Skip to content

নদী আর নদীর শহরে

লিয়াকত হোসেন খোকন
নদীর নাম বলেশ্বর। পিরোজপুর শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে দক্ষিণে। বসে আছি নদী তীরে। তখন বিকাল চারটা। আকাশে দেখা যাচ্ছে মেঘ, সেই ক্ষণে শখ চাপলো নৌকাতে বলেশ্বরের বুকে কিছু সময় বেড়ানোর। ঘাটে নৌকা বাঁধা। ষোলো হবে হয়তো বয়স এমন একজন মাঝিকে বললাম, তোমার নাম? হেসে বলে ‘কৃষ্ণ’। নৌকায় উঠে বসলাম। নৌকা ছেড়ে দিয়েই বৈঠা হাতে কৃষ্ণ গান ধরলো ‘সাঁঝেরবেলা জলের ঘাটে রে/পায়ের নূপুর খইসা যায় হে নাগর…।’

Balesshorগান শেষ হতেই দেখি নৌকা নদীর মাঝপথে এসে গেছে। বাহ কী অপরূপ বলেশ্বর! বাতাসে নৌকা দুলছে হেলে-দুলে। দেখে ভয়ে আঁতকে উঠলাম। পাশ থেকে এক মাঝি নৌকা নিয়ে চলছে আরেক দিকে। এক নির্জন তীরে নৌকা ভিড়িয়ে কৃষ্ণ বললো, ওই যে মহিষপুরা গাঁও। ওখানে এক সময় প্রায় বাড়িতে মহিষ পালন করা হতো। সেই থেকে মহিষপুরা। দুঃখ কী জানেন, আজ এখানে কোনো বাড়িতে গিয়ে মহিষ-টহিষ আর দেখতে পাবেন না। ধান ক্ষেতের অধিকাংশ এলাকায় গড়ে উঠেছে বাড়িঘর আর ইটের ভাটা। যা কিনা পরিবেশকে করছে দূষণ।

বলেশ্বর নদীকে দেখছি আর ভাবছি, একদিকে বাগেরহাট জেলা আরেক দিকে পিরোজপুর জেলা। একই সঙ্গে দুই জেলা দেখা-এও কী কম ভাগ্যের কথা!

বর্ষা নেমে আসতেই কৃষ্ণকে বললাম, নৌকা দামোদর খালে ঢুকাও। দামোদর খালের একদিকে একটা কদম গাছে কদম ফুল দেখে বললাম, এই যে কৃষ্ণ ওই যে ‘কদম ফুল’। নৌকা ঘাটে বেঁধে গাছে উঠে একটি কদম ফুল এনে আমার হাতে দিলো। মনে মনে ভাবলাম, মাঝিরা কী এতোটা আন্তরিক হয়। মাঝির মধ্যেও মন আছে।

পিরোজপুরে আছে রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি, মঠ, মন্দির, কালী মন্দির, পাকিস্তান আমলের মন্ত্রী সৈয়দ আফজাল মিয়ার বাড়ি, শিশুপার্ক ও শহীদ ওমর ফারুক সড়ক। একটু দূরে গেলেই দেখবেন শংকরপাশা গ্রাম— সেই গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলার এক আধুনিক কবি আহসান হাবিব। নৌকায় বসে দেখছি পিরোজপুরের কতো না বাড়িঘর। এখানে দামোদর খালের উত্তর পাড়কে বলা হয় রাজারহাট। রাজারহাটে বসতি ছিলো শতকরা ৯০ ভাগ হিন্দু পরিবারের। সময়ে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। মনে পড়লো ওখানেই তো ছিলো লীলা আর চপলাদের বাড়ি। সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ভবন দেখে মনে পড়লো, অতীতের কথা। একদা এখানেই ছিলো প্রাইমারি স্কুল— প্রধান শিক্ষক ছিলেন রহমান স্যার; সেটি আর চোখে পড়লো না। ১৯৬১ সালে ঘূর্ণিঝড় আর বন্যায় কতো না ক্ষতি হয়েছিলো পিরোজপুরের। তখনই চোখের পাতায় ভেসে উঠলো সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের কথা। ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে জিন্নাত মোক্তারের মেয়ে রোজি গান গেয়ে আর রুবি নৃত্য দেখিয়ে দর্শকদের মাতোয়ারা করতো। ক্ষমা দাস গুপ্তা স্টেজে বসে যখন গাইতো— ‘ভুল সবই ভুল’ তখন কতো না জনতার ভিড়। সেই দিন তো আর ফিরে আসবে না!

এদিকে নৌকা রাজারহাট ব্রিজ ছাড়িয়ে এগিয়ে চলছে। একে একে দেখে নিলাম উপেন এদবর উকিলের বাড়ির রাস্তা, বাজার, ক্ষেত্র মোহন মাঝির পুত্র প্রদীপদের বাড়ি (যা কিনা এখন পদ্মা হোটেল), চান মিয়া চৌধুরী, বাদশা চৌধুরীর বাড়ি, আরেকদিকে ইরা টকিজের বাদশা মানিকের বাড়ি। অতঃপর নৌকাচালক কৃষ্ণকে বললাম, তুমি আফজাল মিয়ার বাড়ির কাছে নৌকা ভিড়াও। নৌকা থেকে নেমে এলাম তার দ্বিতল বাড়ির সামনে। তার আমলেই তো নির্মিত হয়েছিলো পিরোজপুর-হুলারহাট সড়কটি। প্রায় ৪০ বছর আগে তিনি লোকান্তরিত হলেও তার দ্বিতল ভবন, ঈদগাহ মাঠ স্মরণ করিয়ে দেয় পিরোজপুরের অতীত গৌরবময় দিনগুলোর কথা…।

পিরোজপুরের ৫ মাইল পূর্বে বিশাল কচা নদী হয়ে এবার লঞ্চ এগিয়ে চলছে ভাণ্ডারিয়ার দিকে। লঞ্চে বসেই দূরের চরখালী আবছা আবছা দেখলাম। লঞ্চ থেকে নেমেই এলাম ভাণ্ডারিয়ার বিউটি বোর্ডিং নামক হোটেলে। ম্যানেজারের সঙ্গে পরিচিত হয়েই বললাম, ভাণ্ডারিয়া দেখব বলেই যে এসেছি। কথাটা শুনে তিনি একটু হেসে— সুপারি বাগান, নারকেল বাগান আর পানের বরজ দেখবেন। বড্ড ভালো লাগবে এই ভাণ্ডারিয়াকে। এখানে সবুজ শ্যাম গাঁয়ের রূপ আপনাকে ভীষণ আকৃষ্ট করবে। সবুজের মোহমায়ায় জড়িয়েও পড়বেন।

বিকাল হওয়ার আগেই ভাণ্ডারিয়া দেখতে বের হলাম। হেঁটে কিছুদূর যেতেই দেখতে পেলাম এক নির্জন গাঁয়ের পথ। আঁকাবাঁকা গাঁয়ের পথ ধরে একটু এগিয়ে শুনি পাখির ডাক। মনে হয়, ওই বুঝি ঘুঘু ডাকছে। দেখি এক রাখাল ছেলে গরুর পাল নিয়ে এদিকে আসছে। ওদিকে দেখি এক গাছের তলে বসে এক তরুণ। ওর কণ্ঠে গান চলছে। গানটা শেষ হতেই ওই তরুণকে জিজ্ঞাসা, ‘এ গান তুমি গাইছ কেন?’ তরুণটি বললো, মনের কষ্ট মনেই থাক, নাই বা শুনলেন। সে তো ভারত চলে গেছে্ ওরা যে, আর ফিরবে না। ওই যে দেখুন ওর বাবার সমাধি সৌধ…. কথাগুলো শুনে একটু এগিয়ে দেখি খালে নৌকা। ‘এই মাঝি, কোথায় গেলে ভালো হয়?’ মাঝি বললো, বেড়াতে এসেছেন বুঝি, চলুন সিংহখালীর কাছাকাছি। ওদিকে গেলে নৌকায় বসে গাঁও-গেরামের রূপ দেখতে পাবেন যে।

সিংহখালী যেতেই পড়ে কানুয়া, রাজপাশা, বানাই বাজার। রাজপাশাকে কাছ থেকে দেখে না হয় ফিরবেন। নৌকায় উঠে বসলাম। মাঝি আফজাল নৌকা বাইছে, বললাম, তোমাদের দেশে এ সময় কী কী মাছ পাওয়া যায়। আফজাল বললো, মাছের দিন তো শেষ। নদীতে না আছে ইলিশ, না আছে বড় বড় পাঙ্গাশ, আইড়, গজার মাছ— সবই তো বিলুপ্তির পথে।

ছোট খালের যেদিকে তাকাই দেখি নারকেল গাছের ছড়াছড়ি। কচুগাছও বেশ চোখে পড়লো। হোগলা বনও চোখে পড়লো। আফজাল বললো, ওই যে হোগলা দেখছেন— এ দিয়ে পাটি তৈরি হয়। প্রায় দু’ঘণ্টা নৌকায় বেড়ালাম। এবার এক বটগাছের কাছে নৌকা ভিড়াল আফজাল মাঝি। বললো, এখান থেকে একটু দূরেই ভাণ্ডারিয়া বাজার। সূত্র : ইত্তেফাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *