সাবিত খান সাবিত খান ইশি ইউইচি
কোন ব্যক্তিকে আত্মীয়, স্বামী বা স্ত্রী, সহকর্মী বা কোন ধরণের পরিচিত হিসেবে উপস্থাপনের জন্য ভাড়া করা যায় জাপানে। অর্থ দিয়ে হয়তো ভালোবাসা কেনা যায় না, কিন্তু ভালোবাসার রূপটি নিশ্চিতভাবেই কেনা যায় দেশটিতে। আর এই ‘রূপটিকেই’ সবকিছু বলে জোর দেন ইশি ইউইচি। প্রাণবন্ত এই মানুষটি এমন ব্যবসায় জড়িত, যেখানে কাউকে অন্য মানুষ হয়ে উঠতে হয়। তাই তিনি এ বিষয়ে জোরালো অভিমত দিতেই পারেন।
সুদর্শন এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ইশি ইউইচি (৩৬) বলেন, তোমার কাঙ্ক্ষিত লোকটি হয়ে উঠতে পারে তোমার সেরা বন্ধু, তোমার স্বামী, তোমার বাবা, এমনকি তোমার শেষকৃত্যে শোকাতুর কেউ।
ইশি ইউইচির কোম্পানি ‘ফ্যামিলি রোমান্স’ ৮ বছর পার করেছে। গ্রাহকদের ব্যক্তিগত জীবনে কারও ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য প্রফেশনাল অভিনেতা সরবরাহ করে তারা। দ্রুতবর্ধনশীল কোম্পানিটির ৮০০ কর্মী বাহিনী রয়েছে , যারা বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করে। এদের মধ্যে রয়েছে শিশু থেকে প্রবীণ পর্যন্ত। ‘যেকোন গ্রহণযোগ্য পরিস্থিতিতে কোন ভূমিকায় অবতীর্ণের জন্য প্রতিনিধি পাঠাতে সক্ষম’ বলে গর্ব করে সংস্থাটি।
ফ্যামিলি রোম্যান্স এর সিইও ইউইচি বিশ্বাস করেন, তার সংস্থাটি মানুষজনকে অসহনীয় অনুপস্থিতির সাথে মানিয়ে চলতে বা তার ত্রুটিগুলো গ্রহণের ব্যাপারে সাহায্য করে। বিচ্ছিন্নতা প্রকটতর হয়ে উঠা সমাজে তার ধারণা, এই ব্যবসা ও এর মতো অন্যান্যগুলোর প্রবৃদ্ধি আকাঙ্ক্ষিতজনের মিথষ্ক্রিয়ার বিষয়টিকে নতুন প্রথা করে তুলেছে।

ইশি ইউইচি
টোকিওয়ের প্রান্তে এক ক্যাফেতে সম্প্রতি রক মোরিন ইউইচির সাথে নানা বিষয়ে কথা বলেন। তাদের এই আলোচনায় উঠে আসে ইউইচির ব্যবসা ও তা তার কাছে কতটা অর্থপূর্ণ, তার কোম্পানির স্লোগান ‘মোর দেন রিয়াল’সহ (বাস্তবের চেয়ে বেশি কিছু) অন্যান্য আরও কিছু বিষয়।
আমেরিকান ম্যাগাজিন দ্য আটলান্টিকে দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
রক মোরিন: শুধু স্পষ্ট হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করছি, আপনি আজ নিজেকেই প্রতিনিধিত্ব করছেন তো, নাকি?
ইশি ইউইচি: হ্যাঁ, এই মুহুর্তে আমি শুধুমাত্র আমাকেই প্রতিনিধিত্ব করছি।
রক মোরিন: (অন্যের ভূমিকায় অভিনয়ে) আপনার একেবারে প্রথম ভূমিকাটি কি ছিলো?
ইউইচি: আমার এক সিঙ্গেল মাদার বন্ধুর এক ছেলে সন্তান ছিল। ছেলেটি একটি প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি হতে গেলে সে প্রত্যাখাত হয়। তার বাবা ছিল না, শুধুমাত্র এই কারণেই তারা তাকে স্কুলে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। আমি জাপানিজ সমাজের এই অন্যায্যতার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছিলাম। তাই আমি তার বাবার ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হই।
মোরিন: আপনি কি সফল হয়েছিলেন?
ইউইচি: না তখন হইনি। কিন্তু সেই বিষয়টি আমাকে এই ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করে।
মোরিন: আপনার প্রথম সাফল্যটা কখন এসেছিল?
ইউইচি: আমি একজন সিঙ্গেল মাদারের ১২ বছর বয়সী সন্তানের বাবা হয়েছিলাম। বাবা ছিল না সেই বালিকাটিকে উত্যক্ত করা হতো। তাই তার মা আমাকে ভাড়া করে। তখন থেকেই আমি মেয়েটির বাবার ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছি। আমাকেই সে তার আসল বাবা বলে জানে।
“আমি সবসময়ই আমার গ্রাহকদের জিজ্ঞেস করি, “তুমি কি এই মিথ্যা অব্যাহত রাখার জন্য প্রস্তুত?”
মোরিন: এবং তা এখনও চলমান?
ইউইচি: হ্যাঁ, আমি ৮ বছর যাবত তাকে দেখছি। সে মাত্র হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করলো।
মোরিন: সে কি বুঝতে পারে তুমি তার আসল বাবা নও?
ইউইচি: না, তাকে বলা হয়নি।
মোরিন: এই সত্যটা জানতে পারলে তার কেমন লাগবে বলে তোমার মনে হয়?
ইউইচি: আমি মনে করি সে হতভম্ব হয়ে যাবে। গ্রাহক যদি কখনো সত্য প্রকাশ না করে, আমাকে অবশ্যই এই ভূমিকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য অভিনয় করে যেতে হবে। মেয়েটির বিয়ে হলে সেখানেও আমাকেই বাবার ভূমিকায় থাকতে হবে এবং আমাকে তার সন্তানের দাদা হতে হবে। তাই আমি সবসময়ই আমার গ্রাহকদের জিজ্ঞেস করি, “তুমি কি এই মিথ্যা অব্যাহত রাখার জন্য প্রস্তুত?” এটাই আমাদের কোম্পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
মোরিন: তাহলে, তোমাকে আজীবন তার সাথে এভাবেই জড়িত থাকতে হতে পারে?
ইউইচি: যেকোন দিন সে সত্যটা আবিষ্কার করে ফেলতে পারে, এটা ঝুঁকিপূর্ণ। এই কোম্পানিতে, একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র ৫টি পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। এটাই নিয়ম। এটা শুধু গোপনীয়তার খাতিরে নয়। গ্রাহক সবসময়ই একজন আদর্শ স্বামী, আদর্শ বাবাকে চান। এটা খুবই কঠিন দায়িত্ব।
মোরিন: আদর্শ স্বামী বা বাবা কেমন হবে, তা তুমি কীভাবে নির্ধারণ করো?
ইউইচি: নির্দেশের তালিকায় অনেক সম্ভাব্য পছন্দের তালিকা দেয়া হয়: চুলের ছাট, চশমা, দাড়ি, ফ্যাশন সচেতনতা.. তুমি কি অভিজাত না সাধারণ পছন্দ করো? সে কি স্নেহপরায়ণ হবে না কঠোর? যখন সে পৌছাবে সেকি অনেক কথা বলবে, নাকি সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় ক্লান্ত থাকবে?
মোরিন: আগে তুমি যে মায়ের কথা বলেছিলে, সে কেমন চেয়েছিল?
ইউইচি: সে চেয়েছিল একজন সদয়, অত্যন্ত সদয় বাবাকে। যে কখনো চেঁচামেচি করবে না। সে এমন বাবা চেয়েছিল যে জ্ঞানী উপদেশও দিতে পারবে।
মোরিন: তুমি কিভাবে এমন ব্যক্তিত্ব তৈরি করলে?
ইউইচি: আমি বাস্তব জীবনে বিবাহিত নই। আমার বাচ্চা-কাচ্চাও নেই। প্রথমে তার ইচ্ছানুযায়ী বাবার সেই ব্যক্তিত্ব আমি ধারণ করতে পারি না। তাই আমি বাবাদের নিয়ে প্রচুর পরিমাণে মুভি দেখি এবং সেই মুভি থেকে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিত্বের চর্চা করি।
মোরিন: তোমার ‘ফেইক’ কন্যার সাথে কাটানো সময়গুলোর বিষয়ে জানাতে পারো?
ইউইচি: কখনো আমরা একসাথে খাওয়া দাওয়া করি। আমরা ডিজনিল্যান্ডের মতো থিম পার্কে যাই। আমরা মাসে একবার হারাজুকুতে যাই শপিং-য়ের জন্য। সেই মা প্রতি চার ঘন্টার জন্য ২০ হাজার ইয়েন পরিশোধ করে, খরচসহ। এটা প্রায় ২০০ মার্কিন ডলার।
“একাকিত্বের সময় শুধু মাথায় ঘোরে, ‘এখনকার এই আমিটা কি আসলেই আমি?’, বিষয়টা পীড়াদায়ক”
মোরিন: মেয়ের কাছে গোপনীয়তা রাখার জন্য তুমি কি বলো?
ইউইচি: আমি তাকে বলি আমার এখন নিজের একটা পরিবার আছে, এবং এজন্য আমি প্রায়ই তার কাছে আসতে পারি না।
মোরিন: প্রকৃত বাবা যেই ব্যক্তি, তার কি হয়েছে?
ইউইচি: এটা এমনকি তার মাও জানে না। সেখানে অনেক শারীরিক সহিংসতা ছিলো। তারা ডিভোর্স নিয়ে নেয়, এবং তাই ছিলো সম্পর্কটার সমাপ্তি।
মোরিন: তুমি কি তার নাম গ্রহণ করেছো?
ইউইচি: হ্যাঁ, আমি সেই বাবার নাম ব্যবহার করি, প্রথম এবং শেষটা।
মোরিন: মেয়ে রাগান্বিত বা দুঃখিত হলে তুমি তা কিভাবে সামলাও?
ইউইচি: আমি কখনোই চিৎকার করি না, যাই হোক না কেন। এটাই ছিলো নির্দেশিকায়। মেয়েটির অনুভূতি বেশ বিচলিত থাকতে পারে। তার কৈশোরের একটা বিদ্রোহী সময়ও রয়েছে। তার মায়ের সাথে তার কিছু সমস্যা ছিল। যখন সে আমার সাথে থাকে, সে সবসময় জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে কেন এখন চলে যেতে হবে?” এটা অপ্রীতিকর, কিন্তু যৌক্তিক আবেগ।
মোরিন: সে কি তোমাকে ভালোবাসে?
ইউইচি: হ্যাঁ। তার ভালোবাসা অনুভব করা সহজ। সে তার মায়ের সাথে সম্পর্ক নিয়ে কথা বলে, সে তার সংবেদনশীল অনুভূতিগুলো শেয়ার করে, নিজেকে আমার কাছে খোলা বইয়ের মতো তুলে ধরে সে।
মোরিন: কোন রূপে তোমার নিজস্বতাও কি সেখানে ডুব দিয়ে থাকে?
ইউইচি: আমি কখনোই তা অনুমোদন করি না, অন্যথায় আমি সচেতন হয়ে উঠতাম।
মোরিন: তোমার কি কখনো মনে হয়, সম্পর্কের কারণে এখন সন্তানের প্রতি তোমার দায়বদ্ধতা রয়েছে?
ইউইচি: পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা ভিন্নতর। এর গভীরতাও ভিন্ন, কিন্তু যেখানেই আমি যাই, আমি দায়িত্ববোধটা অনুভব করি।
মোরিন: তুমি যখন কাজ করো, এটা কি শুধুই বিশুদ্ধ অভিনয়? অনুভূতিগুলো কি কখনো বাস্তব হয়ে উঠে?
ইউইচি: এটা একটা ব্যবসা। আমি ২৪ ঘন্টার জন্য তার বাবা হচ্ছি না। এটা একটা নির্ধারিত সময়। অভিনয় করার সময় আমি কখনোই আসলে তাকে ভালোবাসি বলে অনুভব করি না। কিন্তু সেশনটা শেষ হলে যখন আমার চলে যেতে হয়, কিছুটা দুঃখ অনুভব করি। বাচ্চাগুলো কখনো কান্নাকাটি করে। তারা বলে, “তোমাকে কেন চলে যেতে হবে?” ওই সময়গুলোতে অভিনয়ের জন্য খুবই কষ্টবোধ হয়, গভীর অপরাধবোধ কাজ করে। কখনো কাজ শেষে বাসায় ফিরে টিভি দেখার সময় অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা হয়। মনে আসা “এখনকার এটাই কি আসল আমি, নাকি অভিনেতা?” চিন্তাটা দ্বিধায় ফেলে দেয়।
মোরিন: তুমি কিভাবে প্রশ্নটির উত্তর দাও?
ইউইচি: আমি মনে করি না আমার কাছে উত্তর আছে। যে মানুষটাকে আসলে আমি ধারণ করি, সে কি আসলে সেই আমিই আছে? আমি জানি এটা অভিনেতাদের জন্য সাধারণ। তুমি যদি আসলেই ভালো অভিনেতা হও- যদি তুমি সবসময়ের জন্য তার ভেতরে থাকো- এটা খুবই বিচলিত করে।
“সেখানে কোন সংঘাত নেই, ইর্ষা নেই, খারাপ অভ্যাস নেই। সবকিছুই নিখুঁত”
মোরিন: কখন তুমি সবচেয়ে বেশি নিজেকে অনুভব করো?
ইউইচি: আমি যখন আমার পরিবারের সাথে থাকি। আমার আসল পরিবার। একাকিত্বটা এবং শুধু ভাবা, ‘এখনকার এটাই কি আসল আমি?’ চিন্তাটা পীড়াদায়ক। মনের ভেতরের প্রশ্নগুলো কঠিন।
মোরিন: তোমার পরিবারকে যে ভাড়া করা হয়নি, তা তুমি কিভাবে জানবে?
ইউইচি: এটা একটা ভালো প্রশ্ন! কেউ জানে না।
মোরিন: স্বপ্ন সংগ্রহ সংক্রান্ত একটা প্রকল্প আছে আমার। সেখানে দেখা যায়, স্বপ্নের সাধারণ বিষয়টি হলো পেশা। তুমি কি তোমার কাজ নিয়ে কোন স্বপ্ন দেখো?
ইউইচি: আমি আমার গ্রাহকদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি- যখন আমাকে চলে যেতে হচ্ছে বলে সে কাঁদে। এটা অত্যন্ত আবেগীয় পরিস্থিতি।
মোরিন: স্বপ্নের থেকে বাস্তবতা কিভাবে ভিন্ন?
ইউইচি: মাঝে মাঝে স্বপ্নের ভেতর আমি তাকে সত্যটা বলে দেই।
মোরিন: তুমি কী বলো?
ইউইচি: আমি বলি, “আমি খুবই দুঃখিত। আমি ফ্যামিলি রোমান্স কর্পোরেশনের একজন সদস্য। আমি তোমার বাবা নই।” এর প্রতিক্রিয়া জানানোর ঠিক আগে আগে- যখন সে কথা বলার জন্য মুখটা খুলে, আমি জেগে উঠি। জবাবটা আমাকে আতঙ্কগ্রস্থ করে, তাই আমি শুধু জেগে উঠি।
মোরিন: তুমি কি তোমার স্বপ্নের ভেতরে কখনো অন্য কেউ হয়েছিলে?
ইউইচি: জাপানিজ ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে, এমন একটা পরিস্থিতি আছে, যেখানে ভুলের জন্য ঝুঁকে পড়ে তোমাকে গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। কখনো কখনো আমি এটা নিয়ে স্বপ্ন দেখি।
মোরিন: এটা কেমন কাজ করে, যখন বাস্তব জীবনে তোমাকে এমনটি করার জন্য ভাড়া করা হয়?
ইউইচি: সাধারণত, ভুল করেছে এমন একজন চাকরিজীবীর সাথে আমি যাই। সেই চাকরিজীবীর পরিচয়টা নিজে ধারণ করি। পরে আমি তার ভুলের জন্য গভীরভাবে ক্ষমা চাই। আমরা যেভাবে স্যরি বলি তা কি দেখেছো? মাথাটা নিচু করে দাঁড়াতে হয়, মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসতে হয়। তখন আমার গ্রাহক পাশে দাঁড়িয়ে থাকে- যে ব্যক্তিটি আসলেই ভুলটা করেছে- এবং আমি মেঝেতে ঝুঁকে যাই। তখন রেগে অগ্নিশর্মা বস দাঁড়িয়ে আমার উদ্দেশ্যে অপমানকর কথা ছুঁড়তে থাকে। মাঝে মাঝে ভাবি, “আমি কি আসলেই এমনটি করছি?”
মোরিন: তুমি তখন কেমন অনুভব করো?
ইউইচি: আমি খুবই অস্বস্তিবোধ করি। শুধু ভাবি, “ আমি নিষ্পাপ!” আমি আসল অপরাধীর দিকে নির্দেশ করে চিৎকার করে বলতে চাই,“ভুলটা সে করেছে!”
মোরিন: কোন পরিস্থিতিতে ক্ষমা চাওয়ার জন্য কখনো কি তোমাকে ভাড়া করা হয়েছিলো?
ইউইচি: হ্যাঁ, কখনো কখনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে। ভাবো, একজন দম্পতির কথা, যেখানে স্ত্রী তার স্বামীর সাথে প্রতারণা করছে। এমন হলে, স্বামী প্রায়ই তৃতীয় ব্যক্তিটির সাথে একটা বোঝাপড়া করতে চায়। সাধারণত এর আয়োজন করা খুবই কঠিন, কারণ ব্যক্তিটি সাধারণত পালিয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে তারা আমাকে নিয়ে যায়।
মোরিন: পরবর্তীতে কী হয়?
ইউইচি: সবকিছুর জন্যই এই কোম্পানির কিছু ম্যানুয়াল আছে। অনুকূল ফলের জন্য আমরা মনস্তত্ত্ব ব্যবহার করি। এক্ষেত্রে, মান কৌশলটি হলো নিজেকে গ্যাংস্টারের মতো উপস্থাপন করা। সাধারণত স্ত্রীর সাথে তার স্বামীর সামনে উপস্থিত হলে, আমি হঠাৎ করেই শুধু ঝুঁকে গভীরভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করি। সাধারণত, স্বামীটি আমাকে ভর্ৎসনা করে কিন্তু আমার গ্যাংস্টার রূপের জন্য বিষয়টা নিয়ে সে আর আগায় না।
মোরিন: বয়ফ্রেন্ড হয়েওতো কাজ করো তুমি। অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করবে?
ইউইচি: এই গ্রাহকগুলো সাধারণত বয়স্ক নারী। প্রথমদিকে এটা ছিলো ৫০ বছরে নারীদের মধ্যেই, কিন্তু ৩০ বছরের নারীরাই এখন অনেক বেশি।
মোরিন: এটা কি সেক্সুয়াল না নিষ্কাম?
ইউইচি: এটা ডেটিং পরিস্থিতি। এটা সেক্সুয়াল সম্পর্কের বিষয় না, যদিও কোন কোন নারী তা প্রত্যাশা করে। সাধারণত, নারীরা একজন তরুণের সাথে কিছুটা উপভোগ্য সময় কাটাতে চায়। আবারও তারুণ্যে ফিরে যেতে চায়।
মোরিন: তুমি কি মনে করো, এই নারীরা কেন তোমাকে ভাড়া করে?
ইউইচি: এই নারীরা সাধারণত বলে, আসল সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে বিশ্বাস নির্মাণ করতে হয়। একটা শক্ত যোগাযোগ তৈরির জন্য বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। তাদের জন্য এখানে অনেক ঝামেলা, হতাশা রয়েছে। ভাবো, কারো সাথে পাঁচ বছর সময় বিনিয়োগের পর সে যদি ব্রেক আপ করে? অন্যদিকে প্রতি সপ্তাহে দুই ঘন্টার জন্য একজন আদর্শ বয়ফ্রেন্ডের সাথে সময় কাটানো খবুই সহজ। সেখানে কোন সংঘাত নেই, ইর্ষা নেই, খারাপ অভ্যাস নেই। সবকিছুই একেবারে নিখুঁত।
মোরিন: তোমাকে অনেক ফেইক ডেট করতে হয়েছে- ব্যক্তিগত জীবনে আসল ডেটে যাওয়াটা তোমার জন্য কেমন?
ইউইচি: আমার এখন কোন আসল গার্লফ্রেন্ড নেই। প্রকৃত ডেটিংগুলো কাজ করার অনুভুতি দেয়। আসল ব্যক্তির প্রতি যত্নবান হওয়ার মতো কাজ বলে মনে হয়।
মোরিন: নিজের পরিবারের জন্য তোমার পরিকল্পনা নেই?
ইউইচি: সৎভাবে বললে, আমি সম্পূর্ণ। আমি পরিবারে পূর্ণ, ম্যানেজ করার জন্য তা অনেক বলেই আমি মনে করি। মাঝে মাঝে গ্রাহকরা সন্তান জন্মদানের সময়ও সেই রুমটিতে থাকতে বলে আমাকে। একবার, এক নারী গ্রাহক চেয়েছিল প্রসবের সময় তার অভিভাবকরা নয়, যেনো আমি সেখানে থাকি। তাই আমি সেখানে গিয়েছিলাম। কিছু নারী আমাকে প্রস্তাব দেয়। আমি তাদের না বলি, কিন্তু না বলাটা আমার জন্য খুবই কঠিন।
মোরিন: কেন?
ইউইচি: অনেক নারী বলে, “আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।” আমি বলি, “তুমি একটি ফরমায়েশী ব্যক্তিকে ভালোবাসছো। এটা আমি নই-যাকে তুমি ভালোবাসো তা একটি অভিনয়।” আমি যদি তাকে বিয়ে করি, আমাকে অভিনয় করে যেতে হবে। এদের মধ্যে কিছু নারী অপূর্ব, কিন্তু তাদের সাথে আমি যেমন থাকি তা তো আসল আমি নই। তাই আমি পারি না। আমি তা হতে দেই না।
মোরিন: তুমি কি কখনো অভিনয়ের তুমিটাকে ‘নিজের’ মধ্যে ধারণ করাটা পছন্দ করো?
ইউইচি: আমি যত্নবান বাবা হওয়ার অভিনয়টা পছন্দ করি। আমি বাচ্চাদের সাথে খেলি, এমনকি ক্লান্ত থাকলেও। এটা খুব কঠিন হলেও তা দেখাতে হয়, সুখ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হয়। এমন বাবার প্রশংসা করি আমি, এমনকি তা আমি হলেও।
মোরিন: তোমার প্রিয় ভূমিকাটা কি?
ইউইচি: এটা বেশি হয় না, কিন্তু কখনো আমাকে বর হতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, অভিভাবকরা সমকামী কন্যাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে এমন পরিস্থিতি হয়। এজন্য, তাদের একটি বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হয়। যেখানে গ্রাহকের পরিবার ছাড়া আর সবাই ফেইক। আমার পক্ষের বন্ধু এবং অন্য সবাই সম্পূর্ণ ফেইক। পঞ্চাশজনের মতো ফেইক মানুষ আসল হওয়ার অভিনয় করে। এর জন্য গ্রাহকের খরচ হয় ২ মিলিয়ন ইয়েন।
“ শুধুমাত্র ৫ জন কর্মীর সাথে লাস ভেগাসে যেতে ও ফেসবুকের জন্য ছবি তুলতে এক ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছ।”
মোরিন: তুমি কতবার বিয়ে করেছো?
ইউইচি: তিনবার।
মোরিন: কনেরা- তোমাকে আবার কখনো দেখবে না?
ইউইচি: আমরা আর কখনোই দেখা করি না।
মোরিন: একজন অপরিচিতকে বিয়ে করতে গিয়ে কনেরা কি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে?
ইউইচি: নারীরা সাধারণত আমাকে আবেগ দেখাতে পছন্দ করে না, কিন্তু মাঝে মাঝে আমি আবেগ অনুভব করি। আমার পক্ষের সবাই আমার সহকর্মী। তারা সবাই আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। তাই এমন একটা সময় আসে যখন তা খুবই বাস্তব মনে হয়।
মোরিন: এই ধরণের ব্যবসা জাপানে প্রতিষ্ঠালাভের কারণ কী বলে তুমি মনে করো?
ইউইচি: জাপানিজরা বহির্মূখী না। এখানে একটা যোগাযোগের ঘাটতি আছে। আলাপচারিতার ক্ষেত্রে, আমরা নিজেদের, আমাদের মতামত, আবেগ প্রকাশ করি না। নিজস্ব আকাঙ্ক্ষার চেয়ে অন্য বিষয়গুলো প্রথমে চলে আসে। পরিবারের আকারও ছোট হচ্ছে, যা আগে বড় ছিল। এখন তোমাকে একা খেতে হয়।
মোরিন: তোমার ব্যবসা সম্পর্কে তোমার পূর্বাভাস কি?
ইউইচি: চাহিদা বাড়ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয় হতে চায়। আমরা এমন লোকও পেয়েছি যে অনেক অর্থ খরচ করেছে শুধু মাত্র ৫ জন কর্মীর সাথে লাস ভেগাসে উড়ে গিয়ে তার ফেসবুকের জন্য ছবি তোলার জন্য।
মোরিন: তুমি বা তোমার কর্মীরা কি কখনো অভিনেতাদের ভাড়া করেছো?
ইউইচি: এটা হয়। কখনো, কিছু কর্মী তাদের প্রশংসা করার জন্য অভিনেতাদের ভাড়া করে। ব্যক্তিগতভাবে আমি যখন সেমিনারে কথা বলি, আমি কিছু এক্সট্রা নিয়ে যাই সমাগমের মধ্যে সমর্থক বাড়াতে।
মোরিন: বিশ্বের সবাই কি প্রতিস্থাপনযোগ্য?
ইউইচি: এটা খুবই ভালো প্রশ্ন। আমি নিশ্চিত নই। একটি ঘটনায়, ৬০ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তির স্ত্রী মারা যায়। সে স্ত্রীর একটি কপির জন্য আদেশ করে। আমরা তা সরবরাহ করি।
মোরিন: এবং সে কি নতুন নারীটিকে তার স্ত্রীর পুরনো নামেই ডাকে?
ইউইচি: হ্যাঁ, একই নামে, এবং সে চায় সেই নারীও তাকে সেই নামেই ডাকুক যে নামে তার স্ত্রী তাকে ডাকতো। নারীটি তাকে ডাকতো অটোসান বলে- যার মানে বাবা। জাপানে বাবা ডাকাটা খুবই প্রচলিত, এমনকি তুমি তার স্ত্রী হলেও।
মোরিন: স্ত্রী হিসেবে তার কি একই স্মৃতিগুলো আছে?
ইউইচি: কিছু নির্দিষ্ট স্মৃতি আছে। একটি সাদা কাগজে সেই গ্রাহক কিছু স্মৃতি লিখে দিয়েছিলো, যা তিনি চাচ্ছিলেন যে তার স্ত্রী মনে রাখুক।
মোরিন: যখন তোমার কর্মীরা এমন গভীর আবেগীয় যোগাযোগের নকল করে- এটা কি কখনোও এমন সমস্যা হয়, যে সে তার গ্রাহকের সাথে অত্যন্ত আবেগীয়ভাবে যুক্ত হয়ে যায়।
ইউইচি: আবেগ একটি সমস্যা। তাই নিয়ম আছে। তারা ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্য শেয়ার করতে পারে না। বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডের অভিনয়ের জন্য রুমে একা থাকতে পারে না। তারা হাত ধরতে পারে, কিন্তু তারা জড়িয়ে ধরতে পারে না। চুমু, সেক্স নিষেধ।
“আমি বিশ্বাস করি ‘বাস্তব’ শব্দটি পথভ্রষ্ট।”
মোরিন: প্রতিযোগীদের চেয়ে কোন কোন বিষয়গুলো তোমার কোম্পানিকে ভিন্ন করে?
ইউইচি: আমাদের কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে। অভিজ্ঞতা সৃষ্টিতে তাদের নিবেদন অনেক সময় বাস্তবতাকেও ছাড়িয়ে যায়। এজন্যই আমাদের স্লোগান, “মোর দেন রিয়াল” (বাস্তবের চেয়েও বেশি কিছু)। সম্প্রতি এক ঘটনায় মৃত্যুশয্যায় এক ব্যক্তি তার নাতিকে দেখতে চায়, কিন্তু শিশুটির তখনও জন্ম হয়নি। তার মেয়ে তখন একটি শিশুকে একদিনের জন্য ভাড়া করে।
মোরিন: ‘বাস্তবের চেয়ে বেশি কিছু’ এর মানে কি?
ইউইচি: এখানে উদ্বেগ কম, ভুল বোঝাবুঝি কম, সংঘাতও কম। আমাদের গ্রাহকেরা ভালো ফলের প্রত্যাশা করতে পারে।
মোরিন: বাস্তবতার চেয়েও নিখুঁত রূপের সুযোগ দিচ্ছো?
ইউইচি: আরও আদর্শ। আরও পরিষ্কার।
মোরিন: এমন কি কোন অনুরোধ ছিল যা তুমি প্রত্যাখান করেছো?
ইউইচি: অপরাধ না হলে, আমরা যে কোন ধরণের অনুরোধ রক্ষা করি। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষুধামন্দায় ভোগা কিছু ব্যক্তি তাদের সামনে কাউকে খেতে দেখতে চায়। প্রচুর খেতে পারে এমন কাউকে দেখে সে তৃপ্তি পেতে পারে। এর ব্যবস্থাও আমরা করি।
মোরিন: ‘বাস্তব’ শব্দটার অর্থ তোমার কাছে কি?
ইউইচি: আমি বিশ্বাস করি ‘বাস্তব’ শব্দটি পথভ্রষ্ট। ফেসবুক দেখো। এটা কি আসল? ছবির লোকগুলো ভাড়াটে না হলেও বাস্তবতা বিবর্জিত বিষয়ই তোমাকে দেখানো হয়।
মোরিন: তুমি কি বিশ্বাস করো ‘আসল’ ধারণাটি অবৈধ হয়ে গেছে?
ইউইচি: আমি বিশ্বাস করি, এই শব্দটা অন্যায্যও। এই অন্যায্যতার উপরেই আমাদের ব্যবসা দাঁড়িয়ে।
মোরিন: মানে তুমি অন্যায়কে শুদ্ধ করছো?
ইউইচি: বয়ফ্রেন্ড থাকা একজনের প্রয়োজন নেই বয়ফ্রেন্ড ভাড়া করার। বাবা থাকা একজনের প্রয়োজন নেই বাবা ভাড়া করার। এটা সমাজে ভারসাম্য আনার বিষয়।
মোরিন: সত্যকে একেবারে এড়িয়ে চলা কি সম্ভব?
ইউইচি: শেষ পর্যন্ত সত্যকে প্রকাশ পেয়েই যায়। সুখ কখনোই অন্তহীন নয়, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তা মূল্যবোধহীন। একটা শিশু তার সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় বাবাকে পাবে। তা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হতে পারে। সে হয়তো এখন সত্যটা জানে। কিন্তু সেই সময়টিতে একটি অর্থপূর্ণ অভিজ্ঞতা লাভ করেছে সে।
মোরিন: ব্যক্তিগত জীবনে, তুমি এমন কি চাও যা তোমার নেই?
ইউইচি: আমার আসলে চাওয়ার মতো আর বেশি কিছু নেই। আমি অনেক গ্রাহককে দেখেছি। আমি তাদের সাথে অনেক ভূমিকায় অভিনয় করেছি। আমার কাজের মাধ্যমে, তাদের স্বপ্নগুলো সত্যি হয়েছে। এইভাবে আমার স্বপ্নগুলোও সত্যি হয়েছে। মনে হয় বাস্তবতাটাই শুধু প্রয়োজন। সৌজন্যে : চ্যানেল আই