Skip to content

নিষিদ্ধ নগরীর রাজপ্রাসাদে

Chinaশান্তা মারিয়া
চীন আন্তর্জাতিক বেতারে কাজ করার সময় `বেইজিং কেপেইচিং` বলতে শিখেছি। আর পেইচিংয়ের অসম্ভব সুন্দর সব স্থাপনা দেখে তার প্রেমে পড়েছি। পর্যটকরা পেইচিংয়ে গিয়ে গ্রেটওয়ালে চড়ার পরই যে জায়গাটি দেখার জন্য ব্যস্ত হন সেটি ফরবিডেন সিটি। এর অন্য নাম প্যালেস মিউজিয়াম।

পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক প্রতিদিন ফরবিডেন সিটিতে আসেন। ঐতিহাসিক গুরুত্ব, শিল্প নিদর্শন, সম্পদ ও সৌন্দর্যের দিক থেকে ফরবিডেন সিটি হলো পৃথিবীর বুকে মানুষের সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দর স্থাপনাগুলোর অন্যতম। নভেম্বরের এক কুয়াশা ঢাকা সকালে আমি ও শিহাব গেলাম ফরবিডেন সিটি দেখতে। প্রথমেই এ সম্পর্কে কিছু তথ্য দিচ্ছি। গণ চীনের রাজধানী পেইচিংয়ের কেন্দ্রীয় অংশে অবস্থিত ফরবিডেন সিটি পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর স্থাপনা। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্গত হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং বিশ্বে কাঠের কাজের সবচেয়ে বড় সংগ্রহ বলে অভিহিত করেছে। ফরবিডেন সিটি ৭ লাখ ২০ হাজার বর্গমিটার বা ৭৮ লাখ বর্গফুট এলাকাজুড়ে নির্মিত প্রাচীরঘেরা এক বিশাল জগত। তার মধ্যে রয়েছে ৯৮০টি প্রাসাদভবন, ভাস্কর্য, জলাশয় ও প্রাঙ্গণ।

১৪০৬ সাল থেকে ১৪২০ সালের মধ্যে ফরবিডেন সিটির মূল কয়েকটি স্থাপনা গড়ে ওঠে। ফরবিডেন সিটি ছিল চীন সম্রাটদের বাসস্থান এবং পাঁচশ বছর ধরে চীনের প্রশাসনিক ক্ষমতার মূল কেন্দ্র। চীনের ইউয়ান রাজবংশের সময় ফরবিডেন সিটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও এর মূল স্থাপনাগুলো গড়ে ওঠে মিং ও ছিং রাজবংশের শাসনকালে।

সম্রাটের অনুমতি ছাড়া এ এলাকায় কেউ প্রবেশ করতে বা এলাকা ত্যাগ করতে পারতো না বলে এর নাম ফরবিডেন সিটি। মঙ্গোল ইউয়ান রাজবংশের সময় এখানে প্রথম রাজকীয় নগরী গড়ে ওঠে। ইউয়ান রাজ বংশের পর মিং বংশের সম্রাট হোং কু রাজধানী পেইচিং থেকে নানচিংয়ে নিয়ে যান এবং ইউয়ান প্রাসাদ পুড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু তাঁর ছেলে সম্রাট হয়ে রাজধানী আবার পেইচিংয়ে নিয়ে আসেন এবং এখানে প্রাসাদ নির্মাণের আদেশ দেন। ১৪০৬ সালে ফরবিডেন সিটির মূল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৫ বছর ধরে দশ লাখেরও বেশি শ্রমিক প্রাসাদ নির্মাণের কাজ করেন। দক্ষিণ পশ্চিম চীনের অরণ্য থেকে আনা হয় মহামূল্যবান ফোবেচেনান কাঠ, মার্বেল পাথরের বিশাল সব খণ্ড দিয়ে সাজানো হয় প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষ। তৈরি হয় অসাধারণ সব ভাস্কর্য। প্রাসাদ কক্ষের মেঝে তৈরি হয় সোনালি ইট দিয়ে। মিং রাজবংশের ১৪ জন সম্রাট ও ছিং রাজবংশের ১০ জন সম্রাট ফরবিডেন সিটিতে বাস করেন এবং এখান থেকে পুরো চীনদেশ শাসন করেন।

ফরবিডেন সিটি এখন আর নিষিদ্ধ নেই। এখানে এখন রয়েছে প্যালেস মিউজিয়াম। মিং রাজবংশের সময় নির্মিত চীনামাটির অপূর্ব সুন্দর শিল্প নিদর্শন, সোনা, রূপা, জেড পাথরসহ বিভিন্ন মহামূল্যবান রত্নে তৈরি শিল্পসামগ্রী, চীনা রেশমের কারুকার্যময় পোশাক, দুর্লভ হস্তশিল্প রয়েছে প্যালেস মিউজিয়ামে। এ ছাড়া রয়েছে তাং ও সং রাজবংশের অসাধারণ সব মূল্যবান শিল্পসংগ্রহ। রয়েছে ৫০ হাজার পেইন্টিং।

পুরো ফরবিডেন সিটি এখন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। ফরবিডেন সিটি হলো প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চীন সভ্যতার শিল্পকীর্তির প্রতীক। পেইচিংয়ের প্রাণকেন্দ্র থিয়েন আনমেন চত্বরের বিপরীত দিকেই রয়েছে ফরবিডেন সিটিতে প্রবেশের প্রধান ফটক বা তোরণ। এই তোরণটি এত বিশাল যে একে একটি স্বতন্ত্র প্রাসাদ বলে মনে হয়। ফরবিডেন সিটিতে প্রবেশের মূল তোরণগুলোর মধ্যে মেরিডিয়ান গেট, গেট অব ডিভাইন মাইট, ওয়েস্ট গ্লোরিয়াস গেট, ইস্ট গ্লোরিয়াস গেট এবং গেট অব সুপ্রিম হারমোনি বিশেষ বিখ্যাত। ফরবিডেন সিটির পুরো এলাকা ৭.৯ মিটার উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।

China2

ফরবিডেন সিটি প্রধানত দু`ভাগে বিভক্ত। সামনের প্রাসাদগুলো সম্মুখ দরবার আর ভিতরের দিকের প্রাসাদগুলো অন্দর দরবার নামে পরিচিত। সম্মুখ দরবার প্রধানত উৎসব অনুষ্ঠানের জন্য আর অন্দর দরবারের প্রাসাদগুলো রাজ পরিবারের বাসস্থান ও সাধারণ প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহৃত হতো। সম্মুখ দরবারের প্রথম প্রাসাদটি সুপ্রিম হারমোনি চত্বরে অবস্থিত। এই ভবনে রয়েছে তিনটি বিশাল হল বা দরবার কক্ষ। এই হলগুলোর নাম সুপ্রিম হারমোনি, সেন্ট্রাল হারমোনি ও প্রিসারভিং হারমোনি। এর মধ্যে সুপ্রিম হারমোনি হল সবচেয়ে বড়। মেঝে, দেয়াল ও সিলিংয়ের অপূর্ব কারুকার্য পর্যটকদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করে। এখানে সম্রাটের অভিষেক অনুষ্ঠান হতো। মিং ও ছিং রাজবংশের শাসনামলে এখানে শুধুমাত্র বিশেষ অনুষ্ঠান যেমন সম্রাটের অভিষেক, রাজ পরিবারের বিয়ে ও বিশেষ দরবারের আয়োজন করা হতো। অন্যান্য হলগুলোতে নিয়মিত দরবার বসতো। যদিও তিনটি হলেই সিংহাসন ছিল তবে সবচেয়ে জমকালো সিংহাসন ছিল সুপ্রিম হারমোনি হলে।

সম্মুখ দরবারের দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মিলিটারি এমিনেন্স হল এবং লিটারারি গ্লোরি হল। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে প্রথমটিতে মন্ত্রী ও সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে দরবার বসতো। দ্বিতীয়টিতে রাজ্যের পণ্ডিত ব্যক্তিরা বক্তৃতা করতেন। এখানে রয়েছে যুবরাজের বসবাসের জন্য প্রাসাদ ও অন্যান্য প্রাসাদ। অন্দর দরবার ছিল মিং ও ছিং রাজবংশের সম্রাট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বাসস্থান। অন্দর দরবারের প্রাসাদগুলোর কারুকার্যে মুগ্ধ ও বিস্মিত দর্শকরা অনুভব করে চীনের সম্রাটদের অতুল ঐশ্বর্য ও শিল্পীদের অসাধারণ নৈপুণ্য।

অন্দর দরবারে রয়েছে ভাস্কর্য ও জলাশয়শোভিত বাগান। যা শিল্প, বিলাস ও সৌন্দর্যের অপূর্ব নিদর্শন। ফরবিডেন সিটি দেখার পর আমার মনে হয়েছিল পৃথিবীতে এত সুন্দর প্রাসাদও রয়েছে। পুরো এলাকাটা এত বড় যে একদিনে দেখা সম্ভব নয়। সারা দিন কাটিয়ে যখন বের হলাম তখন ঠাণ্ডায় হাত অবশ। মধ্যযুগের চীন থেকে ফিরে এলাম আধুনিক ব্যস্ত শহরের বুকে। সৌজন্যে : রাইজিংবিডি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *