Skip to content

নিঝুম দ্বীপে একদিন

মো. সাইফুল্লাহ
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হরিণ শাবকের প্রাণ বাঁচিয়েছিল বাংলাদেশের নিঝুম দ্বীপের এক কিশোর। সেই অসাধারণ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন আলোকচিত্রী হাসিবুল ওয়াহাব। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে সাড়া ফেলে দিয়েছে সেসব ছবি।

হরিণের এমন অবাধ বিচরণ চোখে পড়বে নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপে

হরিণের এমন অবাধ বিচরণ চোখে পড়বে নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপে

গ্রামের এক কিশোর। খালি গা, ভেজা শরীর। পানিতে হাবুডুবু খেয়েও সে এক হাতে উঁচু করে ধরে রেখেছে একটি হরিণশাবক। এই ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহজুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছে এই ছবি।

‘বাংলাদেশি ছেলের সাহসিকতার চমকপ্রদ ছবি’, ‘হরিণশাবক উদ্ধারে এক বাংলাদেশির অবাক করা সাহসিকতা’, ‘হরিণ বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিল ছেলেটি!’

এমন শিরোনামে সচিত্র প্রতিবেদন করেছে ডেইলি মেইল, হাফিংটন পোস্ট, এক্সপ্রেস, মেট্রোনিউজসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দেওয়া সেই ছবির পেছনের গল্প শুনতেই আমরা যোগাযোগ করি হাসিবুল ওয়াহাবের সঙ্গে। বাংলাদেশি এই আলোকচিত্রীই ধারণ করেছিলেন হরিণশাবকের প্রাণ বাঁচানোর সেই ছবি।

সব মিলিয়ে ফেসবুক ও টুইটারে খবরটি শেয়ার হয়েছে লক্ষাধিক বার। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সহস্রাধিক মানুষ খবরের নিচে মন্তব্য করেছেন। ‘ভার্চুয়ালি’ তাঁরা সেই কিশোরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘ব্রাভো’!

হাসিবুল শুরু করলেন, ‘ঘটনাটা আজ থেকে বছর দুয়েক আগের…!’
ঘটনাস্থল? নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার নিঝুম দ্বীপ!

৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে ডেইলি মেইলের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত ছবি

৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে ডেইলি মেইলের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত ছবি

নিঝুম দ্বীপের সাহসী প্রাণ
ছবি তোলা হাসিবুল ওয়াহাবের শখ। পেশায় সফটওয়্যার প্রকৌশলী হলেও বেড়ানোটা তাঁর নেশা। ২০১২ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময় গিয়েছিলেন নিঝুম দ্বীপে। সঙ্গে সহকর্মী শেখ আবদুর রহমান। ইচ্ছে ছিল নিঝুম দ্বীপে হরিণের ছবি তুলবেন।

সেদিন আবহাওয়া খুব একটা ভালো ছিল না। বর্ষাকাল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে ৩ নম্বর বিপৎসংকেত দেওয়া হয়েছিল, তাই পর্যটকের সংখ্যাও ছিল কম। হাসিবুল বলছিলেন, ‘হরিণ দেখতে এসেছি শুনে রিকশাওয়ালা আমাদের এক জায়গায় নিয়ে গেলেন। জায়গাটা সম্ভবত বন্দরটিলা আর নামাবাজারের মাঝামাঝি। সাধারণত ওখানে হরিণ খুব একটা আসে না। কিন্তু বর্ষাকালে জঙ্গলে পানি ঢুকে গেলে নাকি বিকেলের দিকে কিছু হরিণ দেখা যায়।’ জায়গামতো পৌঁছে হাসিবুল আর আবদুর রহমান কিছুটা হতাশই হলেন। গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা খাল আছে, খালের ওপারে জঙ্গল আছে, মনোরম পরিবেশও আছে, শুধু হরিণ নেই। দুই পর্যটকের চোখ জুড়ালেও ঠিক মন ভরছিল না।

তারপর?

হাসিবুল বলছিলেন, ‘আমরা দেখলাম, খালের পাড়ে একটা ছোটখাটো জটলা। গিয়ে দেখি, গ্রামের একটা ছেলে হাতে বাচ্চা একটা হরিণ নিয়ে বসে আছে। তাকে ঘিরে এলাকার চার-পাঁচজন মানুষ। হরিণটা খুবই ছোট, দেখে মনে হচ্ছিল সেদিনই জন্ম হয়েছে। ছেলেটা কীভাবে, কোথা থেকে হরিণটা পেল, সেটাও বোঝা যাচ্ছিল না।’

হাসিবুল ওয়াহাব

হাসিবুল ওয়াহাব

কেন? ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেই তো জেনে নেওয়া যায়। এ পর্যায়ে এসে হাসিবুল জানালেন অবাক করা তথ্য। হাড় জিরজিরে শরীর ছাড়াও হরিণশাবকটির সঙ্গে আরও একটা মিল আছে ছেলেটির। সে কথা বলতে পারে না। ‘কেউ একজন পাশ থেকে বলল, ওর নাম বেলাল। বেলাল ইশারায় বোঝাচ্ছিল, আশপাশেই কোথাও হরিণের বাচ্চাটাকে কুড়িয়ে পেয়েছে ও। বেলালের কথা বেশির ভাগই আমরা বুঝতে পারছিলাম না। যেটুকু বুঝলাম—বাচ্চাটা কাদার মধ্যে আটকা পড়ে ছিল। সে তুলে পরিষ্কার করেছে।’ বলছিলেন হাসিবুল।

হরিণের পাল মূলত থাকে খালের ওপারে। এইটুকুন একটা বাচ্চা হরিণ কীভাবে এপারে এল, ওর পরিবার-পরিজনই বা গেল কোথায় সে এক রহস্য। তবে রহস্য উদ্ঘাটনের আগে বাচ্চাটাকে হরিণের পালের কাছে পৌঁছে দেওয়াই জরুরি মনে হচ্ছিল সবার কাছে। ৩ নম্বর বিপৎসংকেত চলছে, ২০ থেকে ৩০ ফুট লম্বা খালের পানিতেও প্রচণ্ড স্রোত। সাঁতরে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। এখন উপায়?

অল্পের জন্য রক্ষা: হরিণ শাবকটিকে উদ্ধার করে পানি থেকে উঠে আসছে সেই সাহসী কিশোর

অল্পের জন্য রক্ষা: হরিণ শাবকটিকে উদ্ধার করে পানি থেকে উঠে আসছে সেই সাহসী কিশোর

বাচ্চাটাকে উদ্ধার করেছিল বেলাল, বাকি দায়িত্বটুকুও সে-ই নিল। এক হাতে হরিণটাকে উঁচু করে ধরে রেখে নামল পানিতে। ‘আমি, লিঙ্কন ভাই (শেখ আবদুর রহমান), আর গ্রামের কিছু লোক এপারে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। একসময় মনে হচ্ছিল, বেলাল বোধ হয় ডুবেই যাবে। খুব উৎকণ্ঠায় ছিলাম। কিন্তু বেলাল খুব ভালো সাঁতারু আর সাহসীও। ঠিক ঠিক ওপারে পৌঁছে গেল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।’

ওপারে হরিণের বাচ্চাটাকে নামিয়ে দিয়ে ফিরে এসেছিল বাহাদুর ছেলেটা। বাহবা জানিয়ে সেখানেই তাকে বিদায় দিয়েছিলেন হাসিবুল আর শেখ আবদুর রহমান। হাসিবুল তখনো জানেন না, জীবনের সবচেয়ে দুর্লভ ছবিটি ক্যামেরায় ধারণ করে ফেলেছেন তিনি। এই ছবি নিয়ে এত তোলপাড় হবে, সেটিও তাঁর ভাবনায় ছিল না।

এই সেই হরিণ শাবক: উদ্ধারের পর, ছবি: ক্যাটারস নিউজ

এই সেই হরিণ শাবক: উদ্ধারের পর, ছবি: ক্যাটারস নিউজ

ছবি যখন খবর
নিঝুম দ্বীপ থেকে চলে আসার পর হাসিবুল ওয়াহাব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নিজের কাজে। ছবি তোলা আর বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়াও চলছিল। বেলাল আর হরিণশাবকের ঘটনা খুব ভালো মনেও ছিল না তাঁর। তবে এতকাল পর কীভাবে ছবিটা ছড়িয়ে গেল? হাসিবুল বলছিলেন, ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সাময়িকীর ওয়েবসাইট থেকে প্রতিদিন “ডেইলি ডজন” নামে ১২টি ছবি আপলোড করা হয়। সেখানে আমার ছবিটা নির্বাচিত হয়েছিল। আপলোড হয়েছিল গত ১৭ জানুয়ারি। এর কিছুদিন পরই ক্যাটারস নিউজ নামে একটা এজেন্সি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের মাধ্যমেই ঘটনাটা অন্য সংবাদমাধ্যমগুলো জানতে পারে।’ জানা গেল, ইতিমধ্যেই পশুপ্রেমী অনেকে হাসিবুলের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করেছেন। নিঝুম দ্বীপের সেই কিশোরের মানবতাবোধ তাঁদের মুগ্ধ করেছে।

যে ঘটনা নিয়ে এত তোলপাড়, ঘটনার নায়ক সেই ‘কিশোর’ কি এসব জানে? সূত্র : প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *