Skip to content

নভেরার বিরল রত্নভাণ্ডার

নওশাদ জামিল
মায়ের কোলই সন্তানের নির্ভরতা আর স্বর্গীয় শান্তির আশ্রয়। জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে ঢুকেই দেখা গেল দুই শিশুসন্তানকে সেই পরম আশ্রয়ে রাখা এক ভাস্কর্য। সিমেন্টে তৈরি ভাস্কর্যটি। তাতে খসখসে মাতৃদেহেও যেন প্রকাশিত হচ্ছে পরম কোমলতা। অযত্ন আর অবহেলায় এ ভাস্কর্য কোমলতা হারিয়েছে অনেকখানি, খসে গেছে সন্তানের হাত; তবু তা দেখে হৃদয়ে খেলে যায় প্রশান্তি। পাশেই উপবিষ্ট এক নারীর ভাস্কর্য। এর পরই দণ্ডায়মান আরেক নারী। সিমেন্টে তৈরি এ নারীদেহে রয়েছে রঙের পেলব। লাল শাড়ি, কালো চুল আর গলায় হলুদের আভা। সেই আভার দীপ্তিও হারিয়েছে অনেকখানি। তবু এ অন্য রকম এক আবিষ্কারের অভিজ্ঞতা। দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে পড়ে ছিল এসব বিরল রত্নভাণ্ডার। অবশেষে তা উন্মোচিত হলো দর্শনার্থীদের সামনে। আর এ রত্নভাণ্ডারের স্রষ্টা বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসে আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃৎ নভেরা আহমেদ। গতকাল বুধবার জাতীয় জাদুঘরে শুরু হলো এই কিংবদন্তি শিল্পীর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী।

জাতীয় জাদুঘরে নভেরা আহমেদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া একটি ভাস্কর্য।

জাতীয় জাদুঘরে নভেরা আহমেদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া একটি ভাস্কর্য।

দেশে আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের যাত্রা নভেরা আহমেদের হাত ধরেই। ভারতীয় উপমহাদেশের ভাস্কর্যশিল্পে আধুনিকতম নারীও তিনি। আমাদের জাতীয় শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়নে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কী এক অভিমান নিয়ে দীর্ঘদিন ছিলেন পরবাসে। প্রায় ৪৫ বছর তিনি প্যারিসে কাটান। এ সময়ের মধ্যে একবারও দেশে আসেননি, চাননি শিল্পকর্মের স্বীকৃতিও। ১৯৯৭ সালে সরকার তাঁকে একুশে পদক দিলেও তিনি তা নিতে আসেননি। বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিয়েও দেশে আনা যায়নি তাঁকে। লোকচক্ষুর অন্তরালেই কাটিয়েছেন জীবন। তাঁকে নিয়ে কত গল্প, কত কাহিনী! তাঁর শিল্পকর্ম সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ যেমন, তেমনি তাঁর জীবন নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তি। খ্যাতি, সম্মান, অর্থ-বিত্ত সব ছেড়ে এক আশ্চর্য আড়াল তৈরি করেছিলেন নিজের চারপাশে। দেশের শিল্পীদের সঙ্গেও যোগাযোগ

ছিল না তাঁর। অবশেষে সেই আড়াল থেকে চির আড়ালে চলে যান এ বছরেরই ৬ মে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই আয়োজন করা হয়েছে এ প্রদর্শনীর।

গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় নভেরার ৩৪টি শিল্পকর্ম দিয়ে সাজানো এ প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বিশেষ অতিথি ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবি কামাল চৌধুরী। জাতীয় জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি এম আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে এতে আরো উপস্থিত ছিলেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক লালা রুখ সেলিম প্রমুখ। এর আগে বিকেল ৪টায় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে হয় এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এতে নভেরা আহমেদের শিল্পকর্ম ও জীবন নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন অধ্যাপক লালা রুখ সেলিম।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘নভেরা আহমেদের কাজ দেখেছি, কিন্তু তাঁকে দেখার সুযোগ হয়নি। শহীদ মিনারের ইতিহাস পড়তে গিয়ে তাঁকে জেনেছি। অনেকের কাছে তাঁর কথা শুনেছি। তাঁর সব কিছুতেই প্রথাবিরোধী একটা ব্যাপার ছিল। তাঁর চুল বাঁধার ধরন, পোশাকের মধ্যেও ভিন্নতা ছিল। অর্থাৎ তিনি অনেক কিছু ভাঙতে চেয়েছেন। একজন অসাধারণ সৃজনশীল মানুষ হিসেবে আমরা তাঁকে নিয়ে গর্ব করি। তিনি শুধু বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের নন সারা বিশ্বের অন্যতম ভাস্কর্যশিল্পী।’

মন্ত্রী আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে একবার তাঁর দেখা হয়েছিল বলে আমি জানি। সরকার তাঁকে একুশে পদকের সম্মাননা দিয়েছে। আমরা নভেরা আহমেদকে দেশে আনার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছিলাম। এমনকি ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি শহীদ মিনারে থাকবেন সে কথাও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সে সময়ই তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নভেরা আহমেদ নির্বাসনে থেকেও বাংলাদেশের কথা ভোলেননি। সারা জীবন বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়েই সারা বিশ্বে ঘুরেছেন। তবে নভেরা আহমেদের অনেক কথাই এখনো আমাদের অজানা। তাঁকে নিয়ে, তাঁর কাজ নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। ফ্রান্স ও পাকিস্তানে তাঁর যে শিল্পকর্মগুলো রয়েছে, আমরা সেগুলো সংগ্রহের চেষ্টা করছি।’

কবি কামাল চৌধুরী বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মানুষের স্বপ্ন, তার অবদান কোনো কিছুই হারায় না। তেমনি স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হয়েও নভেরা আহমেদ আমাদের জন্য অনেক কিছু রেখে গেছেন। তিনি আমাদের কাছে ক্রমাগত উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন। এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম এবং আগের প্রজন্মর মধ্যে নভেরাকে জানা নিয়ে এক সেতুবন্ধ তৈরি হলো।’

প্রদর্শনী ঘুরে দেখা গেল ‘পরিবার’ নামে আরেকটি অনবদ্য কাজ। এটা সিমেন্টের তৈরি, সাদা রং। এক নারীশরীরের আদল, কিছুটা নৌকার ভঙ্গিতে বাঁকানো, মাঝখানে স্পেস, সেখানে তিনটি মানবশরীর। শিল্পকর্মে মা ও সন্তানের আদিরূপ ফুটে উঠলেও উপস্থাপনায় তা আধুনিক ও স্বতন্ত্র। নারীশরীরের মাঝখানে একটু স্পেস, হাত যদিও অস্পষ্ট, তবু স্পষ্ট বোঝা যায়, মা যেন তাঁর সন্তানদের নিজের শরীরে, পৃথিবীতে বাড়তে দিয়েছেন, উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তাদের। স্মৃতিস্তম্ভের আদলে তৈরি ‘শান্তি’ নামের কাজটি সিমেন্টে তৈরি। এটি কালো রঙের। আসনের ভঙ্গি উপমহাদেশের পরিচিত স্টাইল এবং আসনটি ক্রমশ সরু হয়ে উঠে গেছে। এ ধরনের ভঙ্গি কোনো প্রার্থনা বা একান্ত ধ্যানের কথা মনে করিয়ে দেয়।

শিল্পকর্মের অধিকাংশই নারী। আর প্রত্যেক নারীই এখানে স্বতন্ত্র অথচ ভারতীয় নারীর সামগ্রিক রূপ তুলে ধরে। রয়েছে হেলান দেওয়া অবস্থায় নারী, তার মাথা। মা ও শিশুর পরম মমতার চিত্র ফুটে উঠেছে সেসব ভাস্কর্যে। এ ছাড়া রয়েছে গরুর পেটে দুজন মানুষের হেলান দেওয়ার আঙ্গিক, উপবিষ্ট বুদ্ধ, প্লাস্টার অব প্যারিস মাধ্যমে গড়া বুদ্ধের মস্তক। রয়েছে শুধুই মানুষের ফিগার-সংবলিত শিল্পকর্ম। শুধু ভাস্কর্যই নয়, প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে শিল্পীর আঁকা বেশ কয়েকটি চিত্রের অনুকৃতি। এর মধ্যে মুনলাইট-১৯৭৮, দ্য বার্ডস সারপেন্ট-১৯৮৪, সোল অব দ্য ফ্যান্টম-১৯৭৩, স্পিরিট রিভার-১৯৭৩, স্পেস-১৯৭০ উল্লেখযোগ্য। প্রদর্শনীতে এই কিংবদন্তি শিল্পীর ব্যক্তিগত ছবিও রয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে শিল্পী গভীর মনোযোগে শিল্পকর্ম সৃষ্টি করে চলেছেন।

নভেরা আহমেদের চিন্তা, কাজের ফর্ম, উপস্থাপনা সব কিছুতেই স্বাতন্ত্র্যের ছাপ লক্ষণীয়। দেশীয় উপকরণ, বিষয়বস্তু আধার করে পশ্চিমা আধুনিকতার কিছুটা প্রয়োগ ঘটিয়ে তিনি প্রতিটি কাজ করে তুলেছিলেন অনন্য। প্রদর্শনীর সমাপনী দিন ১৯ অক্টোবর। প্রদর্শনী সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *