Skip to content

নিঝুম দ্বীপের হরিণ

Nijhum-Dwip

নিঝুম দ্বীপে হরিণের পাল

ফেরদৌস জামান
মানুষ তো কত জায়গাতেই বেড়াতে যায়। কেউ যায় সমুদ্রে, কেউ পাহাড়ে, কেউ ইতিহাস-ঐতিহ্য খ্যাত কোনো জায়গায়। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেকে বিদেশেও যান। আসছে ঈদুল আজহা। ঈদের ছুটিতে পরিবার অথবা বন্ধুদের সঙ্গে আপনিও নিশ্চয়ই কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবছেন। আপনার এবারের ভ্রমণ পরিকল্পনা হতে পারে গতানুগতিকতার বাইরে একটু ভিন্ন। যদি তাই হয়, তাহলে সরাসরি সমুদ্রে না গিয়ে সমুদ্রের বুকে ভেসে ওঠা কোনো দ্বীপে গেলে মন্দ হবে না। সেখানে খোলা বাতাস, সমুদ্রের নীল ছাড়াও আপনার প্রতীক্ষায় রয়েছে শত শত হরিণের পাল। হ্যাঁ, তেমন একটি জায়গা আমাদের দেশেই রয়েছে। অনেকে হয়তো সেখানে ইতিমধ্যেই গিয়েছেন। কিন্তু যারা এখনও যাননি তাদের কাছে নিঝুম দ্বীপ বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করে।

নোয়াখালী জেলার সর্ব দক্ষিণের দ্বীপ হাতিয়া। এই দ্বীপ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আরেকটি দ্বীপ হলো নিঝুম দ্বীপ। একে ‘দ্বীপ’ বলা হলেও এটি মূলত চর। এক সময় চরের নাম ছিল- চর ওসমান। ওসমান নামের একজন বাথানিয়া মহিষের বাথান নিয়ে প্রথম সেখানে বসত গড়েন। ধারণা করা হয়, তার নামেই এর নামকরণ। যদিও অনেক পরে এই নামটি বদলে যায়। এর নতুন নামকরণ করা হয় নিঝুম দ্বীপ।

চর হলেও সবুজ সেখানে রয়েছে। অর্থাৎ প্রকৃতির সব রকম রূপ সেখানে পাবেন। আপনি যদি নিঝুম দ্বীপে গিয়ে বন দেখতে চান তাহলে নৌকার ব্যবস্থা রয়েছে। হাতে বাওয়া নৌকায় হরিণের অভয়ারণ্য ঘুরে দেখা যায়। বনের আশপাশ ও মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া একাধিক খাড়ি ধরে সারাদিন ভেসে ভেসে উপভোগ করুন সেই মায়াবি সৌন্দর্য। ভয়ের কারণ নেই, দ্বীপ হলেও নো-ক্রাইম জোন হিসেবে এর খ্যাতি আছে। অপরাধমূলক ঘটনা সেখানে বিরল। সুতরাং চলতি পথে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে যেখানেই দাঁড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে হবে, মাঝিকে বললে সেখানেই নামিয়ে দেবে।

এ ছাড়াও চাইলে অভয়ারণ্য পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখা যাবে। বনে প্রবেশের খানিক পরেই পথ রোধ করে দাঁড়াবে সরু খাল। নৌকায় খাল পাড় হতে হবে। অবশ্য অপনার ভ্রমণসঙ্গী যদি অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তখন নৌকা নয়, পায়ে হেঁটেই হাটু পানি মাড়িয়ে অথবা খালের ওপর উপুর হয়ে থাকা কোনো গাছ বেয়ে পার হতে পারবেন। এবার সোজা ঢুকে যান বনের ভেতর। নির্জন নিস্তব্ধতায় চোখ ও মন দুই-ই ধাঁধিয়ে ওঠার উপক্রম হবে। পায়ের নিচে শুকনো পাতাগুলো মড়মড় শব্দ তুলে সেই নিস্তব্ধতায় যেন সুর দেবে। এর ফাঁকে চোখে পড়বে হরিণের দল।

Nijhum-Dwip2

মনপুরা ঘাট

দলে বিশ থেকে ত্রিশটা হরিণ থাকে সাধারণত। তবে শব্দ পেলেই কিন্তু তারা ছুট দেবে অন্যদিকে। সুতরাং সাবধান হতে হবে আপনাকেও। নিজেই বুঝতে পারবেন, চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দী হরিণ দেখা আর বনে মুক্ত হরিণ দেখার মধ্যে কত তফাত। ত্রিশ হাত দূরে থাকা হরিণের পালের ছবি চাইলে তুলতে পারেন ইচ্ছেমতো।

নিঝুম দ্বীপে হরিণ ছাড়াও রয়েছে উন্মুক্ত বন্য মহিষ এবং বিভিন্ন প্রজাতীর অসংখ্য পাখি। এর মধ্যে সাদা বকের আধিক্য রয়েছে। পাশাপাশি বনে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল মেছো বাঘ, অজগর ও বানর। যদিও সচরাচর তাদের দেখা মেলে না। হরিণের পায়ের ছাপ ধরেই আপনার চলার ট্রেইল। লক্ষ্য করে দেখবেন, পায়ের ছাপগুলো যত্রতত্র নয় বরং সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো। যেন কোনো শিল্পীর এঁকে দেয়া অসাধারণ এক নকশা! এই ছাপ ধরে স্বচ্ছন্দে ও নির্বিঘ্নে ঘুরে দেখতে পারেন পুরো এলাকা। যদিও সামনে এগিয়ে গেলে এক সময় বন ক্রমেই গভীর হতে থাকবে। অসংখ্য শ্বাসমূল আপনার চলার পথে সামান্য বিঘ্ন ঘটাতে পারে। সেক্ষেত্রে চলতে হবে একটু সাবধানে। কারণ উপুর হয়ে পড়লে কিন্তু বিপদ আছে। তখন সেই শ্বাসমূল শরীরে বিধেও যেতে পারে।

Nijhum-Dwip3

দ্বীপে হরিণের দুষ্টুমি, দূরে চড়ে বেড়াচ্ছে মহিষের পাল

বন ঘুরে দেখতে চাইলে একাধিক সরু খাড়ি পাড়ি দিতে হবে। এ জন্য ট্রাভেল ব্যাগ রুমে রেখে ছোট একটা ব্যাগে এক সেট কাপড় নিয়ে বের হতে হবে। সঙ্গে অবশ্যই গামছা রাখবেন। নিশ্চয়ই শুনেছেন, নিঝুম দ্বীপে হরিণের সংখ্যা এতটাই বেড়ে গেছে যে, হরিণের চাপে খোদ হরিণই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এ কথার সত্যতা মিলবে যখন কিছুক্ষণ পর পর আশপাশ দিয়ে একেকটা হরিণের পাল দৌড়ে যাবে। পেশাদার কোনো গাইড না থাকলেও সমস্যা নেই। স্থানীয় যে কোনো তরুণ অথবা যুবক আপনার গাইড হতে রাজি হয়ে যাবে। বিনিময়ে তাকে বিবেচনা মতো পারিশ্রমিক দিলেই খুশি।

এ ভাবেই এক পর্যায়ে পৌঁছে যাবেন বনের পশ্চিম পাশে সমুদ্রের তীরে। সেখানে চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ চারণভূমি। শান্ত স্বভাবের শত শত মহিষ চড়ে বেড়াচ্ছে। ডানে ঘন সবুজের ছায়া ঢাকা বন, বাম পাশে শান্ত স্নিগ্ধ সমুদ্র। খানিকক্ষণ হেঁটে পুনরায় প্রবেশ করুন বনের ভেতর। এবার উপভোগ করুন বনের নিস্তব্ধতা। যেন নিঝুম দ্বীপের এই বনে জন্মেও কারও পা পরেনি! কেবল মাঝেমধ্যে দেখা যাবে হরিণের দল ছোট্ট জলাশয়গুলোয় মুখ নামিয়ে পানি পান করায় ব্যস্ত। হঠাৎ হরেক প্রজাতীর পাখির কলরব হঠাৎই চমকে দেবে আপনাকে। কারণ আপনি প্রবেশ করেছেন তাদের বিশ্রামের এলাকায়।

Nijhum-Dwip4

অভয়ারণ্যের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাড়ি

যাবেন যেভাবে: ঢাকা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় লঞ্চ ছেড়ে যায় হাতিয়ার উদ্দেশে। ও-পথে মাত্র দুটি লঞ্চ যাতায়াত করে-এম.ভি.টিপু-৫ এবং এম.ভি.পানাম। সঠিক সময় লঞ্চ ছেড়ে দেয়। সারা রাত ভ্রমণের পর সকালে গিয়ে উপস্থিত হবেন চর মনপুরা। সকালের নাস্তা সেখানেই সেরে নিতে পারেন। মাল ওঠানামা শেষে প্রায় এক ঘণ্টা বিরতির পর লঞ্চ আবার ছেড়ে দেবে। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে অবতরণ করবেন লঞ্চের সর্বশেষ গন্তব্য হাতিয়ার তমুরুদ্দীন ঘাটে। ঘাট থেকে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ নামাপাড়া বজার ঘাট পর্যন্ত নৌকা রিজার্ভ পাওয়া যায়।

যদি ভেঙে ভেঙে যেতে চান তাহলে সামান্য হেঁটে গেলেই বাজার। সেখান থেকে ভাড়ায় মোটর সাইকেল পাওয়া যায় মুক্তারিয়ার ঘাট পর্যন্ত। অথবা বিকল্প বাহন হিসেবে পুরনো জিপ কেটে বানানো এক ধরনের গাড়ি পাওয়া যায়; পৌঁছে দেবে জাহাজমারা পর্যন্ত। সেখান থেকে রিকশায় যেতে হবে মুক্তারিয়ার ঘাট। সেখান থেকে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ।

Nijhum-Dwip5

দ্বীপের বিভিন্ন ছবি

প্রয়োজনীয় তথ্য: থাকার ব্যবস্থা খুব উন্নত মানের হবে না। অবকাশের একটি রেস্টহাউস রয়েছে। এ ছাড়াও ছোট ছোট কিছু হোটেল রয়েছে। নামাপাড়া বাজারে একাধিক রেস্তোরাঁ রয়েছে। লঞ্চের টিকিটের জন্য যোগাযোগ করুন- এম.ভি.টিপু, ফোন: ০২-৯৩৩৭৩৩৫। সদরঘাট থেকে লঞ্চের কেবিনের ভাড়া (দুই বেড) ১২০০ থেকে ১৭০০ টাকা, ডেকের ভাড়া ২৫০ টাকা।

যা অবশ্য পালনীয়: স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি সম্মান রাখুন। বনের অভ্যন্তরে অহেতুক হৈ চৈ থেকে বিরত থাকুন। বনের পরিচ্ছন্নতা রক্ষার্থে অপচনশীল কোনো কিছু ফেলবেন না। হরিণের চলাফেরায় ব্যাঘাত ঘটাবেন না। কখনও হরিণের পেছনে তাড়া করবেন না বা ঢিল ছুড়বেন না। সূত্র : রাইজিংবিডি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *