পাকা সড়কের দুই ধারে গড়ে উঠেছিল সরাইখানা, মসজিদ, মন্দির, খাজাঞ্ঝিখানা, গোসলখানা, প্রমোদালয় পৃথিবীর ১শ’ ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক নগরীর একটি এই নগরী। লিখেছেন আনোয়ার আলদীন।
রাজধানীর উপকণ্ঠে পানাম সিটি। সোনারগাঁওয়ের বর্ণাঢ্য ইতিহাসের শেষ পর্দাটি পড়েছিল এই পানাম নগরকে কেন্দ্র করেই। পানামের লোনা ইটের ফাঁকে ফাঁকে শেওলার মদির গন্ধ এ প্রজন্মকে করেছে নস্টালজিক। রহস্য, দুর্বোধ্যতা, রোমাঞ্চ ও স্থাপত্যিক, নান্দনিক কারিশমা পানামকে করেছে অজেয়।
কালের করাল গ্রাসের থাবায় পানাম অক্ষত থাকেনি। শাবল, গাঁইতি আর কোদালের নির্মম আঘাতে পানাম হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। ইতিহাস-ঐতিহ্যবিমুখ মানুষ পানামকে ছাড় দেয়নি। আবারো জেগে উঠতে শুরু করেছে। তবে তার অবয়বে আর বৈভব নেই। সরু রাস্তার দু’পাশে গড়ে ওঠা ৪৯টি অট্টালিকার সরাইখানা, মসজিদ, মন্দির, মঠ, ঠাকুরঘর, গোসলখানা, কূপ, নাচঘর, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্তপথ, প্রশস্ত দেয়াল, প্রমোদালয়, ট্রেজারি, অস্ত্রাগারস্থ, স্মৃতিবিজড়িত ইমারত এখন ক্ষয়ে ক্ষয়ে মলীন। পানাম নগর পৃথিবীর ১০০টি ধ্বংসপ্রায় ঐতিহাসিক শহরের একটি।
পানাম নগরী মূলত ছিল তাঁত ব্যবসায়ীদের কেন্দ্র ও আবাসস্থল। মসলিনেরও কেন্দ্র ছিল। নগরীর নগর পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য হলো এটি লেক বা খাল দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং সুরক্ষিত গেট দ্বারা আবদ্ধ। সন্ধ্যার পূর্বেই গেটসমূহ বন্ধ করে দেয়া হতো। নগরীর অধিবাসীরা নিরাপদ জীবন যাপন করতেন। পানাম শব্দের ফারসি উত্স থেকে জানা গেছে, এর অর্থ হল আশ্রয়স্থল। পানাম নগরীতে মূলত বড় ব্যবসায়ী ও জমিদাররা বসবাস করতেন। পানামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পঙ্খীরাজ খাল। এ খাল পানামের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলো ছুঁয়ে পূর্বদিকে মেনিখালি নদ হয়ে মেঘনা নদীতে মিশেছে। পানামকে ঘিরে মসলিন ও কারুশিল্পের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল এ উপমহাদেশ ছাড়িয়ে পাশ্চাত্যে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড়, এদেশ থেকে যেত মসলিন। ইংরেজরা এখানে নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র খুলে বসে। মসলিনের বাজার দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য। ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড ২০০৬ সালে “হারিয়ে যাওয়া শহর” পানাম নগরকে বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় প্রকাশ করে। পানামের দিকে পুরো নজর দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ইতিহাসবিদ এবং ঐতিহ্য সংরক্ষকরা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পানাম নগরের বাড়িগুলো ইজারা দেয় হয়। কিন্তু অযত্ন আর অবহেলায় বাড়িগুলো নষ্ট হতে থাকে। ফলে ইজারা বন্ধ করা হয়। সংরক্ষণের অভাবে এসময় দুটি বাড়ি সম্পূর্ণ ধসে যায়। ১৯৭৫ সালে ১২ মার্চ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পানাম শহরে গড়ে তোলেন লোকশিল্প সংগ্রহশালা ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন’। প্রাথমিক অবস্থায় পানাম শহরের একটি দ্বিতল বাড়িতে ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ড আরম্ভ হয়। পরবর্তীকালে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন ‘বড় সরদার বাড়িতে’ স্থানান্তর করা হয়। এবং এ বড় সরদার বাড়িকে ঘিরেই জাদুঘর গড়ে ওঠে। ক্রমে ক্রমে জাদুঘর সম্বলিত শতাধিক বছরের বর্ণাঢ্য, ঐশ্বর্যশালী, টেরাকোটা, মনোমুগ্ধকর তোরণ, জলসাঘর, হেরেম, প্রাসাদ সংলগ্ন বহির্বাটির এবং অন্দরমহলের দীঘি, কংক্রিটের ঘোড়ায় উপবিষ্ট অস্ত্রধারী সৈনিকের দুটি ভাস্কর্য বাংলাদেশ এবং বহির্বিশ্বের পর্যটকদের কাছে টানে। ‘‘বড় সরদার বাড়ি’’ প্রাসাদের চারদিকে ঘিরে আছে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য, এ বিশাল বাড়িটির দুধারেই আছে দুটো বড় দীঘি, এ দীঘির জলে মাছ খেলা করে, দীঘিতে ছায়া পড়ে প্রাসাদের, ঝলমল রাতে প্রাসাদের লাল, নীল, সবুজ চিনামাটির বর্ণাঢ্য তোরণের ছবি দীঘিতে পড়ে এক অপরূপ ছায়াবাজির সৃষ্টি করে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আধুনিক পর্যটননগরী গড়তে সমপ্রতি পানামের বাইরে দিয়ে আমিনপুর হয়ে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করেছে। পানামের ভিতরের রাস্তাটি বন্ধ করে স্থানীয়দের যাতায়াতের সুবিধার্থে বাইপাস সড়ক দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে ভিড় জমান।
পানাম নগরে ঢুকেই চোখে পড়বে একটি সরু রাস্তার ধারে সারি সারি পুরনো দালান। কোনটা দোতলা কোনটা একতলা। বাড়িগুলোর স্থাপত্য নিদর্শন দেখে বোঝা যায় এখানে ধনী বণিক শ্রেণির বাসস্থান। প্রতিটি বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই লোহার তৈরি ব্রাকেট। জানালায় ব্যবহার করা হয়েছে লোহার গ্রিল এবং ঘরে বাতাস চলাচলের জন্য ভেন্টিলেটর বাড়িগুলোতে কাস্ট আয়রনের নিখুঁত কাজ আছে এবং ইউরোপে ব্যবহূত কাস্ট আয়রনের কাজের সাথে এই কাজের অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়। এছাড়াও মেঝেতে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ লক্ষণীয়। নগরীর ভিতরে আবাসিক ভবন ছাড়াও আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, গোসলখানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবার কক্ষ, গুপ্ত পথ, বিচারালয়, পুরনো জাদুঘর। আছে ৪০০ বছরের পুরনো টাকশাল বাড়ি। পানাম সড়কের উত্তর পাশে ৩১টি আর দক্ষিণ পাশে ২১টি বাড়ি আছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ি দুটি অংশে বিভক্ত। একটি বহির্বাটী এবং অন্যটি অন্দর-বাটি এবং বাড়ির সামনে উন্মুক্ত উঠান আছে। প্রতিটি বাড়ি পরস্পর থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত। নগরীর মাঝখান দিয়ে
একটি সরু রাস্তা পানাম নগরীর ভেতর দিয়ে চলে গেছে। পানাম পুলের কাছে দুলালপুর সড়কের খুব কাছেই আছে নীলকুঠি। নীল চাষের নির্মম ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে পানামের নীলকুঠি। নিরাপদ পানির জন্য প্রতিটি বাড়িতেই কূপ ছিল। নগরীতে পাঁচটি পুকুর ও নগরীর দুপাশে দুটি খাল কাটা হয়েছিল। জলাবদ্ধতা না হয় সেজন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। এখানে আছে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহির শাসনামলে নির্মিত একটি মসজিদ। মসজিদটির নাম এখন গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ। সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর থেকে পশ্চিম দিকে এই মসজিদ। মুগরাপাড়া থেকে দক্ষিণ দিকে আরও কিছু ইমারত আছে যেমন বারো আউলিয়ার মাজার, হযরত শাহ ইব্রাহিম দানিশ মন্দা ও তার বংশধরদের মাজার, দমদম দুর্গ ইত্যাদি। ঈসা খাঁর ছেলে মুসা খাঁর প্রমোদ ভবন যেমন আছে তেমনি রয়েছে ফতেহ শাহের মাজার, সোনাকান্দা দুর্গ, পঞ্চপীরের মাজারসহ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন।
ইমারতের ইতিকথা
প্রায় পৌনে দুইশ বছর আগে ‘পরিব্রাজক’ জেমস টেলর সোনারগাঁও ভ্রমণ করেছিলেন। জেমস টেলর পানামকে বলেছিলেন ‘পাইন্নাম’। জেমস টেলরের বর্ণনায় ঘন পত্রপল্লবে আচ্ছাদিত পানাম ছিল একটি অস্বাস্থ্যকর স্থান। বিশেষত বর্ষাকালে ঘোড়া এবং হাতি ছাড়া কর্দমাক্ত রাস্তা পার হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। পানামে ঢুকতে মোগল আমলের একটি সেতু আছে (বর্তমানে যা ধ্বংস হয়ে গেছে)। এই সেতু থেকে লক্ষ্য করলে একটি গলির দু’ধারে, দোতলা-তিনতলা পুরনো ইমারত দেখা যায়। ’পাইন্নাম’ শহরের চারদিক ঘিরে রয়েছে খাল, জলাভূমি, বিশাল দীঘি।
বাংলার মসলিনের জন্মভূমি
পৃথিবী খ্যাত মসলিন শবনম, মলমুলখাস, আব-ই-রওয়া উত্পাদিত হত পানাম নগরের আশপাশ ঘিরেই। জেমস টেলর তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘‘ট্রপোগ্রাফি অব ঢাকাতে’’ উল্লেখ করেছেন, আড়ংয়ের তাঁতখানা ছিল সোনারগাঁয়ের পানামে। এখানে গড়ে ওঠে মসলিনের প্রসিদ্ধ বাজার। নদীপথেই এই মসলিন যেত দূরদেশে। মসলিনের উপমহাদেশ খ্যাত আড়ং ও প্রশাসনিক দপ্তর রাজগৃহ ও সামরিক গ্যারিসন হিসেবেও পানাম এবং তার আশপাশের অঞ্চলগুলো মসলিন কাপড় বয়ন, বাণিজ্যকরণের একটি বিখ্যাত স্থান হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথের বিশেষ দূত রালফ ফিচ ১৫৮৬ খৃঃ সোনারগাঁও ভ্রমণ করেন। রালফফিচের ভ্রমণ বৃত্তান্তে ঈসাখাঁকে অঞ্চলের বড় রাজা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, রালফ ফীচ উল্লেখ করেছেন বিক্রমপুরের রাজধানী শ্রীপুর থেকে ছয়লিগ দূরে ঈসাখাঁর রাজধানী, সেখানে মূল্যবান বস্ত্র মসলিন তৈরি হয়, সেখানে এক প্রকাণ্ড দীঘি আছে, সোনারগাঁও এলাকার লোকজন ধনী, তারা সিংহল, পেগু, মালাক্কা, জাভা, উপ-মহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বস্ত্র, চাল, মশলা, ঝিনুকের দ্রব্যাদি রপ্তানি করে। ঈর্ষার অনলদগ্ধ ইংরেজরা এই মসলিন শিল্পীদের আঙ্গুল কেটে এই শিল্পে আঁধার নামায়।
কয়েক বছর আগের বর্ষায় কয়েকটি ইমারত ধসে পড়ার পর প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের উদ্যোগে পানাম রক্ষায় পাঁচ কোটি টাকার একটি কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। এ বিষয়ে সাত সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এই কমিটি নগর পরিদর্শন করে ডকুমেন্টেশন, বিল্ডিং তৈরিতে ব্যবহূত উপাদান, বিল্ডিংয়ের কাঠামো, রোডম্যাপ তৈরির পরামর্শ দেয়। গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর তাদের পানাম সিটির কার্যালয়ে পানাম সিটির ঐতিহ্য সুরক্ষায় বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে এর উন্নয়ন রূপরেখা তৈরির জন্য এক সভা করে। সভায় এই সিটির সুরক্ষায় অভ্যন্তরের রাস্তায় ভারি যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে উত্তর পাশের বাইপাস রাস্তা চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রাখা, পুরনো ভবনগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ, পরিখা উন্নয়ন, জাদুঘর স্থাপন এবং অফিস ভবন ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণসহ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে বাস্তবতা হলো এসব তাগিদ, সংস্কার-সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত কেবল কাগজ-কলমে সীমাবদ্ধ। বাস্তবায়ন হচ্ছে খুব কমই। অভিযোগ উঠেছে, দেয়ালগুলোতে প্লাস্টারিং করে আদিরূপ পাল্টে ফেলা হচ্ছে। ইতিহাসবিদ ও ইতিহাসপ্রেমিকরা মনে করেন দক্ষ স্থপতি, ইতিহাসবিদ, সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং কেমিস্টের সুচিন্তিত মতামত নিয়ে এবং স্থাপত্যিক নকশা অনুসরণ করেই পানাম নগরী সংস্কারের কাজ চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। পানামের চারপাশের পঙ্খিরাজ খাল, জলাশয়, পানামের বিখ্যাত দীঘিগুলোর চারপাশের ঐতিহাসিক শান বাঁধানো ঘাটগুলোর অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। প্রাচীন সেতুগুলোকেও প্রত্নতত্ত্ব রক্ষার রোডম্যাপে আনতে হবে। এসব বিষয় হতে হবে অবশ্যই দীর্ঘ পরিকল্পনা মাফিক, স্থাপত্যবিদ, ইতিহাস, পরিচ্ছন্ন নকশা এবং কেমিস্টের মাধ্যমে। সূত্র : ইত্তেফাক।