Skip to content

নিঝুম অরণ্যে

ফারুখ আহমেদ
নিঝুম দ্বীপ প্রথম যাই ২০০২ সালে, এরপর ২০০৪ সালে আরেকবার। সেসব স্মৃতি আবছা। গত অক্টোবরের একদিন আবার নিঝুম দ্বীপ রওনা হলাম। সঙ্গী নাজমূল হক, রাজীব রাসেল, আবদুল বাতিন, নাজিম, মাসুম আর নীরব। ঢাকা থেকে ফারহান-৪ লঞ্চের যাত্রী হয়ে হাতিয়ার জাহাজঘাট তমরুদ্দি পর্যন্ত খুব আরামের ভ্রমণ। তারপর অটোরিকশায় ভাঙা রাস্তার ঝাঁকুনি খেতে খেতে দেড় ঘণ্টায় মোক্তার ঘাট পৌঁছাই। মোক্তার খাল পেরিয়ে এবার আমাদের ওপারের নিঝুম দ্বীপ যেতে হবে। যাত্রী না থাকায় ট্রলার ছাড়তে দেরি দেখে নীরবের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা মোরগের মাংস দিয়ে সেই বিকেলে দুপুরের খাবার খেলাম হোটেলের লাল চালের ভাত দিয়ে। এক অসাধারণ ভোজ হলো। আমরা ট্রলারে চেপে নিঝুম দ্বীপে যখন পা রাখি, তখন সূর্য অস্তাচলে।

Nijhum-Dwip4

মোক্তার ঘাট নিঝুম দ্বীপ পারাপারের মূল ঘাট। মোক্তার ঘাট থেকে ট্রলারে চেপে পাঁচ মিনিটে মোক্তার খাল পার হয়ে নিঝুম দ্বীপ। ট্রলার আমাদের যেখানে নামিয়ে দিল, সে জায়গার নাম বন্দরটিলা বাজার। সেখান থেকে নিঝুম দ্বীপের মূল লোকালয় নামা বাজার অল্প পথ। বাইকে চেপে ২০ মিনিটে চলে যাওয়া যায়। সেই গোধূলিবেলায় আমরা মোটরসাইকেলের যাত্রী হলাম। সেই পথ সাপের মতো এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। ঢালাই করা পাকা রাস্তা। দুপাশে চোখ জুড়ানো সবুজ আর সবুজ। দুই চোখ যত দূর যায় শুধু কেওড়াগাছ। স্থানীয়রা কেওড়াগাছকে কেরফা বলে ডাকে।

চলন্ত অবস্থাতেই দেখলাম গাছের নিচে পড়ে আছে অজস্র কেওড়া ফল। বাইকচালককে ফলের কথা বলতেই বাইক দাঁড় করিয়ে ভোঁ-দৌড়। ফিরে এলে দেখি হাতে তাঁর অনেক ফল। টক কাকে বলে কেওড়া ফলে কামড় না দিলে বোঝা কঠিন। সূর্য ডুবে যাওয়ায় আলো কমে অন্ধকার ঘনিয়েছিল। অন্ধকারে বাইকের হেডলাইটের আলো পেয়ে শতকোটি পোকা ও মশা আমাকে আক্রমণ করে বসল। সে আক্রমণের ঝাঁজ নিয়েই নামা বাজার জেলা পরিষদ ডাকবাংলো অবকাশে গিয়ে পৌঁছাই।

সে রাতে ভ্রমণে ক্লান্ত আমরা ঘুমিয়ে পড়ি একটু তাড়াতাড়ি। পরদিন সকালটা শুরু হলো দারুণভাবে। পরিকল্পনামতো সূর্যোদয় দেখার জন্য ঘুম থেকে উঠি ভোর পাঁচটায়, তারপর হাঁটা। পথশোভা আর ধানখেতে শিশিরবিন্দু দেখে দেখে চলে আসি সূর্যোদয় পাড়ায়। অবশ্য সূর্যোদয় পাড়া পৌঁছার আগেই সূর্যোদয় ঘটে। আমরা কুসুম কুসুম সূর্য দেখি মুক্তিযোদ্ধা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা বাজারে দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে সূর্যোদয় পাড়ায় বেশ ভালো কিছু সময় কাটে। গ্রামবাসীর জটলা আর তাঁদের প্রশ্ন করার ধরন দারুণভাবে উপভোগ করি। গ্রামবাসীর সব কৌতূহল মিটিয়ে যখন ডেরায় ফিরে চলি তখন সকাল আটটা বাজে প্রায়। দ্রুত পা চালিয়ে চলে আসি অবকাশে। কিছুক্ষণ পর আবার বের হই। এবার আমাদের গন্তব্য হরিণের খোঁজে চর ওসমান, চর কমলা ও চর কবিরা। নিঝুম দ্বীপের গ্রামগুলোর নাম খুব সুন্দর। মুক্তিযোদ্ধা, সূর্যোদয়, ছায়াবিথী, গুচ্ছগ্রাম, হাজিগ্রাম, মদিনা, বান্ধাখালী, ধানসিঁড়ি, আগমনী ইত্যাদি।

ঝকঝকে সকাল। অবকাশ থেকে বের হওয়ার সময় একঝাঁক হাঁস দেখে মনটা ভালো হয়ে যায়। নামা বাজারের পূর্বনির্ধারিত হোটেলে নাশতা খেয়ে যাত্রা শুরু করি। আজ সারা দিনের জন্য ট্রলার ভাড়া করা। ট্রলারে চড়ে বসতেই ট্রলার ছোট্ট খাল থেকে কয়েক মিনিটে আমাদের বিশাল মেঘনা নদীতে এনে ফেলল। নাজিমের চোখেমুখে বিস্ময়। সেই বিস্ময় নিয়ে সে বলল, এ যদি নদী হয় তবে সিলেটেরগুলো ড্রেন। সবাই নাজিমের কথায় হাসিতে ফেটে পড়লাম!

Nijhum-Dwip3

আমরা চলছি তো চলছি। আকাশে মেঘ নেই রোদেও তেজ নেই, আছে প্রবল বাতাস। সেই বাতাস গায়ে মেখে মেখে আর ইলিশ ধরা দেখে দেখে এক সময় চলে আসি চর কবিরাতে। কবিরার চরে ছোট ছোট কাঁকড়ার ছোটাছুটি। অবশ্য পাখি না দেখে নাজমূল স্যার হতাশ। আর আমি নিস্তব্ধ কবিরার তীরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবার পেছন ফিরে তাকালাম। এখানে গাছপালা কেমন মলিন। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কেওড়াসহ বিভিন্ন গাছগাছালির বেহাল অবস্থা দেখে বেশি দূর যেতে মন চাইল না। এখানে নদীতীরের গাছগুলো থেকে মাটি বা বালু সরে শিকড় বের হয়ে আছে। এরপর শুনলাম এখানে হরিণ নেই, তখন আর চর কবিরাতে সময় নষ্ট করার ইচ্ছে হলো না। আমরা আবার ট্রলারের যাত্রী হলাম। ছুটে চললাম কমলার চরে। এখানে রাখাল গরুর পাল নিয়ে বিরাট মাঠে বসে আছে। আর মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে এক একটি কেওড়াগাছ। আমরা কেওড়াগাছের ছায়ায় শেষ রসদ পিঠা ও কেওড়া ফল খেয়ে কেওড়ার বনে প্রবেশ করি।

শ্বাসমূল দেখেশুনে গভীর বনে হাঁটছি। সামনে কী বোঝা যাচ্ছে না, আবার লম্বা সব কেওড়াগাছের জন্য আকাশও দেখা যাচ্ছে না। এটা খুব ভালো হলো আমাদের জন্য, পানি ফুরিয়ে এসেছে। রোদ পড়লে গরম লাগত, তৃষ্ণার্ত হতাম। সে যাই হোক, হাঁটছি আর খুঁজছি হরিণ। পাশ থেকে নাজিম বলে যাচ্ছে, ‘বড় আশা নিয়ে এসেছি জঙ্গলে হরিণ দেখব বলে।’ কেওড়া ফল খেতে খেতে পাশ থেকে রাজীব রাসেলের প্রশ্ন ‘আমরা কি নিরাশ হব,’ বাতিন নির্লিপ্ত! আমরা নিরাশ হয়েছিলাম সত্যি সত্যি। নিঝুম দ্বীপের কমলার চর বা বন অংশে কেওড়াগাছ, হরিণের পায়ের ছাপ ছাড়া হরিণ আমাদের চোখে পড়েনি। আমরা প্রায় ১২ কিলোমিটারের মতো জংলা পথে চলে হরিণ না পেয়ে যখন ফিরে আসি তখন সূর্য মাথার ওপর থেকে অনেক পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আবার কমলার খালে ট্রলারের যাত্রী হলাম। হরিণ দেখিনি কিন্তু বনের ভেতর একঝাঁক বুনো কুকুরের দেখা পেয়েছি, দেখা হয়েছে শিয়ালের সঙ্গে। বেশি মাত্রায় দেখেছি ছাগল আর ভেড়ার পাল। দেখেছি জেলে পরিবার। হরিণের পায়ের ছাপ দেখে কী যে শিহরণ খেলেছে শরীরে। হতাশ নাজমূল হকের দেওয়া সান্ত্বনা—‘প্রকৃতির কাছে কিছু চাইতে হয় না, প্রকৃতি এমনি এমনি দেয়, যখন দেয় হাত ভরে দেয়।’ কেওড়ার বনের গভীরে হাঁটা তেমনি এক প্রাপ্তি। এমন সময়ে পেয়ে যাই একটা ইলিশের নাও। জাল থেকে সবে ইলিশ খুলছে। সে অবস্থায় এক হালি গ্রেড ইলিশ (৮০০ গ্রাম বা তার বেশি ওজনের ইলিশকে গ্রেড ইলিশ বলে) কিনে নেই ১২০০ টাকায়। আমাদের নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে ইলিশধরা দেখা ও টাটকা ইলিশ ভাজা খাওয়াও জীবনের অনেক ঘটনার অন্যতম এক স্মরণীয় ঘটনা!

Sundarban-Website

প্রয়োজনীয় তথ্য
নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চের যাত্রী হয়ে যান। লঞ্চ ফারহান-২ ও ৩ প্রতিদিন ঢাকা-হাতিয়া চলাচল করে। যাত্রা শুরুর সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। হাতিয়ার তমরুদ্দি ভোর পাঁচটায় নেমে অটোরিকশা বা মোটরবাইকে চেপে দেড় ঘণ্টায় চলে আসুন মোল্লার ঘাট। এখান থেকে ট্রলারে বন্দরটিলা পাঁচ মিনিটের পথ। এরপর ১৫ বা ২০ মিনিটে নামার বাজার। চাইলে তমরুদ্দি বা হাতিয়া জাহাজ ঘাট থেকে সরাসরি ট্রলারে নামার বাজার চলে যেতে পারেন। নদীতে জোয়ার থাকলে সময় লাগবে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। ট্রলার ভাড়া নেবে রিজার্ভ চার হাজার টাকার মতো।

এখানে খাবারের মান যেমনতেমন হলেও টাটকা মাছ ও দেশি মুরগি পাবেন। থাকার হোটেল আছে একটি। আছে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো অবকাশ। আর বন বিভাগের বিশ্রামাগার, আর আছে নিঝুম দ্বীপবাসীর নিজস্ব কিছু আবাসিক ব্যবস্থা। বিদ্যুতের ব্যবস্থা বলতে সোলার আর জেনারেটর। জেনারেটর দেবে শুধু পানি তোলার জন্য। সুতরাং এসব সুবিধা-অসুবিধার কথা ভেবে আর ঢাকা থেকেই থাকার ব্যবস্থা করে তবে নিঝুম দ্বীপের যাত্রী হবেন। চাইলে নোয়াখালী হয়ে বাসেও নিঝুম দ্বীপ যেতে পারেন। হাতিয়ায় মহিষের দই খেতে ভুলবেন না।

আরেকটি কথা, নামার বাজার থেকে ছোট্ট একটি সেতু পেরিয়ে সামনে গেলে নিঝুম দ্বীপ সৈকতের দেখা পাবেন। নিঝুম দ্বীপের ম্যানগ্রোভ বন চষে ফেরার সময় একবার হলেও সূর্যাস্ত দেখতে সৈকতে যাবেন! সৌজন্যে : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *