৩ থেকে ২৪ অক্টোবর-২২ দিন দুই চাকার ডানায় চেপে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন ১০ সাইকেলারোহী। থিম ছিল ‘এক্সপ্লোরিং বিউটিফুল বাংলাদেশ’। বাংলাবান্ধা থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত এই ভ্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছেন খন্দকার আহম্মদ আলী। তিনি পিন্টু রঞ্জন অর্ককে শুনিয়েছেন সাইকেল ভ্রমণের গল্প।
এর আগে দুবার সাইকেলে ৬৪টি জেলা ভ্রমণ করেছি। ফলে মোটামুটি সব কিছুর সঙ্গে চিনপরিচয় আছে। এবার যখন ঠিক করলাম, আবারও দুই চাকায় চেপে ঘুরে দেখব মাতৃভূমি, কিন্তু একা নয়। ঘোষণা দেওয়ার পর পরই অনেকে যোগাযোগ করল। শেষমেশ ১০ জনের একটি দল দাঁড়িয়ে গেল। আমি বাদে ৯ জন-সঞ্চিতা বর্মণ, বাদশাহ মিঞা, সুলায়মান সালমান, অভিজিৎ কান্তি দাশ, সৌরভ হোসেন, সাইফ আল মাহমুদ, শফিউল্লাহ ইমন, তরিকুল রানা ও ভারতের উজ্জ্বল পাল। ২০১০ সালে ঢাকায় তাঁর সঙ্গে পরিচয়। পরে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। তিনি সাইকেলে পুরো ভারত ভ্রমণ করেছেন। তাঁর শখ আমার সঙ্গে সাইকেলে চেপে বাংলাদেশ দেখবেন।
আগের মতো এবার কোথায় থাকব, কী খাব-এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হয়নি। কারণ এই ভ্রমণের পৃষ্ঠপোষক বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, বাইসাইকেলশপ লিমিটেড, হোটেল দ্য কক্স টুডে, ওষুধবাজার ডটকম, মাল্টিমেট কম্পিউটার সলিউশনস ও সমুদ্রপুরী কটেজ।
রুট সম্পর্কে আগেই ব্রিফিং করা ছিল। ৩ অক্টোবর সকালে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা থেকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। সেখানে আমাদের স্বাগত জানান তেঁতুলিয়া উপজেলার ইউএনও শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। প্রথমেই যাই পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সদর উপজেলার ভিতরগড় দুর্গে। সেখানে সুনসান নীরবতা। মানুষের কোলাহল নেই। মাঝখানে মহারাজার দিঘি। চারপাশে ইটের ছোট ছোট ঢিবি। তার ওপর গাছগাছালি। ভিতরগড়ে আমাদের সঙ্গ দেন শালমারা ভিতরগড় হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম। সদালাপি মানুষটি আমাদের পেয়ে যেন নিজের সন্তানদের কাছে পেলেন! ঘুরে ঘুরে স্থানগুলো দেখাতে দেখাতে জানালেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে স্থাপিত ভিতরগড় ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বাধীন নগরী। এতে বাণিজ্য ও জনবসতি দুটোই ছিল। বিশেষত বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের অনুসারী লোকজন ছিল এ নগরীর বাসিন্দা। এই দুর্গনগরীর সঙ্গে তিব্বত, ভুটান, চীন, নেপাল, ভারত, সিকিমের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।
পরদিন পঞ্চগড় থেকে ঠাকুরগাঁও হয়ে দিনাজপুর। সেখানে দুই দিনে কান্তজির মন্দির, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পার্বতীপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি ও হিলি স্থলবন্দর পরিদর্শন করি। এর মধ্যে তৃতীয় দিন সকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উজ্জ্বল পালের ডাক আসে। ভারতে ফিরে যেতে হয় তাঁকে। চতুর্থ দিন যাই জয়পুরহাট। সেখান থেকে বের হয়ে পাহাড়পুর দেখে বগুড়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ৮টা। বগুড়া সাইক্লিস্ট দল আমাদের স্বাগত জানায়। পরে বগুড়া সাইক্লিস্ট দলের এক সদস্যের বাড়িতে সঞ্চিতার থাকার ব্যবস্থা হল আর আমরা হোটেলে। রাজ্যের ক্লান্তি ভর করেছে শরীরে। পরদিন সকালে বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর, মহাস্থানগড় দেখে শেরপুর উপজেলায় পৌঁছি রাতে। রাত কাটে হোটেলে। ৯ অক্টোবর সকালে শেরপুর উপজেলার বিখ্যাত খেরুয়া মসজিদ দেখে সিরাজগঞ্জ পৌঁছাতে বিকেল। ১০ অক্টোবর টাঙ্গাইল হয়ে গাজীপুর পৌঁছাই গভীর রাতে। সেখানে আগে থেকেই রেস্ট হাউসে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিল জেলা প্রশাসন।
নবম দিনের গন্তব্য রাজধানী ঢাকা। পরের দিন নারায়ণগঞ্জ। কিন্তু বাদ সাধে বৃষ্টি। বৃষ্টি থামবে বলে অপেক্ষা করতে করতে দিন পার হয়ে যায়। সন্ধ্যায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করেই রওনা দিই নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে। সেখানে আমাদের আতিথেয়তা দেন বন্ধু ফাহিম হোসেন। পরদিন রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, বিবি মরিয়মের সমাধি, হাজীগঞ্জ দুর্গ, নৌ-বন্দর, কদম রসুল মসজিদ, সোনারগাঁওয়ের পানাম নগর, লোকশিল্প জাদুঘর দেখা হয়ে যায়। সেখান থেকে কুমিল্লা। ভিক্টোরিয়া কলেজ, মাতৃভাণ্ডার, কবি নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো, ধর্মসাগর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের সমাধিস্থান ঘুরে দেখি। এ সময় জেলা সাইক্লিস্ট দলের শাওন, বিল্লাহ মামুন ও জোবায়ের আমাদের সঙ্গ দেন। পরের দিন শালবন বিহার, ময়নামতী জাদুঘর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যাই। শালবন বিহার দেখার সময় সেখানকার ভিক্ষুগণ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মাহবুবা ইয়াসমিন আমাদের অনেক সহযোগিতা করেন। ময়নামতী জাদুঘরের কস্টোডিয়ান (রক্ষণাবেক্ষণকারী) আহমেদ আবদুল্লাহ জাদুঘরের প্রতিটি জিনিসের ইতিহাস আমাদের একে একে গল্পের মতো শুনিয়ে গেলেন।
১৫ অক্টোবর ফেনী পৌঁছালে আমাদের অভ্যর্থনা জানায় বন্ধু মাহফুজুর রহমান। এরপর যাই সীতাকুণ্ড। কিন্তু সেখানে থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা হয়। উপজেলা ডাকবাংলায় রুম খালি নেই। ফলে রাতেই চট্টগ্রাম রওনা দিই। জেলার এনডিসি আমাদের রাত যাপনের ব্যবস্থা করে দেন। সকালে নিউ মার্কেট, রেলওয়ে জংশন, সার্কিট হাউস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের সমাধিস্থান, বায়েজিদ বোস্তামির মাজার, বিজয় উদ্যান ঘুরে দেখি। ১৭ তারিখ রানা ও ইমন দল থেকে বের হয়ে যায়। পরদিন সকালে চকোরিয়ায় পৌঁছাই। স্থানীয় ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই এলাকায় সৈনিক ও রসদ সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত এয়ারস্ট্রিপ (যুদ্ধের সময় বিমান ওঠা-নামার জন্য ব্যবহৃত জায়গা) ঘুরে দেখি। রাতের গন্তব্য রামু। উপজেলার ইউএনও সেলিনা কাজী রাবার বাগান রেস্টহাউসে রাত যাপনের ব্যবস্থা করেন। সকালে রামুর বৌদ্ধ উপাসনালয়গুলো ঘুরে দেখি। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়। অনেকেই তাঁদের বাসায় থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কলা, রসমালাইসহ নানা উপাদেয় খাবার খাওয়ান।
২০ অক্টোবর টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার কথা। কিন্তু টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মোজাহিদ উদ্দিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় টেরই পাইনি কখন যে জাহাজ ঘাট ছেড়ে গেছে। শেষমেশ ট্রলারই ভরসা। সেন্ট মার্টিন পৌঁছালাম বিকেলে। রাত কাটে ব্লু প্যারাডাইস হোটেলে। পরের দিন দ্বীপে ঘোরাঘুরি শেষে বিকেল সাড়ে ৩টার জাহাজে চেপে টেকনাফ ফিরি।
২২ অক্টোবর ভোরে ঘুম ভাঙে। সবার চোখে-মুখে এক ধরনের উত্তেজনা। কারণ লক্ষ্যের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। সকালে শাহপরীর দ্বীপের উদ্দেশে রওনা দিই। রাস্তা খানাখন্দে ভরা। কাদাপানিতে বারবার থেমে যাচ্ছিল সাইকেলের চাকা। ১৫-১৬ কিলোমিটার যেতে ঘণ্টা চারেকের মতো লেগে যায়। মাঝখানে পড়ে লবণাক্ত পানির খাল। খাল পেরিয়ে সৈকতের বালুর ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে পৌঁছে যাই শাহপরীর দ্বীপে। সবার চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস-আমরা পেরেছি। একে অপরকে আলিঙ্গন করে অভিনন্দন জানাই। আর ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক তো চলছেই।
বিকেলে মেরিন ড্রাইভ রোড দিয়ে টেকনাফে ফিরি। রাতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেন সোহাগ নামের স্থানীয় এক ভদ্রলোক। পরদিন কক্সবাজারে আসি। হোটেল কক্স টুডেতে এদিন ছিল সবার বিশ্রামের পালা। ২৪ অক্টোবর গোটা দিন ইনানী বিচ, লাবণী পয়েন্ট, সুগন্ধা বিচ, কলাতলী বিচ, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, মারমেইড রিসোর্ট, স্থানীয় শুঁটকি মার্কেট এসব ঘুরে দেখি। রাত ১০টার বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ