জাহীদ রেজা নূর
সদরঘাটে এসে লঞ্চ দেখে শৌনকের আক্কেলগুড়ুম! ‘এ যে একেবারে টাইটানিক!’
নিজের ছোট্ট লাগেজ টানতে টানতে সনকা বলে, ‘দেখিস, এই লঞ্চ আবার কোনো আইসবার্গের সঙ্গে ধাক্কা না খায়!’
ক্লাস নাইনের শৌনক ওর অর্জিত জ্ঞান বিতরণ করে, ‘বাংলাদেশে বরফ নেই। তাই আইসবার্গও থাকবে না!’
কথা বলতে বলতেই ‘সুরভী ৯’ নামের বিশাল লঞ্চের ভিআইপি কেবিনের দিকে তারা দুজন রওনা হয়। আমাদের মনে তৃপ্তি ফিরে আসে। লঞ্চভ্রমণ নিয়ে এই যুগের ছেলেমেয়েদের যে অবজ্ঞা আছে, তা থেকে যে অন্তত তারা দুজন মুক্ত হলো, তাতেই আমরা খুশি।
কুয়াকাটার উদ্দেশে আমাদের এই জার্নিটা ছিল জুন মাসে। সেটা অফ সিজন। খুব কম মানুষই এই সময়টাকে সমুদ্রদর্শনের জন্য বেছে নেয়। এ সময় সমুদ্রপারের হোটেল-মোটেলগুলোও বিশ্রাম নেয়। হঠাৎ আমাদের মতো অফ সিজনের বোর্ডার পেলেই কেবল তারা আড়মোড়া ভাঙে, নড়ে চড়ে বসে।
ভ্রমণটাকে উপভোগ্য করার জন্য আমরা ঢাকা থেকে সরাসরি পটুয়াখালী গেলাম না। গেলাম বরিশাল। এখান থেকে চারটি নদী পার হয়ে কুয়াকাটায় পৌঁছাতে হবে। বরিশালে আমাদের চার সদস্যের এই দলটির জন্য অপেক্ষা করবে একটি এসি মাইক্রোবাস। খুব ভোরে বরিশাল পৌঁছানোর পর এই মাইক্রোবাসই আমাদের পৌঁছে দেবে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত একই সঙ্গে দেখা যায়, এমন বিরল এক সমুদ্রসৈকতে।
লঞ্চের কেবিনটা যেকোনো উঁচু দরের হোটেল রুমকেও হার মানায়। আর খাওয়াদাওয়া? সে কথা আর নাই-বা বললাম। বড় বড় পাবদা, কষা মুরগি আর রুপচাঁদার কথা বলে পাঠকের লোভ নাহয় না-ই বাড়ালাম! শুধু বলি, রাত একটু গভীর হলে প্রায় সবাই যখন ঘুমাতে চলে যায়, ঠিক সে সময় লঞ্চের ডেকের হাওয়ায় শরীর ভাসিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার যে আনন্দ, পূর্ণিমা থাকলে গোলাকার চাঁদ দেখার যে আনন্দ, তা থেকে বঞ্চিত হওয়া ঠিক হবে না।
আমার প্রথম সমুদ্রদর্শন হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। কৃষ্ণসাগরের জল কালো ছিল না, ছিল গাঢ় নীল। দেশে ফিরে কক্সবাজারেও গেছি অনেকবার। মূল সৈকত ছাড়াও হিমছড়ি, ইনানীতে ভালো লেগেছে। আর স্পিডবোটে করে মহেশখালী যাওয়ার আনন্দ, আদিনাথের মন্দির দেখার স্মৃতি ভোলার নয়। বাকি ছিল কুয়াকাটা। বাকি ছিল জনশূন্য সৈকতে নিজের সঙ্গে নিজের একান্ত কথোপকথন।
ভোর ছয়টার দিকে লঞ্চ থেকে নেমে মাইক্রোবাসে করে আমরা কুয়াকাটার পথে রওনা হলাম। বরিশাল থেকে যে রাস্তাটা পটুয়াখালীর দিকে গেছে, সেটি মসৃণ। দুপাশে গাছের সারি, অনতিদূরে ফসলের খেত, তাতে চরে বেড়াচ্ছে গরু কিংবা ছাগল। লোকালয় পার হলেই দুপাশের সবুজ আর কিছুক্ষণ পরপর দিঘি, পুকুর বা ডোবার টলটলে জল মনকে সতেজ করে তুলছে।
তিনটি নদী পার হওয়া গেল নির্বিঘ্নে। এর মধ্যে বলার মতো ঘটনা ছিল একটাই। আন্ধারমানিক নদী পার হওয়ার সময় ফেরিঘাটে বিক্রি হচ্ছিল মাছ। দেশি চিংড়িগুলো ছিল খুবই সস্তা। কেনার লোভও হচ্ছিল। কিন্তু কুয়াকাটায় মাছ নিয়ে কী করব—এ সমীকরণ তো মেলার নয়! আর হ্যাঁ, যতই কাছাকাছি হচ্ছিলাম কুয়াকাটার, ততই পাচ্ছিলাম সমুদ্রের স্বাদ। এই তো সোনাতলা নদীতে পালতোলা যে ট্রলারগুলো দেখা যাচ্ছে, এরাই তো সমুদ্রে যায়, এরাই তো ইলিশ ধরে আনে!
শিববাড়িয়া, মানে কুয়াকাটা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের এই নদীর ফেরিঘাটে এসে দেখি ভীষণ জোয়ার। জোয়ারের প্রবল টানে পল্টুন ভেসে গেছে। প্রতিদিনই যায়। তখন ভাটা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। বাসগুলো অবলীলায় জল ঠেলে চলে যেতে পারে। কিন্তু মাইক্রোবাস বা গাড়ি পারে না। ফলে তীরে এসে তরী ডোবার মতো অবস্থা হলো আমাদের। এখানেই কেটে গেল তিন ঘণ্টা। ভাটা এসে পল্টুন উদ্ধার করে দিলে আমরাও পৌঁছে গেলাম কুয়াকাটায়। বলে রাখি, এখন এই তিনটি নদীর ওপরেই সেতু হচ্ছে। খুব দ্রুত শেষ হচ্ছে সেতুর কাজ। সেতু হয়ে গেলে কুয়াকাটায় যাওয়া-আসা খুব সহজ হয়ে যাবে।
জোয়ারে নদীর ঘাটে আটকে থাকার সময়ই হোটেলে ফোন করে খাবারের কথা বলে রেখেছিলাম। আমরা মুরগি চাইছিলাম, কিন্তু হোটেল ম্যানেজার জানালেন, সদ্য জবাই করা খাসির মাংস আছে। সেটাই নাকি রসনাকে তপ্ত করবে।
দুপুর ১২টার দিকেই পৌঁছে যেতাম। কিন্তু শিববাড়িয়া নদীর জোয়ার কুয়াকাটা পৌঁছানোর সময়টাকে বেলা তিনটা করে দিল। খাওয়াটা সত্যিই ছিল দারুণ। একটু বিশ্রাম নিয়ে হোটেলের লবি পার হতেই একটা মোটরসাইকেল এসে সামনে দাঁড়াল। বলে রাখি, কুয়াকাটায় রিকশা নেই। চলাচলের বাহন মূলত মোটরসাইকেল। অল্প কিছু ভ্যানও আছে, তবে তা দূরে যাওয়ার উপযোগী নয়। কুয়াকাটা থেকে ডানে ও বাঁয়ে দুদিকেই আছে দর্শনীয় স্থান। মোটরসাইকেলে যেকোনো একদিক যেতে ভাড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ঘণ্টা দুয়েকের ভ্রমণ। খারাপ লাগে না।
‘আপনারা কুয়াকাটা ঘুরবেন? কাঁকড়ার চর, লেবুর চর, গঙ্গামতীর চর, মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধবিহার নিয়ে যাব। সমুদ্রপারে খাওয়ার হোটেলে নিয়ে যাব। যাবেন?’
এই স্মার্ট ছেলেটির নাম রুবেল। ২৩ বছর বয়স। মোটরসাইকেলে পর্যটকদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোই ওর পেশা। অপরাহ্ণে সমুদ্রে স্নান করার দরকার নেই। তার চেয়ে ভালো, একটু মোটরসাইকেলে করে সমুদ্রের কাছের দর্শনীয় জায়গাগুলো চষে ফেলা। তাই আমরা চারজন দুটি মোটরসাইকেলে চড়ে বসলাম। ভাটার গভীর টানে সমুদ্র তখন একটু দূরে সরে গেছে। সৈকতের বালুকাবেলার পথ ধরেই আমরা এগিয়ে চললাম কাঁকড়ার চরের দিকে। পথে ছোট্ট দুটো রেস্তোরাঁ। ছাউনি নেই। সামনে বিশেষভাবে নির্মিত বাক্সে তাজা মাছ, কাঁকড়া। ইলিশ, বাঁশপাতা, চিংড়ি, কোরালসহ নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছ থেকে দাম-দর করে নিতে হয়। ওখানেই কোটা-বাছা করে সস দিয়ে পরিবেশন করতে লাগে ৩০ মিনিট। আমরা কয়েকটি মাছ ভাজতে বলে আরও দূরে এগিয়ে যাই। কাঁকড়ার চরে এসে লাল কাঁকড়াগুলো দেখি। মানুষের আগমন দেখে কে কার আগে গর্তে ঢুকবে, সেই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে লাল কাঁকড়ার দল। সমুদ্রে পা ভেজানোর মধ্যেই এদিনের তৎপরতা ছিল সীমাবদ্ধ।
পর্যটনকে ঘিরে যাদের জীবিকা, তারা এ সময়টায় অন্য কিছু করার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ঈদের ছুটি বা শীতের সময় কুয়াকাটায় নােম মানুষের ঢল। তখন বাণিজ্য হবে, ভরে যাবে সৈকত। শুধু নির্জনতাটুকু থাকবে না।
এরপর দুটো দিন কীভাবে কাটল, তা বর্ণনাতীত। সকালে জনমানবহীন সমুদ্রের কাছে যাওয়া, বহুদূর থেকে ভেসে আসা বিশাল ঢেউয়ের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা, দৃষ্টিসীমার বাইরে থেকে হঠাৎ কোনো জেলেনৌকা দৃশ্যমান হওয়া, কাছাকাছি হলে তাদের কাছে থাকা মাছের খোঁজখবর নেওয়া—এ যেন রূপকথার মতো মনে হয়। বিশেষ করে সমুদ্রের কাছে নির্জনতার যে একটা ভাষা আছে, সমুদ্রের বিশালতার কাছে মানুষ যে কত ক্ষুদ্র, তা উপলব্ধি করার সুযোগ আছে—এ এক বড় পাওয়া।
দুটো বৌদ্ধবিহারে গিয়ে বুদ্ধমূর্তি দর্শন করার স্মৃতি ভোলার নয়। এর মধ্যে মিশ্রিপাড়ার বৌদ্ধবিহারটি ১৫ কিলোমিটার দূরে, গাঁয়ের প্রান্তিক পথ ধরে মোটরসাইকেলে করে সেখানে যাওয়া আর কংক্রিট রাস্তা দিয়ে ফেরার ঘটনাটি স্মৃতিময়। গঙ্গামতীর চরে এসে নৌকায় করে মোটরসাইকেলসমেত নদী পার হওয়া, গঙ্গামতীকে সাগরের সঙ্গে মিলে যেতে দেখাও জীবনের এক বিরল অভিজ্ঞতা। সিডরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বন দর্শন, শুঁটকি বাজার দর্শন—এসবও মনে দাগ কাটে।
এখনো বাণিজ্য এসে কুয়াকাটাকে গিলে ফেলেনি। এখনো কুয়াকাটা মানেই প্রকৃতির কাছে যাওয়া। তাই এক আদিম, সরল পৃথিবীর পরশ পাওয়ার জন্য কুয়াকাটা যেন ডাকছে আমাদের।
শৌনক এরই মধ্যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। সনকা দিয়েছে ছবি। তাদের ফেসবুক-সাহিত্যে উঠে এসেছে কুয়াকাটার অসাধারণ নির্জনতা আর বিশালতার কথা।
ফিরে আসার সময় আমাদের চারজনের মনই বলছিল, এটা কেবল শুরু। সমুদ্রের টানে বারবার ফিরে আসব আমরা এখানে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে করে কুয়াকাটা যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে চাইলে আপনি পটুয়াখালী, বরিশাল হয়েও কুয়াকাটা যেতে পারবেন।
ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠে বরিশাল পর্যন্ত গিয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত বাকি পথটুকু যেতে হবে বাসে। এ ছাড়া আপনি পটুয়াখালী পর্যন্ত লঞ্চে যেতে পারেন। এরপর বাসে করে কুয়াকাটা। সৌজন্যে : প্রথম আলো