়িতে ফিরলাম। বাড়িতে ফিরে ফ্রেশ হয়ে দেখি আবার খাবার-দাবার রেডি। একটা চটপটিফি দিয়ে চেকইন হলো। এভাবেই শেষ হলো আমাদের চতুর্থ দিন।
এবার ফেরার পালা। অনেক মজা আর অনেক স্মৃতি নিয়ে ফিরছি। সাথে রাহাদের আন্টির দেওয়া গিফট। এতে করে আমাদের ব্যাগের অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের অবস্থাও খুব বেশিক্ষণ ভাল থাকলো না। ২০/৩০ কিলোমিটার যাওয়ার পরই ঘাড় ব্যাথা। এমনিতেই দেরি করে রওনা দিয়েছি। তারপর কিছু দূর যাওয়ার পর পরই থামতে হচ্ছিল। এভাবে চালিয়ে আমাদের শায়েস্তাগঞ্জ আসতে হল।

বিদায় সিলেট
মনে আছে তো প্রথম দিন শায়েস্তাগঞ্জের কথা বলেছিলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা নামবে। আমরা হিসেব নিকেশ করে দেখলাম রাতে থাকা খাওয়া নিয়ে যে খরচ হবে এবং আগামী কাল যদি চালিয়ে আসি তাহলে যে খরচ হবে তাতে আমাদের খুব বেশি পর্তা হবে না। আবার ব্যাগও খুব ভারী। তাই আমরা বাসে করে চলে আসলাম। না হয়তো রেকর্ড হয়ে যেত। কারণ সবাই চালিয়ে গেলেও গাড়িতে করে আসে। আমরা চালিয়ে গেলাম আবার চালিয়েও আসতাম। অবশ্য অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত এসেছিলামও। আর বাকিটুকুও আমাদের জন্য খুব বেশি কষ্টদায়ক হতো না বটে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে চাষাড়া এসে পৌঁছলাম। ভেবেছিলাম রাতেই বাড়িতে চলে যাব, বেশি রাত হয়ে গেছে বলে আর আগালাম না, সায়মন ভাইয়ের বাড়িতে থেকে গেলাম। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, নাস্তা করে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

৬৪ জেলা ভ্রমণকারী হিরণ ভাই ও বাহারুল ভাইয়ের সাথে মুক্তারপুর সেতুতে। তখন তারা সবেমাত্র তাদের ৬৩জেলা মুন্সীগঞ্জে প্রবেশ করেছিলেন।
পথে মুক্তারপুর সেতুতে ৬৪ জেলা ভ্রমণকারী হিরণ ভাই ও বাহারুল ভাইদের সাথে দেখা। তারা তাদের ৬৩ নম্বর জেলা মুন্সীগঞ্জে মাত্র প্রবেশ করেছে। তাদের সাথে পরিচয় হয়ে সার্কিট হাউজ পৌঁছে দিয়ে আমরা যে যার বাড়িতে ফিরলাম। এইভাবেই অনেক নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে সুন্দর ও সফলভাবে আমাদের স্বপ্নের এডভেঞ্চার রাইডের যাত্রার সমাপ্তি হলো।
হ্যাপি সাইক্লিং। সূত্র : বিক্রমপুর সংবাদ ডটকম