খন্দকার মর্জিনা সাঈদ
তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। জাহাজ ঘাটে থামামাত্রই নারিকেল জিঞ্জিরায় পা রাখলাম। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখে কিছু সময়ের জন্য নিজের অবস্থান ভুলে গেলাম। প্রকৃতির সাথে একাত্মতা প্রকাশে কখনো সমুদ্রের কোলঘেঁষে দাঁড়াই, কখনো বা চূর্ণ-বিচূর্ণ প্রবালের ওপর বসে পড়ি। এসবের মধ্যে খেয়াল হয়, ওদের ক’জন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। কারো হাতে শামুক-ঝিনুকের মালা, কারো হাতে ছোট-বড় প্রবাল, কেউ বা পানির জগ-গ্লাস, বিভিন্ন ধরনের আচারের প্যাকেট সঙ্গী করে পিছু পিছু ছুটছে। তবে অবাক করেছে ১২-১৩ বছরের এক কিশোরী; সে কয়েকটি ভিন্নধরনের শামুক-ঝিনুক হাতে দিয়ে বলল, আপনারা এখানে বেড়াতে এসেছেন, তাই এগুলো আপনাদের গিফট করলাম।
যে স্থানের বেশির ভাগ মানুষ শুদ্ধ বাংলা বলতে পারে না, সেই স্থানের এক কিশোরীর মুখে ইংরেজি শুনে না দাঁড়িয়ে উপায় ছিল না।
জিজ্ঞেস করি, কী নাম? উত্তর দেয় শাবনূর। নায়িকার নামে নাম! সে বলল, হ্যাঁ। আমার মা শাবনূরের ভক্ত ছিলেন। এজন্যই নাম রেখেছিলেন শাবনূর। তোমাদের এলাকায় তো বিদ্যুৎ নেই। কী করে নায়িকাদের চেনো। শাবনূর উত্তর দেয়- কেন, জেনারেটর চালিয়ে কম্পিউটারে সিডিতে দেখি। সে আরো বলে, চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। শুদ্ধ বাংলার সাথে সাথে কিছু ইংরেজিও বলতে পারি। অনেক সময় দেশী, এমনকি বিদেশী পর্যটকদের সঙ্গী হই।
শাবনূর আরো বলে, এই অঞ্চলের অনেক মেয়েরই ১৩-১৪ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়। সে অনুযায়ী তারও বিয়ে হয়েছে। স্বামী স্পিডবোটের চালক। বেশ ভালো আয়রোজগার। সে তার স্বামীর তৃতীয় স্ত্রী। এখানে বহুবিবাহ একটি সাধারণ ব্যাপার। যে পুরুষের আয়রোজগার বেশি, সে ইচ্ছে হলেই বহুবিবাহ করতে পারেন।
এখানেও থানা পুলিশ আছে। আছেন আইনের লোক। এখানকার অসহায় দরিদ্র অশিক্ষিত নারীরা অনেক কষ্টসহিষ্ণু। পারতপক্ষে তারা আইনের আশ্রয় নেন না। স্বামীর বহুবিবাহকে জীবনের একটি স্বাভাবিক অধ্যায় হিসেবেই মেনে নেন এবং সে অনুযায়ী জীবন চালনা করে থাকেন।
শাবনূর বলে, সে কারণেই সময় সুযোগ পেলেই সমুদ্রের কাছে চলে আসি। বিনোদনের পাশাপাশি দেই নতুন নতুন পর্যটকদের সঙ্গ। কেউ ইচ্ছে হলে টাকা-পয়সা দেয়, কেউ দেয় না। কিন্তু এদের সঙ্গ ব্যবহার দুই-ই উপভোগ করি, যা আমাদের জীবনের একধরনের সুখ।
শিল্পী। বয়স ২৫-২৬। শামুক-ঝিনুক নিজ হাতে কুড়ান, মালা নিজ হাতে গড়েন ও বিক্রি করেন। শিল্পী শুদ্ধ বাংলা না বলতে পারলেও বোঝেন। তিনি নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, তার স্বামী জেলে ছিলেন। বহু দিন হলো তিনি স্বামীর কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। কেউ বলে, তার স্বামী মিয়ানমার জেলে বন্দী, কেউ বলে নৌকাসহ সাগরে তলিয়ে গেছে। আবার অন্য কথাও কেউ কেউ বলে। বলে মিয়ানমারে বিয়ে করে ওখানেই বসবাস করছে।
শিল্পী স্বামী সম্পর্কে কী বিশ্বাস করেন- জানতে চাইলে তিনি জানান, সব কিছুই বিশ্বাস হয়। আবার কোনোটাই বিশ্বাস হয় না। তিন সন্তানের মা শিল্পী বলেন, তার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমার যে কিছুই করার নেই। প্রয়োজনে জীবনভর অপেক্ষা করব। তিন সন্তানের ভরণপোষণের জন্যই তো এই পথে নেমেছি। এখন মওসুম ভালো। বেচাবিক্রি ভালোই হয়। কিন্তু ঝড়ের মওসুমে সমস্যা হয়। তেমন কোনো কাজ থাকে না। তখন খেয়ে না খেয়ে জেলেপল্লীতে জাল বোনা, নুন দিয়ে কাঁচা মাছ সংগ্রহসহ টুকটাক কাজ করে চারজনের সংসার চালাতে হয় বলেও জানান ঝিনুক বিক্রেতা শিল্পী।
১০ বছরের রুকাইয়া। পানির কলস আর গ্লাস নিয়ে ঘুরছিল। জানতে চেয়েছিলাম সে পড়ালেখা না করে পানি ফেরি করছে কেন? রুকাইয়া জানায়, সে এখানের স্কুলে পড়ে। স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি পানিও বিক্রি করে। আর এই টাকা মায়ের হাতে তুলে দিতে হয়।
রুকাইয়া জানায়, তার মাও শুঁটকির ঘেরে কাজ করেন। বড় ভাই দুটো জেলেদের সাথে সাগরে যান। বাবার কথা জানতে চাইলে রুকাইয়ার মুখের হাসি মলিন হয়ে যায়। সে মলিন মুখে জানায়, বাবা জাহাজে কাজ করেন। টেকনাফে তার নতুন বউকে নিয়ে থাকেন। কখনো পথ ভুল করেও সে তাদের কাছে আসেন না। সেই ছোটবেলায় সে তার বাবাকে দেখেছিল। বাবার মুখের আদল সে নাকি এত দিনের ব্যবধানে ভুলে গেছে বলেও অকপটে স্বীকার করে রুকাইয়া।
কথা হয়েছিল মালা, ঝিনুক, ঝরনাসহ নারিকেল জিঞ্জিরার অনেক কন্যার সাথে। যাদের আপাদমস্তক সবটা জুড়েছিল দারিদ্র্যের ছায়া। প্রায় প্রত্যেকেরই ছোট জীবনে ছিল একটা গল্প। যে গল্পগুলো বাস্তব ও মর্মান্তিক। কিন্তু কারটা বেশি, কারটা কম মর্মান্তিক; অনুভব করাই কঠিন। তাই তো বিদায়বেলা এদের সবাইকে একবার করে জড়িয়ে ধরেছিলাম, যদি আমি একটু ছোঁয়ার আদলে ওদের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। পারি এদের লালিত কষ্টের শ্রোতা হয়ে কিছুটা সান্ত্বনা দিতে। সৌজন্যে : নয়া দিগন্ত