জয়া ফারহানা
নভেরা আহমেদ বলেছিলেন, মানুষ যে পর্যন্ত কাজ করতে পারে সে পর্যন্তই তার বেঁচে থাকা উচিত। সর্ষে দানার ওপর দিয়ে হেঁটেছেন তিনি। দেশে দেশে স্কাল্পচারের ফর্ম, কালার, টেক্সার, স্পেস দেখার জন্য। তিনিই কিনা পা হারিয়ে হুইল চেয়ারে জীবন কাটাতে বাধ্য হলেন। বায়োলজিক্যাল মা হননি কিন্তু ভাস্কর্যের মধ্যে জীবন্ত রূপ দিয়েছিলেন মাতৃত্বের। নভেরার যে সামান্য কটি ভাস্কর্য দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে তাকে যদি একটি একক বৈশিষ্ট্য বা উপমার মধ্যে ফেলতে হয় তো নিঃসন্দেহে তার নাম দেয়া যায়—মাতৃত্ব। শহীদ মিনারের উঁচু বেদীর উপর চারটি স্তম্ভ—যার প্রধান স্তম্ভটি একজন মা—ধারণা করা যায় শহীদ মিনারের এই রূপকল্পনা নভেরারই। কারণ তার অন্যান্য ভাস্কর্যেও মাতৃত্বের এই রূপকল্পটি আছে। দুর্ভাগ্য এখানেও যে শহীদ মিনারের নকশাকার হিসাবে এমনকি সহযোগী নকশাকার হিসেবেও দীর্ঘ, দীর্ঘদিন কেউ তার নাম এবং কাজের স্বীকৃতি দেয়নি।
১৯৬০ সালে ঢাকায় যখন চারুকলা ইন্সটিটিউট তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেনি তখন ঢাকায় প্রথম তার ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়েছে। ঢাকা শহরের প্রাঙ্গণ ভাস্কর্যের প্রথম ভাস্করও তিনি। ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরির দেয়ালে প্রিয় বাঁশখালির গ্রাম জীবনকে অমর করেছেন। অথচ শেকড়ের প্রতি তাঁর এই মমত্ববোধ নিয়ে কোন সাংস্কৃতিক পুরোধাকে কখনও প্রশংসা করতে শুনিনি। শিল্পপতি এম আর খানের বাড়ির লনের গ্রামীণ পরিবেশকে মাথায় রেখে নির্মাণ করেছিলেন কৃষক আর গরুর ভাস্কর্য। চারদিকের জলাভূমি গাছপালা ধানক্ষেতের সঙ্গে মিলিয়ে নির্মাণ করেছিলেন গরু আর দুই মানুষ। সেমি এ্যাবস্ট্রাক্ট ফর্ম। চারটি স্তম্ভ নেমে এসেছে পায়ের প্রতীক হিসেবে। গরুর সামনে পেছনে আর মাঝখানে গোলাকার ছিদ্র। গরু আর মানুষের চোখও ছিদ্র দিয়ে দিয়ে তৈরি। অমসৃণ কৌণিক ভাস্কর্য। দেশজ মোটিফে ভাস্কর্য নির্মাণে তাঁর যে পক্ষপাত তার জন্য কখনও তাঁর প্রশংসা শুনি না বরং বেশি শোনা যায় ফ্রান্সে বসবাসের ব্যাপারে তাঁর পক্ষপাত, দেশের প্রতি বিরূপতার কথা। শহীদ মিনারের রূপকার হিসাবে যতোটা না আলোচিত হন তারচেয়ে অনেক বেশি বলা হয় শহীদ মিনারের পাশে তরজার বেড়ার ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে তিনি যে বসবাস শুরু করেছিলেন সেই কাহিনী।
ভাস্কর শিল্পী হবেন বলে ক্যাম্বারওয়েল আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, দীর্ঘ দীর্ঘ অনুশীলন করেছিলেন, ভাস্কর্যের ফর্ম আর কম্পোজিশন নিয়ে ভেনটুরির মত শিল্পীর কাছ থেকে নোট নিয়েছেন, তৈরি করেছেন বাস্ট, দেশে দেশে গুরুত্বপূর্ণ সব ভাস্কর্য বিপুল মনোযোগ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। নভেরা অধিকাংশ সময় শাড়ি পরতেন-দেশজ সুতোর শাড়ি, তা নিয়েও তাঁকে কম গঞ্জনা শুনতে হয়নি, বলা হতো আয়াদের মতো তিনি নাকি কম দামি শাড়ি পরে থাকেন। যেন শিল্পী নভেরা নয়, ব্যক্তি নভেরাকে মানুষের আগ্রহের বিষয় করে তোলার অশিষ্ট অশিক্ষিত চেষ্টা। অযথা রহস্যের চাদরে মুড়িয়ে সেই আগ্রহের আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে। কী কারণ ? নভেরা আহমেদ বাংলাদেশের প্রথম নারী ভাস্কর, হতে পারে এই তার অপরাধ ! একজন পুরুষ ভাস্কর তা তিনি প্রথম দ্বিতীয় বা পঞ্চবিংশতি যাই হোন না কেন তাকে নিয়ে কিন্তু এতো মিথ তৈরি হয় না, কখনও হবেও না। নভেরা-কেন্দ্রিক প্রতিক্রিয়ায় সংস্কৃতির অগ্রসরমান মানুষেরাই যেখানে দ্বিধাবিভক্ত, নভেরার কাজের ক্ষেত্রটি তাদের মধ্যেই যেখানে অনালোচিত, সেই দ্বিধাবিভক্ত অনগ্রসরমান সমাজে নভেরাকে তৃণমূলের দুয়ারে পৌঁছে দেয়া যাবে সে আশা করি না। ঘরে ঘরে নভেরা পৌঁছে যাবেন সেই দরবার বা ফরিয়াদ নিয়েও এই লেখা লিখতে বসিনি। অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে যে ক’জন নারী এই অপ্রতিভাবানদের মাটিতে জন্মেছেন তাদের প্রত্যেকের জীবনই যে আমরা লাঞ্ছনা অপমান অবমাননা আর অপবাদে ছিন্নভিন্ন করে দেবো এ আর আশ্চর্য কী ! মোল্লাদের ভয়ে বেগম রোকেয়াকে তো পর্দার ব্যাপারে রীতিমতো আপোষ করতে হয়েছিলো। তাহলে আর কোন নারীই বা তাদের হাত থেকে মুক্ত থাকবেন! ব্যক্তি নভেরার বেডরুম বিষয়ে যতো অপ্রয়োজনীয় কৌতূহল লক্ষ্য করা যায় সেই কৌতূহলের ছিটেফোঁটাও যদি তাঁকে ভালোবেসে লক্ষ্য করা যেতো তাহলে একটি অনুকূল শিল্প আবহ বা পরিবেশ তিনি পেতেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মানসিকভাবে আহত নভেরা যুদ্ধবিরোধী স্কাল্পচার করতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধ কীভাবে মানুষের জীবন বদলে দেয়, ফেলে অশনি ছায়া তা লক্ষ্য করার জন্য তিনি ভিয়েতনাম ছুটে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ফিরে ব্যাংককে এন্টি ওয়্যার স্কাল্পচার প্রদর্শনীও করেছিলেন। মোদ্দাকথা একজন মানবিক ভাস্কর শিল্পী হিসেবে বিশ্বের যেকোন দেশে যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আর দশজন শিল্পীর মতোই তিনি প্রতিবাদী ছিলেন। কিন্তু মুশকিল এই যে নভেরার চরিত্রের ওপর কিছু বাহুল্য রহস্য আরোপ করে এই একবিংশ শতাব্দীতেও তাঁকে জোয়ান অব আর্কের মতো তাঁকে ডাকিনী-যোগিনী-মায়াবিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পুরুষতান্ত্রিক সংকীর্ণ প্রচেষ্টা আছে। যে কারণে একজন প্রতিভাবান ভাস্করের কাছ থেকে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো বের করে আনা যায়নি। তাঁকে একটা সুস্থ পরিবেশ দেয়া যায়নি। তাঁর প্রতিভার সম্পূর্ণ ব্যবহার করা যায়নি। সেটা করা গেলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ভাস্কর্য আরো খানিকটা উঁচু হতো। তারপরও নভেরা আমাদের ঐশ্বর্য। যতোদূর নভেরা ততোদূর আমাদের দেশ। তাঁকে বিনত শ্রদ্ধা। লেখক : কথাসাহিত্যিক। সূত্র : ইত্তেফাক