:: ফারুখ আহমেদ ::
নাফ নদীর তীরের ছোট্ট দ্বীপ জালিয়া অসাধারণ। ঝাউবনে পাওয়া যাবে সবুজ ছোঁয়া। মাছ ধরার ট্রলার কিংবা সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়ালে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দেখা যাবে নীল আকাশের নিচে স্বচ্ছ সমুদ্র। নির্জন সৈকতে বিছানো সাদা বালির রাশি। প্রবল বাতাসে সমুদ্র ঊর্মিমালার ফেনা তোলা মাতামাতি। নির্জনতায় বিশুদ্ধভাবে প্রকৃতির গান শোনা আর শেষ বিকেলের সোনারোদের আলোর রঙে আঁকা জলছবি দেখা- এর সবকিছু মিলবে বাহারছড়া সমুদ্রসৈকতে। মাছ ধরার নৌকা আর জেলেরা ছাড়া সেভাবে কোনো মানুষজন চোখে পড়বে না, ঝাউবনে পাওয়া যাবে সবুজ ছোঁয়া। মাছ ধরার ট্রলার কিংবা সমুদ্রসৈকতে ঘুরে বেড়ালে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দেখা যাবে। এসব দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে টেকনাফের কাছে বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের কাছে বাহারছড়া সমুদ্রসৈকতে। এখানকার দৃষ্টিনন্দন ঝাউবনে ঘেরা অপরূপে শোভিত নির্জন সৈকতে এসে ভালো লাগার ষোলোআনাই পাওয়া যাবে!
গরমকাল সেই কবে শেষ হয়েছে, শরৎকালও শেষ। এখন সময়গুলো মোটেও গরমের নয়। বেশ আরামদায়ক আবহাওয়া, ক্ষণে ক্ষণে রোদ, ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি। আকাশে রোদ-মেঘেদের খেলা। এমন বৃষ্টিভেজা মেঘলা আকাশের অপরূপ একদিন বের হলাম। যাত্রা শুরু হলো হোয়াইক্যং রোড থেকে। হোয়াইক্যং রোড বা শামলাপুর নাম হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন আবার কারও কারও মনে হবে জীবনে প্রথম শুনলাম এই নামগুলো। সে যাই হোক, টেকনাফ থেকে হোয়াইক্যং রোড ধরে ২০ কিলোমিটার দূরত্বের শামলাপুর গেলে যে সৌন্দর্য উন্মোচিত হবে তা সারাজীবন মনে থাকবে।
টেকনাফ বহুবার গেছি। তবে টেকনাফের উদ্দেশে গেছি খুব কম সময়। এবারের ঘোরাফেরার মূল উদ্দেশ্যই ছিল টেকনাফের জালিয়ার দ্বীপ ও নাফ নদীর ওপর ডকুমেন্টারি করা। খুব ভোরে বাস থেকে সাংবাদিক বোরহানুল হক সম্রাটসহ আমরা টেকনাফ লিংক রোডে নেমে সোজা চলে আসি জালিয়ার দ্বীপ। নাফ নদীর তীরের ছোট্ট দ্বীপ জালিয়া অসাধারণ। আমরা জালিয়ার দ্বীপ ভ্রমণ বা এখানে আমাদের ডকুমেন্টারির কাজ শেষ করে দুপুরে চলে আসি হোয়াইক্যং রোডে স্থানীয় সাংবাদিক আবসার কবির আকাশের বাড়ি। রাস্তার ঠিক পাশে আবসার কবিরের সে বাড়ি থেকে নাফ নদী ও পাহাড় দর্শন আর তা আপ্যায়ন অনেক দিন মনে থাকবে। আপ্যায়ন পর্ব শেষে দুপুরের ভাত-ঘুমের সময়টা আমরা আকাশের বাড়িতে কাটিয়ে ঠিক সাড়ে ৩টার সময় শামলাপুরের উদ্দেশে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় চেপে বসি। আগেই বলেছি, শামলাপুর থেকে সমুদ্রসৈকত দেখা যায়। আজ আমরা সমুদ্রের ঊর্মিমালায় মন হারাব।
হোয়াইক্যং রোড ধরে কিছুটা পথ এগিয়ে ধমধমিয়ার পথে চলা শুরু করি, পাহাড়ি পথ। দু’পাশের পুরোটাই ঘনজঙ্গল। জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। পথ চলতে চলতে চোখে পড়ে রাস্তাজুড়ে বাচ্চাদের খেলাধুলা আর কাঠ কুড়ানোর দৃশ্য। জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা কিছু ট্রেকারদেরও দেখা পেয়ে যাই। পুরো পথটাই যেন সবুজে মোড়া। অনেক নাম না জানা ফুলের সঙ্গে নীল বনলতা চোখে পড়ে। এভাবেই জাদিমুরা, লেদা, মুচনি, রঙ্গিখালি ও মৌলবীপাড়া পেছনে ফেলে লাতুরিখোলায় এসে যাত্রা বিরতি নিই। লাতুরিখোলার আশপাশে পাহাড় ছাড়া আর কিছু নেই। এখানে জীবন অনেক ধীরস্থির। কোনো ব্যস্ততা নেই এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে। এখানে বেশিরভাগই চাকমা নৃগোষ্ঠীর বসবাস। গ্রামবাসীদের উপার্জন কী জানা যায়নি বা জানতে চাইনি। যেহেতু এখানকার প্রকৃতি অসাধারণ, সেহেতু ট্রেকারদের জন্য এমন প্রকৃতিতে চলাচল দারুণ বলা চলে, ভাবতে গিয়ে মনে হয় যদি স্থানীয়রা এখানে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের মতো হোম স্টের ব্যবস্থা করত তাহলে বিষয়টা হতো সোনায় সোহাগা। ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গী শিক্ষক জুলকারনাইনের ছাত্রদের আপ্যায়ন ডাব চলে এসেছে। আমরা ডাবের পানি পান করে দ্রুত সামনে যাই আর ভাবি প্রকৃতির মতোই সুন্দর আর ছবির মতো এখানকার মানুষগুলো। এভাবে কতক্ষণ চলেছি মনে নেই, দূর থেকে ঝাউগাছের সারি দেখে বুঝতে পারি সমুদ্র খুব কাছাকাছি। এর পরের সময়টুকু মেরিন ড্রাইভ রোডের। তারপরই পা রাখি বাহারছড়া সমুদ্রসৈকতে। গত ফেব্রুয়ারিতে বাহারছড়া সৈকতে মাসব্যাপী ঝাউবন কাটার খবর দেশের সবক’টা জাতীয় দৈনিকের হেডলাইন হয়েছিল!
ঝাউগাছের সারি, বালুর নরম বিছানা, তার সামনে বিশ্রামরত মাছ ধরার ট্রলার। আরও সামনে অপরূপ বঙ্গোপসাগর। এখানে নির্জনতাও একটা বড় ব্যাপার। কক্সবাজার হিমছড়ি বা ইনানীতে কত মানুষ ভিড়বাট্টা আর হৈ-হুল্লোড়। এখানে তার কিছুই নেই। বেলা পড়ে আসায় মাছ ধরার ট্রলারগুলো টেনে তীরে তোলা হচ্ছে। অনেকেই জাল দিয়ে মাছ ধরছে। একঝাঁক স্থানীয় শিশুর চিৎকার আর দৌড়ঝাঁপের মধ্যে চোখে পড়ল শুধুই সমুদ্র আর তার নীল জলরাশির শোঁ শোঁ গর্জন। আবেগ কোত্থেকে উথলে উঠল বলতে পারব না। সারা শরীরে কারেন্টের মতো শিহরণ বয়ে গেল। পানি আমার খুব পছন্দ, তাই তো বারবার নদীর কাছে ছুটে যাই, ছুটে আসি সমুদ্রের কাছে। সমুদ্র বা নদী কেউ আমাকে নিরাশ করে না বা করেনি। তাই তো আজ এখানে বা সমুদ্রসৈকতে পা দিয়েই দারুণ রোমান্স অনুভব করি। এর মধ্যে স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক খোকন স্যার আমাকে নিয়ে চলেন লাল কাঁকড়া দেখাতে। আমাদের সঙ্গে যোগ দেন জুলকারনাইন। অন্যদিকে বোরহানুল হক সম্রাট দলবল নিয়ে সমুদ্রজলে অবগাহনে মেতেছেন। সব মিলে বাহারছড়া এসে সমুদ্রসৈকতের রোমান্সের সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে চমৎকার মিশেল পাওয়া গেল তা এক কথায় অসাধারণ। এমন অসাধারণে বারবার আমি ডুবতে চাই, কারণ আমার কাছে মনে হয় সৈকত শুধুই জীবনের উৎসব।
দরকারি তথ্য
কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্র্রাইভ সড়ক ধরে সোজা ঘণ্টা দুয়েক গেলেই শামলাপুর বা বাহারছড়া সমুদ্রসৈকতের দেখা মিলবে, আমরা গিয়েছিলাম টেকনাফ থেকে। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য আমাদের পথে যাওয়া অর্থাৎ হোয়াইক্যং রোড ধরে শামলাপুর পর্যন্ত পথটুকু দারুণ উপভোগ্য হবে নিঃসন্দেহে। সে জন্য আপনাদের টেকনাফের বাসে চড়ে টেকনাফ সড়কের হোয়াইক্যং রোড নামতে হবে। তারপর ধমধমিয়া হয়ে চলে আসুন শামলাপুর সমুদ্রসৈকত। সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা ব্যাটারিচালিত অটো বাহনই হোয়াইক্যং রোড থেকে শামলাপুর পর্যন্ত একমাত্র ভরসা। শামলাপুর থাকা খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। কক্সবাজার বা ইনানীই একমাত্র ভরসা। তবে চলতি পথে ছোটখাটো কিছু বাজার ও দোকানের দেখা পাবেন। সেখানেই সারতে পারবেন প্রয়োজনীয় কাজ। একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, আপনার বা আপনার ভ্রমণসঙ্গীদের দ্বারা পরিবেশ হুমকিতে পড়ে- এমন কোনো কিছু অবশ্যই করা চলবে না, পলিথিন বা প্লাস্টিকের বোতলসহ পরিবেশ বিপন্ন হয় তেমন কিছু ফেলে আসবেন না সমুদ্রসৈকতে। সৌজন্যে : সমকাল