Skip to content

নিঃশব্দ গানের চর কুকরী-মুকরী

সুন্দর শুধু চেয়ে দেখার_ কোনো কথা হবে না! ঠিক ২০ মিনিট পর আমরা পা রাখলাম চর কুকরিমুকরিতে… ঘুরে এসে লিখেছেন ফারুখ আহমেদ

যখন কুকরীর খালপাড়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখনই এগিয়ে এলো পাতলা লিকলিকে ছেলেটি। নাম জানতে চাইলে বলল আলামিন। আলামিনের সঙ্গে কথার শুরুতেই বুঝতে পারলাম কুকরী-মুকরীতে আমার সঙ্গী ফারাবী হাফিজের জনপ্রিয়তা। আলামিন চ্যানেল টোয়েন্টিফোর টেলিভিশন দেখে দেখে ফারাবীকে ভালো করেই চেনে। আমরা আলামিনের সঙ্গী হলাম। তার পরিকল্পনাতেই অনেকটা পথ হেঁটে এক সময় ওয়াচ টাওয়ারের দেখা পেলাম। তার পর ১১০টা সিঁড়ি ভেঙে তার মাথায়। বিষয়টা আমার দুই সঙ্গী ফারাবী হাফিজ ও নূরে আলম দুর্জয়ের কাছে এভারেস্ট বিজয়ের মতো। জরাজীর্ণ ওয়াচ টাওয়ারটির চারপাশের পুরোটাই খোলা।

Kukri-Mukri

খুব ভয়ে ভয়ে আর সাবধানে পা ফেলে ফেলে ওয়াচ টাওয়ারের ওপর উঠলেও শেষ ধাপে পা রেখে মনটা ভালো হয়ে গেল। আহা, কী সুন্দর চারপাশ! তিন দিকে সবুজ বন, সামনে দিগন্তবিস্তৃত খোলা মাঠ সত্যিই অপরূপ। ওপর থেকে নিচে দেখতে পেলাম কয়েকটি ঘর। একদল মহিষ ছোট্ট একটা পুকুরে গা ভেজাতে ব্যস্ত। বহুদূর ইতস্তত ছড়ানো আরও একটা দুটো চর চোখে পড়তে থাকল। এসব দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু সেই আদি কথা, অন্ত আছে। কী আর করা! নেমে আসতে হয়। এবার দ্রুত পা চলে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দিকে। হঠাৎ মন পরিবর্তন, বাকিরা হেঁটে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের দিকে গেলেও আমরা তিনজন কিছুটা হেঁটে আলামিনের ট্রলারের যাত্রী হই। এবার বনের উত্তর পাশটায় সামাজিক বনায়ন দেখে তবেই ইউনিয়ন পরিষদ অফিস যাব মনস্থির করি।

এ বছরের ২ জুন সকাল ৯টার কথা। চর কচ্ছপিয়া খালের ভেতর দিয়ে স্পিডবোট ছুটে চলেছে চর কুকরী-মুকরীর দিকে। চারপাশে সবুজ আর সবুজ। এমন সবুজ দেখে দেখে মনে হচ্ছিল আমরা সবুজ স্বপ্নের ভেতর প্রবাহিত হচ্ছি। এভাবেই এক সময় মেঘনার শাখা নদী বুড়ি গৌরাঙ্গতে এসে পড়ি। দৃষ্টিকে সম্মোহন করে এবার দূর থেকে দেখতে পাই কাঙ্ক্ষিত দ্বীপচর কুকরী-মুকরী। স্পিডবোট ছুটে চলেছে আর আমরা চারজন দু’চোখ মেলে তাকিয়ে আছি। এক সময় স্পিডবোট বনের ভেতর প্রবেশ করে এবং গিলে ফেলে আমাদের। ঠিক যেন কুমির গিলে নিল। দু’পাশে সবুজ বন, মধ্যখানে কুকরীর খাল। অনেকে তাকে বলে ভারানির খাল।

আগের দিন আমরা চরফ্যাশন এসেছি। আর আজ সকাল ৭টায় বৃক্ষতলা থেকে রওনা হয়ে এখন আমরা কুকরীর খালের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছি চর কুকরী-মুকরী। বহুদূর বিস্তৃত এই কুকরীর বন। ১৯৭২ সালে বন বিভাগ এখানে ম্যানগ্রোভ বন তৈরির কাজ শুরু করে। পাশেই আছে ঢাল চর। প্রক্রিয়া চলছে বনটিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সুন্দরবনের স্বীকৃতি দেওয়ার, যার সৌন্দর্য শেষ হওয়ার নয়। ফারাবীর মতে, এমন সুন্দর শুধু চেয়ে দেখার- কোনো কথা হবে না! ঠিক ২০ মিনিট পর আমরা পা রাখলাম চর কুকরী-মুকরীতে।

আমাদের দেখে দৌড়ে ছুটে এলো একদল শিশু, যেন আমাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ওরা। আমরা শিশুদের সঙ্গে নিয়ে সামনে চললাম। একটি গুচ্ছগ্রাম, ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত। খুব শান্ত পরিবেশ। গ্রামের বউ-ঝিদের কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখলাম। পুরুষদের অনেককেই দেখলাম মাছ ধরার জাল মেরামতে ব্যস্ত। একদল হাঁস দেখলাম তাদের ছানাদের নিয়ে প্যাঁকপ্যাঁক করে এদিক-ওদিক ছুটছে আর খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছে। কয়েকজন তরুণীকে দেখা গেল বই বুকে চেপে সম্ভবত প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছে। পাশ দিয়ে যেতে যেতে হাসিটা উপহার দিয়ে যেতে ভুলল না। আমরাও ঘাড় ঘুরিয়ে সে হাসির প্রত্যুত্তর হাসি দিয়েই দিই। এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার নাম বাবুগঞ্জ গ্রাম। এখান থেকে দূরের বন অসাধারণ।

পাশেই গ্রামের একমাত্র মনিহারি দোকান। আমরা বেতের তৈরি সেই দোকানঘরটির ভেতর বসি। ইতিমধ্যে লক্ষ্য করলাম আমাদের সঙ্গী চেয়ারম্যান হাশেম মহাজন একজনকে নির্দেশ দিলেন আমাদের জন্য ডাবের ব্যবস্থা করতে। ডাব আর টিউবওয়েলের পানি খেয়ে হাশেম ভাই আর জেসমিন হোসেনকে রেখে গ্রামের মেঠোপথ ধরে চলে এলাম আবার কুকরীর খালের পাড়। এখানেই পরিচয় স্থানীয় আলামিনের সঙ্গে, যে কথা আগে বলেছি। আলামিনকে পেয়ে কুকরী-মুকরী আমাদের জন্য অনেকটা সহজ হয়ে যায়। জোরকদমে তার সঙ্গে চলি।

এতক্ষণ আমরা বনের পাশ দিয়ে চলছিলাম, এবার বনের ভেতর প্রবেশ করি। এখানে অসম্ভব ভালো লাগার মাদকতায় ভরা একটি ঘ্রাণ আমাদের মন ছুঁয়ে যায়। কিসের ঘ্রাণ খুঁজতে খুঁজতে বুঝতে পারি এ হলো বনের পরিচিত ঘ্রাণ। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বনের ভেতর আসার কষ্ট এক লহমায় ভুলে যাই। এখানে প্রায় সব গাছই কেওড়া। আমরা সে কেওড়া বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকি। এভাবেই একসময় পেয়ে যাই ওয়াচ টাওয়ার। এবার আমাদের ওয়াচ টাওয়ারে ওপর ওঠার পালা। এক পা-দু’পা করে একসময় আমরা ওয়াচ টাওয়ারের ১১০ সিঁড়ি উচ্চতায় পা রাখি। ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে অসাধারণ চর কুকরী-মুকরীকে আরও অসাধারণ চোখে দেখার গল্প বলেছি।

এবার ওয়াচ টাওয়ার থেকে নামার পালা। খুব দ্রুতই আমরা ওয়াচ টাওয়ার থেকে নিচে নেমে আধা ঘণ্টা হেঁটে এবং আরও আধা ঘণ্টা নৌকায় চেপে চলে আসি এখানকার সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে। আমরা বনের ভেতর প্রায় এক ঘণ্টার ওপর হেঁটেও বানর ও নানা রকম পাখি ছাড়া হরিণের দেখা পাইনি। হরিণের ডাক শুনে ভেবেছি, এই বুঝি হরিণ দৌড়ে এলো। কিন্তু হরিণ আসেনি। তবে এখানে প্রচুর জানা-অজানা পাখি দেখেছি। সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের এক খোলা প্রান্তে দেখতে পাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেক পাখি মাটিতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি ক্যামেরা তাক করার আগেই উড়াল। এ এক অপরূপ বাংলাদেশের অনন্য দৃশ্য।

আলামিনের মতে, হরিণ দেখতে হলে প্রচুর ধৈর্যের প্রয়োজন এবং যেতে হবে বনের আরও গভীরে। তবে শীতকালে হরিণ ও পাখি দেখা সাধারণ ঘটনা। সে সময় তারা গ্রামের মাঠে গিয়ে শুয়ে বসে রোদ পোহায়। আর বর্ষায় মাছ ধরার দৃশ্য এবং ঘাটে নৌকা দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য অসাধারণ। আলামিন বলে, ‘ভাইজান জীবনে অনেক সুন্দর দৃশ্য দেখছেন। আপনেগো দেখা অন্য অনেক সৌন্দর্য থেকে এই সৌন্দর্যের তুলনা হয় না, এক কথায় অতুলনীয়।’

এবার আলামিনকে প্রশ্ন করি, সমুদ্র কত দূর। আলামিন আমাদের এ বিষয়ে যা বলে তাহলো, দক্ষিণে চর কুকরীমুকরীর শেষ সীমায় ২০ কিলোমিটার হেঁটে গেলে সমুদ্রসৈকত পাওয়া গেলেও প্রকৃত বঙ্গোপসাগর দেখতে হলে এক ঘণ্টার নৌকা তথা ট্রলার ভ্রমণ শেষে যেতে হবে একেবারে মোহনায়। দুর্জয়কে কিছুটা হতাশ মনে হলো। সমুদ্র না দেখার হতাশা নিয়ে সে যে গাছের ছায়ায় বসে পড়ে, সেটি একটি বাবলাগাছ।

বনের এই জায়গাটায় প্রচুর বাবলা। একটা নয়, পাশাপাশি অনেক বাবলা বীথি। হলুদ বাবলার ফুল বাতাসে দুলছে। ঠিক তখনই আমরা হরিণের ডাকে চঞ্চল হয়ে সামনে এগোই।

কোথায় হরিণ! বুঝতে পারি এসব বনের মায়া। বনের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আলামিন শেয়ালের গল্প শোনায়, শেয়াল বসবাসের গর্ত দেখায়।

এর মধ্যে বুঝতে পারি প্রচণ্ড খিদে লেগেছে। সঙ্গে থাকা বিস্কুটে কামড় দিয়ে গরম এক কাপ লেবুর চায়ের প্রয়োজন অনুভব করি। চা হলে খুব ভালো হতো ভাবতে ভাবতে এক সময় দেখি আমরা ট্রলারের কাছে পৌঁছে গেছি।

এবার আমরা দুর্জয়ের ইচ্ছায় দক্ষিণে সমুদ্রসৈকত দেখার জন্য আবার ট্রলারে চেপে বসি। এর মধ্যে মোবাইল ফোনে হাশেম মহাজনের ডাক। আমাদের চরফ্যাশন আজই ফিরতে হবে। কী আর করা! মন না চাইলেও আমাদের ফিরে আসতে হলো।

আমরা ট্রলারে চেপে দ্রুত ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে চলে আসি। দুপুরের খাবার বিকেল বেলা সেরে ফিরতি পথে স্পিডবোটে চেপে বসি। এর মধ্যে সূর্য পশ্চিম দিকে হেলেছে। ডুবন্ত সূর্যের লাল, হলুদ, কমলা আভা সবুজরঙা চর কুকরী-মুকরীর বনে ছড়িয়ে পড়ে বনটিকে আরও মায়াবী করে তুলেছে। আমরা তাকিয়ে আছি সামনের বন টপকে দূর আকাশপানে, যেখানে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সূর্যের সে কী রূপ, দেখছি আর ভাবছি দিন শেষের সূর্য কার ভালোবাসায় এমন মরমি হয়! সূত্র : দৈনিক সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *