Skip to content

নীলশয্যার দ্বীপ

:: আবুল হোসেন আসাদ ::

চারদিকে পানি আর পানি। গাঢ় নীল আকাশ এখানে পানি ছুঁয়েছে যেন। সাগরের নীল পানি আর আকাশের নীলের মিতালিতে, নীলে নীলে মিলেমিশে স্বপ্নিল এক দ্বীপ। সেন্ট মার্টিন।

চারদিকে সমুদ্র, তার মাঝে দ্বীপ। নির্জনতার মাঝে প্রবাল পাথর আর ধুয়ে যাওয়া বালুরাশির ওপর সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে শুভ্র ফেনা তুলে। কখনো ধীরে, কখনো জোরে বয়ে যায় সমুদ্র ছুয়ে আসা বাতাস। সে বাতাসের সাথে ভেসে আসে সমুদ্রের গর্জন। এ যে এক অন্যরকম অনুভুতি। দ্বীপে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছ আর কেয়ার বন দ্বীপটিকে করেছে মোহনীয়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে নীলের মাঝে এক চিলতে ফোটা, যেন সমুদ্রের কপালে একটি সবুজ টিপ। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ-বাংলাদেশের গর্ব। এটি একটি ডিপ সি আইল্যান্ড এবং প্রবাল দ্বীপ বা কোরাল আইল্যান্ড।

পৃথিবীতে হাতে গোনা যে কয়টি কোরাল আইল্যান্ড বা প্রবাল দ্বীপ রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন অন্যতম। বাংলাদেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের শেষে।

নামকরণ

সমুদ্রের মাঝে সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ড। টেকনাফ থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। আর কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে। ১৯৮৩ সালে এটিকে ইউনিয়ন পরিষদের মর্যাদা দেওয়া হয়। এখানে রয়েছে একটি পুলিশ ফাঁড়ি। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আরব বণিকরা এই দ্বীপে সাময়িক বিশ্রাম নিয়ে বার্মার আকিয়াব ও রেঙ্গুনে যাতায়াত করত। এই দ্বীপের নাম নারকেল জিঞ্জিরা হিসেবে বহুল পরিচিত। জাজিরা আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে দ্বীপ। একসময় এখানে প্রচুর নারিকেলগাছ ছিল, হয়তো এ জন্য নাম হয়েছিল নারিকেল জিঞ্জিরা। যতদূর জানা যায় ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বাঙালি ও রাখাইন ১৩টি মৎস্যজীবী পরিবার দ্বীপটির উত্তরদিকে বসতি স্থাপন করে। ধীরে ধীরে লোকজন বাড়তে থাকে। সময়ের পরিবর্তনে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারিকেল গাছের সংখ্যাও কমতে থাকে। তারপরও এখনো অনেক নারিকেলগাছ রয়েছে। সেন্ট মার্টিন নামের একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক এই দ্বীপে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। তার নামানুসারে এই দ্বীপের নাম হয়েছে সেন্ট মার্টিন। এ রকম একটি কথা জনশ্রুতি আছে। সেন্ট মার্টিন নামে দ্বীপটির বহুল প্রচলন হলেও মূলত নারকেল জিঞ্জিরা নামেই পুরাতন মানচিত্র, দলিল দস্তাবেজ ও সরকারি নথিতে উল্লেখ রয়েছে।

আয়তন এবং যেভোবে সৃষ্টি

কিছু কিছু ছোট বালিয়াড়ি দেখা গেলেও সেন্ট মার্টিনের ভূমি সাধারণত সমতল। দ্বীপের কোনো কোনো জায়গা ৭০০ মিটার প্রস্থ হলেও আবার ২০০ মিটারের প্রস্থতাও রয়েছে কোথাও কোথাও। অসংখ্য প্রবাল পাথর আর শিলা সেন্ট মার্টিনের দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে থরে থরে সাজানো। সেন্ট মার্টিনের যেদিকেই চোখ যায়, শুধু প্রবাল পাথর আর পাথর। প্রবাল একধরনের সামুদ্রিক প্রাণী। এই প্রাণীর দেহাবশেষই পাথরে রূপ নেয়। জীবিত প্রবালগুলো লালচে আকৃতির এবং এদের অসংখ্য ছিদ্রগুলোর মধ্যে রোমকূপগুলো নাড়াতে থাকে। খালি হাতে ধরলে এই রোমকূপগুলো স্পর্শিত হয়। সেন্ট মার্টিনের বেলাভূমিতে সমুদ্র থেকে ভেসে আসা প্রচুর প্রবাল জমা হয়ে পাথরে রূপ নিয়েছে। কোটি কোটি প্রবাল একত্রিত হয়ে বছরের পর বছর ধরে চুনাপাথর, বালি ও শামুক-ঝিনুকসহ সামুদ্রিক প্রাণীর চূর্ণবিচূর্ণ অংশের সঙ্গে একত্রিত হয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সৃষ্টি করেছে।

যেভাবে যাবেন

সেন্ট মার্টিন যাওয়ার জাহাজ ছাড়ে টেকনাফের দমদমিয়া জেটি ঘাট থেকে। তাই সেন্ট মার্টিন যেতে হলে অবশ্যই যেতে হবে টেকনাফ। কক্সবাজার থেকেও সেন্ট মার্টিন যাওয়া যায়। তবে সে ক্ষেত্রে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে হবে। কক্সবাজারের বিভিন্ন হোটেলে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার জাহাজের টিকেটও পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাহাজের টিকেট কাউন্টার রয়েছে কক্সবাজারে।

রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফ যাওয়ার জন্য রয়েছে এসি ও নন এসি দুই ধরনের বাস। অধিকাংশ বাস মতিঝিলের আরামবাগ থেকে টেকনাফের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। হানিফের বাস ছাড়ে সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে কলাবাগান থেকে, ভাড়া ৯০০ টাকা। হানিফের টেকনাফ যাওয়ার এসি বাস নাই। গ্রীন লাইনের এসি বাস ভাড়া ১৭০০ টাকা, ছাড়ে রাত ৮টার সময় রাজারবাগ গ্রীনলাইন ডিপো থেকে। সৌদিয়া পরিবহনের নন এসি বাস ছাড়ে সন্ধ্যা ৭টায় ফকিরাপুল থেকে, নন এসির ভাড়া ৯০০ টাকা। সন্ধ্যা ৭টার সময় ছাড়ে শ্যামলী পরিবহনের বাস, ভাড়া ৯০০ টাকা আর এসি বাসের ভাড়া ১৪০০ টাকা, এসি বাস ছাড়ে ৭টা ৩০ মিনিটে। রয়েল কোচ এসি বাস ছাড়ে ৮টা ৩০ মিনিটে আরামবাগ থেকে ভাড়া ১৬০০ টাকা। ডিল্যাক্স-এর ভাড়া ১৭০০ টাকা। রয়েলের কাউন্টার রয়েছে আরামবাগ ও কলাবাগানে। বাগদাদ এক্সপ্রেস ছাড়ে রাত ৮টার সময় ভাড়া ১৫০০ টাকা। সেন্ট মার্টিন পরিবহন ছাড়ে আরামবাগ থেকে ভাড়া ১৭৫০ টাকা, ছাড়ে রাত ৮টা ৩০ মিনিটে। গ্রীন সেন্ট মার্টিন এক্সপ্রেস এসি বাস ছাড়ে ৯টায় কলাবাগান থেকে, ভাড়া ১৬০০ টাকা। আরামবাগে রয়েছে সেন্ট মার্টিন ট্রাভেলস। এসি বাসের ভাড়া ১৭৫০। সব বাসই পৌঁছায় সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে।

ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার যাওয়ার জন্য রয়েছে অনেক এসি ও নন এসি বাস। সেই সঙ্গে রয়েছে বিমান। ঢাকা থেকে কক্সবাজারে নিয়মিত যাতায়াত করে ইউএসবাংলা, নভোএয়ার ও বাংলাদেশ বিমান। বিমানে সময় অনেক কম লাগে। বিমান আসা-যাওয়ার ভাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হয়। সাধারণত এই তারতম্য থাকে ৮০০০ থেকে ১১,৫০০ টাকার মধ্যে থাকে। বাসের টিকেট আগে টেলিফোনে বুকিং দেওয়া যেত। এখন সহজ ডট কম এবং অন্যান্য সাইটের মাধ্যমে টিকেট কেনা যায়। বিকাশ, রকেট ও বিভিন্ন ব্যাংকের মোবাইল ব্যাকিং-এর মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করার পদ্ধতি সহজতর হওয়ায় অনায়াসেই ঘরে বসে অনলাইনে টিকেট কাটা যায় ও আসন পছন্দ করা যায়।

জাহাজে করে যাত্রা

দমদমিয়া জেটি ঘাট থেকে জাহাজে উঠতে হয়। জাহাজ ছাড়ে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে। সেন্ট মার্টিন পৌঁছায় দুপুর ১২টার সময়। সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফের উদ্দেশ্য জাহাজ ছাড়ে বিকেল ৩টার সময়। সকালে সেন্ট মার্টিন গিয়ে দুই ঘণ্টা ঘুরেফিরে বেড়িয়ে বিকেলে চলে আসা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে ভ্রমণটা তেমন একটা মজার হয় না বা তেমন কিছু ঘুরে দেখাও হয় না। শুধু আফসোস থেকে যায়। সেন্ট মার্টিনে দুই একদিন না থাকলে কিংবা পুরো সেন্ট মার্টিন ঘুরেফিরে না দেখলে অথবা ছেঁড়াদ্বীপে বেড়াতে না গেলে সেন্ট মার্টিন সম্পর্কে পুরো ধারণা পাওয়া যাবে না।

নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি প্রতিদিন সকাল বেলায় জাহাজ ছাড়ে। অফ সিজন অর্থাৎ এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত জাহাজ চলাচল করে না। এ সময় শাহ পরীর দ্বীপ কিংবা টেকনাফ ট্রলার ঘাট থেকে ট্রলার সেন্ট মার্টিনে যাওয়া-আসা করে।

এলসিটি কুতুবদিয়া কিছুটা বড় আকারের জাহাজ। দমদমিয়া জেটি ঘাট থেকে জাহাজটি ছাড়ে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে আর সেন্ট মার্টিন থেকে ছাড়ে বিকেল ৩টার সময়। কুতুবদিয়া জাহাজের টিকেট পাওয়া যাবে ঢাকা অফিসে। ঢাকা অফিসের ঠিকানা ৫৫ বি পুরানা পল্টন নোয়াখালী টাওয়ারের ১৪ তলায়। হোটেল গ্র্যান্ড আজাদের পাশের বিল্ডিং।

জাহাজের ভাড়া ইকোনমি ৫৫০, ওপেন ডেক ৭০,০ রয়েল এসি ৯০০, লাক্সারি এসি ১২০০ টাকা (আসা-যাওয়া ও জেটি ট্যাক্সসহ সবকিছু মিলিয়ে একত্রে)।

কক্সবাজারের কলাতলীতে হোটেল লং বিচের সামনে আছে কুতুবদিয়া জাহাজ অফিস। এখানেই আছে টিকেট কাউন্টার। টেকনাফের দমদমিয়া বিজিবি চেকপোস্টের সঙ্গে রয়েছে এলসিটি কুতুবদিয়ার জাহাজ ঘাট। আর এখানেই রয়েছে টিকেট কাউন্টার। সেন্ট মার্টিনের টিকেট কাউন্টার রয়েছে আটলান্টিক লাবিবা রিসোর্টে। কেয়ারি সিন্দাবাদের আসা ও যাওয়ার ভাড়া, জেটি ট্যাক্সসহ সবকিছু মিলিয়ে একত্রে মেইন ডেক ৫৫০ টাকা, ওপেন ডেক ৭০০ টাকা, ব্রিজ ৮০০ টাকা।

জাহাজের টিকেট পাওয়া যাবে ঢাকার ধানমণ্ডির ৮৩ সাতমসজিদ রোড ৮/১ ধানমণ্ডির কেয়ারি প্লাজায়। ধানমণ্ডি ৮ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের সঙ্গেই কেয়ারি প্লাজা।

কেয়ারি সিন্দাবাদ জাহাজ ছাড়ে দমদমিয়া থেকে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে আর সেন্ট মার্টিন থেকে ছাড়ে বিকেল ৩টার সময়। দমদমিয়া ঘাট : টিকেট পাওয়া যাবে টেকনাফের দমদমিয়া ঘাটে। কক্সবাজারের কলাতলী রোডে উর্মি গেস্টহাউসে কেয়ারি সিন্দাবাদের টিকেট কাউন্টার রয়েছে। কেয়ারি ক্রুজ-এর এসি ভাড়া ১০০০, ১৪০০ টাকা। জাহাজ ছাড়ে দমদমিয়া ঘাট থেকে, একই সময় কেয়ারি সিন্দাবাদের সঙ্গেই।

এমভি গ্রীনলাইন দ্রুতগতির জাহাজ এবং শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। এর নিচের তলার আসন বা ইকোনমি ক্লাসের ভাড়া ৬৫০ টাকা এবং ওপরের তলার আসন বা বিজনেস ক্লাসের ভাড়া ৮০০ টাকা। টেকনাফ থেকে ছাড়ে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে আর সেন্ট মার্টিন থেকে ছেড়ে আসে বিকেল ৩টার সময়। টিকেট পাওয়া যায় গ্রীনলাইন পরিবহনের সব কাউন্টারে। গ্রীনলাইনের পরিবহনে ১৭০০ টাকার টিকেটে টেকনাফের সঙ্গে জাহাজ ভাড়া একত্র করে প্যাকেজও রয়েছে।

এলসিটি কুতুবদিয়া, কেয়ারি সিন্দবাদ, কেয়ারি ক্রুজ এন্ড ডাইন, গ্রীনলাইনের জাহাজগুলো টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনের দিকে যায় বঙ্গোপসাগরের ছোট-বড় ঢেউ পেরিয়ে। জাহাজ থেকে সেন্ট মার্টিনে নামার পরই দেখা যায় বাজার। এই বাজারটি সেন্ট মার্টিনের প্রাণকেন্দ্র। এর পাশেই রয়েছে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। ট্রলার থেকে মাছ এনে এখানে নামানো হয়। ভ্যানগুলো দাঁড়িয়ে থাকে জেটির সঙ্গে লাগোয়া বাজারে পর্যটকদের অপেক্ষায়। গদিযুক্ত এবং মাথার ওপর ছাদ দেওয়া ভ্যানগুলো যায় সেন্ট মার্টিনের পাকা রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান পর্যন্ত। ইউনিয়ন পরিষদের সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো রাস্তার আোপর দিয়ে প্রকৃতি, ঘরবাড়ি, গাছপালা দেখতে দেখতে এগিয়ে চলতে বেশ ভালোই লাগে। কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন বেড়াতে গেলে কক্সবাজারের হোটেল থেকেই সেন্ট মার্টিন প্যাকেজ পাওয়া যায়। শুধু একটু বললেই চলে। পুরো প্যাকেজ না নিয়ে ইচ্ছে করলে ওদের কাছ থেকে শুধু যাতায়াত সুবিধা নেওয়া যেতে পারে। তাহলে আর সাতসকালে টেকনাফে যাওয়ার জন্য বাস বা মাইক্রো বাস, জিপ অর্থাৎ চান্দের গাড়ির জন্য টেনশন করতে হবে না।

কক্সবাজার থেকে টেকনাফ আসা-যাওয়া এবং জাহাজের রিটার্ন টিকেট অর্থাৎ সেন্ট মার্টিন আসা ও যাওয়ার টিকেট এর খরচ পড়বে ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা তবে জাহাজের মান অনুসারে ভাড়া বাড়ে বা কমে।

প্রস্তুতি

টেকনাফে আসা-যাওয়ার টিকেট কনফার্ম করতে হবে। তারপর জাহাজে সেন্ট মার্টিন যাওয়া ও আসার টিকেট কনফার্ম করা এবং সেন্ট মার্টিনের হোটেলের রুম বুক করা এই তিনটি করতে পারলে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা যায়।

খাবারদাবার

দ্বীপের খাবার দাবার বেশ ভালো। রিসোর্ট ও হোটেলগুলোতে খাবার-দাবারের চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া জেটি ঘাটের কাছে যে বাজার রয়েছে সে বাজারে অনেকগুলো খাবার হোটেলও রয়েছে। হোটেলে মাছ, মাংস থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবারই পাওয়া যায়। সেন্ট মার্টিনের খাবারের বিশেষত্ব হলো বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ। সুরমা, ব্লাক চান্দা, গোল্ড চান্দা, রূপচান্দা, ফ্লাইং ফিশ, পোয়া, সুন্দরী, কোরাল, রূপচান্দা, লবস্টারসহ বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ সেন্ট মার্টিনে পাওয়া যায়। সামুদ্রিক এসব মাছ খেতে বেশ সুস্বাদু। রিসোর্টেগুলোতে হ্যামক থাকে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। কোনো কোনো রিসোর্টে দুই কেয়াগাছের মাঝেও হ্যামক বাঁধা থাকে। সমুদ্রের প্রাণজুড়ানো হিমেল বাতাস বয়ে যায় দ্বীপের বুক ঘেঁষে। এ সময় হ্যামকের দোল দোল দুলুনিতে কিছুটা বিশ্রাম না নিলেই নয়। রাতের বেলায় সামুদ্রিক মাছ দিয়ে বারবিকিউ করা কিংবা ক্যাম্পফায়ার করা কারো কারো কাছে তো বাড়তি আনন্দ। তাঁবু নিয়েও সেন্ট মার্টিনে রাত্রিযাপন করা যায়। ইচ্ছে করলে নিজেরাও রান্নাবান্না করে খাওয়া যায়।

থাকবেন কোথায়

সেন্ট মার্টিনে রয়েছে থাকার জন্য অনেক হোটেল, মোটেল এবং বিচ লাগোয়া রিসোর্ট। ছুটির বিশেষ দিনগুলোতে সেন্ট মার্টিনে ভিড় একটু বেশি হয় তাই এসব দিনে সেন্ট মার্টিনে আসার আগে হোটেল বা রিসোর্ট বুক করে আসা উচিত।

লাবিবা বিলাস, প্রাসাদ প্যারাডাইস, অবকাশ, সমুদ্র বিলাস, নিল দিগন্তে, সীমানা পেরিয়ে, সিভিউ, বিচ ভিউ, কোরাল ভিউ রিসোর্ট, ব্লু লেগুন, ব্লুমেরিন, পান্না রিসোর্ট, ড্রিম নাইট, সমুদ্র কানন, হোটেল সি ইন ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য হোটেল ও রিসোর্ট।

বছরের কয়েক মাস ট্যুরিস্ট সিজন থাকে সেন্ট মার্টিনে। তাই ট্যুরিস্ট সিজনের টাকা দিয়ে সারা বছর চলে বলে হোটেল ভাড়া, খাবারদাবার সবকিছুই একটু দাম বেশি সেন্ট মার্টিনে। হোটেলের ভাড়া কম-বেশি হয় থাকে রুমের ধরন ও মান অনুযায়ী।

সি স্যান্ড সেন্ট মার্টিনে কাপল বেডের ভাড়া ২০০০-২৫০০ টাকা , ডাবল বেডের ভাড়া-২৫০০-৩০০০ টাকা, ত্রিপল বেড ২০০০-২৮০০ টাকা, নাশতাসহ ছেঁড়া দ্বীপ গাইড। হ্যামক আছে। পূর্ব পাশে জেটির কাছাকাছি। নীল দিগন্তে ডাবল বেড প্রতিটি রুমে চারজন করে সবচেয়ে ভালো রুমের দাম ৪৫০০ টাকা, এরপর মান অনুসারে ৩৫০০, ৩০০০, ২৫০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া। রাতে বারবিকিউর ব্যবস্থা আছে। সেন্ট মার্টিনে সাইফুল থাকে রিজার্ভেশনে। ঢাকার বাংলামোটরের ঢালে নীল দিগন্তের অফিস থেকেও বুকিং করা যায়। সায়ারি ইকো রিসোর্ট সেন্টারে সোলার লাইট সুবিধা আছে। চার ধরনের রুম রয়েছে। কটেজ ৩০০০ টাকা। চারজন থাকতে পারবেন। কাপল রুম ১৮০০ টাকা, টুইন ডাবল একটি ভেতরের দিকে ২২০০ টাকা।

ব্লু লেগুন রিসোর্টে হোটেল অবকাশের পাশ দিয়ে পাঁচ মিনিট হাঁটলে দেখা যাবে ব্লু লেগুন রিসোর্ট। এই রিসোর্ট থেকে সূর্য অস্ত যাবার মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। সেন্টমার্টিন দ্বীপের পশ্চিম বিচে ব্লু লেগুন রিসোর্ট। সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থাও রয়েছে এই রিসোর্টটিতে। সীমানা পেরিয়ে ইটের তৈরি কটেজ রুম ২০০০ টাকা, উডেন কটেজ ২৫০০, ব্যাম্বো কটেজ ২৭০০। পশ্চিম বিচে রয়েছে লাবিবা বিলাস। বর্তমানে লাবিবা বিলাস আটলান্টিক লাবিবা বিলাস। লাবিবা বিলাসে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের রুম। সুপার ডিডাক্স ১২ হাজার টাকা। ডিলাক্স ১০ হাজার টাকা। এসি রুম কাপল আট হাজার টাকা। নন-এসি ছয় বেড ৬০০০ টাকা, ৪ বেড ৪০০০ টাকা, ৩ বেড ৩০০০ টাকা, কাপল নন এসি ৩৫০০ টাকা। লাবিবা বিলাস এলসিটি কুতুবদিয়া জাহাজের একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রাসাদ প্যারাডাইসে কাপল বেড ভাড়া ৩০০০ টাকা রেগুলার বেড একটি কাপল বেড ও একটি সিঙ্গেল বেড ৩৫০০ টাকা, ডাবল রুম এটি ডাবল বেড ও একটি সিঙ্গেল বেড তিনজন থাকা যাবে ভাড়া ৩৫০০ টাকা। অবকাশের ভাড়া ১৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা বিভিন্ন শ্রেণিভেদে।

নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকে তাই এ সময়টি সেন্ট মার্টিনে বেড়ানো উপযুক্ত সময়। বর্ষাকালে এই দ্বীপে যাওয়া যথেষ্ট নিরাপদ নয়। টর্চ, মোমবাতি, সমুদ্রস্নানের কাপড়চোপড়, গ্রিপওয়ালা শ্লিপার, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও দরকারি সব জিনিসপত্র নিয়েই তবে সেন্ট মার্টিনে যাওয়া উচিত। বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই সেন্ট মার্টিনে। ডিজেলচালিত জেনারেটর চলে এখানে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত। নিরাপত্তার কোনো সমস্যা নেই সেন্ট মার্টিনে। স্থানীয় জনগণ খুবই আন্তরিক এবং একটি পুলিশ ফাঁড়িও রয়েছে সেন্ট মার্টিনে। রাত ১২টার পর অন্ধকার ও সুনসান নীরবতা গ্রাস করে এই দ্বীপটিতে। সমুদ্রের গর্জন, শীতল হাওয়ার মায়াবী পরশে আর রাতে ধেয়ে আসা সমুদ্রের ঢেউ দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে মোহনীয়তায় হ্যামকে দোল খেতে খেতে।

যেখানে ঘুরবেন

পশ্চিম বিচ, ছেঁড়া দ্বীপ, প্রবাল পাথরে ঘুরে বেড়ানো কিংবা দারুচিনি দ্বীপে গিয়ে কিছুটা সময় কাটানো ভিন্ন এক আনন্দ-অনুভূতি। সারা দ্বীপ ঘুরে বেড়ানো, সেন্ট মার্টিনের স্বচ্ছ নীল পানিতে সাঁতরে বেড়ানো, কিংবা স্কুভা ডাইভিং অ্যাডভেঞ্চারে মন তৃপ্ত করে। বিচের পাশ ঘেঁষে সাইকেল চালানোও কম আনন্দের নয়। দ্বীপের ভেতরের সৌন্দর্যও নান্দনিক। কেয়া বনের ভেতর দিয়ে দ্বীপের ভেতরের দিকে প্রবেশ করলে দেখা যায় দ্বীপের ভেতরের অংশ। গাছগাছালির পাতার ফাঁক দিয়ে চলে মনোলোভা প্রকৃতির স্পর্শ। সেন্ট মার্টিনের স্বচ্ছ পানিতে বিচের অল্প দূরত্বের ঢেউয়ে এই পানির তলায় লুকিয়ে থাকা বালুর স্তরও দেখা যায়। কেয়া বন আর নারিকেলগাছের ফাঁকে ফাঁকে তপ্ত রোদে গরম বালুর পরশ। দ্বীপের মানুষের জীবনধারাও মনে দাগ কাটে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। অনেকটা ডাম্বেল আকৃতির। গলাচিপা, জিঞ্জিরা বা উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া, ছেঁড়াদিয়া ও দারুচিনি নামে দ্বীপের কয়েকটি অংশে রয়েছে। উত্তর অংশ উত্তরপাড়া নামে পরিচিত এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ২১৩৮ মিটার। দক্ষিণ দিকের অংশের নাম দক্ষিণপাড়া। এটি ১৯২৯ মিটার দীর্ঘ। উত্তর ও দক্ষিণপাড়াকে একটি সরু এলাকা যুক্ত করেছে। এই এলাকাটি মধ্যপাড়া নামে পরিচিত। মধ্যপাড়ায়- দ্বীপটি মাঝামাঝি এক জায়গাতে এসে সরু হয়ে গিয়েছে। মনে হতে পারে এই জায়গাটিকে কেউ গলা টিপে ধরে রেখেছে। সরু এই জায়গাটির নাম গলাচিপা। এর সরু অংশের দুদিকেই রয়েছে বিচ ও সমুদ্র। উত্তরপাড়া ও দক্ষিণপাড়ার মাঝামাঝিতে মিঠাপানির ছোট জলাশয় রয়েছে। দ্বীপের মধ্য ও দক্ষিণপাড়ার জমিতে কৃষিকাজ হয়ে থাকে। ছোট ছোট ক্ষেত। তাতে লোকজন চাষবাস করছে। তাতে বিভিন্ন ধরনের শষ্য ফলেছে। উৎপাদিত ফসলের মধ্যে মরিচ, পেঁয়াজ, টমেটো, তরমুজ, ধান ও বিভিন্ন শাকসবজি উল্লেখযোগ্য, যা উৎপাদিত হয় তা দ্বীপবাসীর জন্য যথেষ্ট নয়। ক্ষেতের বেড়া দেওয়া হয়েছে মাছ ধরার ছেঁড়া জাল দিয়ে। নারিকেলসহ বিভিন্ন ধরনের গাছপালা দ্বীপটিতে সবুজের সমারোহের সৃষ্টি করেছে। দ্বীপের মাঝ দিয়ে মাঝারি প্রস্থের একটি মাটির রাস্তা। রাস্তার বেশির ভাগটাই বালুতে ঢাকা।

গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে একটু দূরে দূরে রয়েছে ঘরবাড়ি। গবাদি পশুরা বিচরণ করছে আপনমনে। সেন্ট মার্টিনের বুকে বিভিন্ন ধরনের পাখি ওড়াউড়ি করছে। এই দ্বীপের মাটির কয়েক ফুট নিচে গর্ত করলেই পাওয়া যায় মিঠাপানি। যেখানে সেখানে রয়েছে কেয়ার ছোট ছোট বন। ঘাস, বুনো ফুল। সবই যেন ছবির মতো সুন্দর। গোটা সেন্ট মার্টিনই অপরূপা। সেন্ট মার্টিনের অধিকাংশ অধিবাসীই জীবিকা নির্বাহ করে সমুদ্রে মাছ ধরে কিংবা মাছ শুকিয়ে শুঁটকি করে। এই শুঁটকি মাছ সেন্ট মার্টিন আসা ভ্রমণকারীদের কাছে প্রিয়। সাগর থেকে ধরে আনা মাছ হোটেল ব্যবসায়ী ও ভ্রমণকারীরা কিনে নিয়ে নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটায়। কিছু লোক দোকানদারি ও কৃষিকাজ করে। কেউ কেউ ডাব, নারিকেল কিংবা ঝিনুকের ব্যবসা করে। ছোট ছোট শিশুরা সমুদ্র থেকে তুলে আনা রংবেরঙের প্রবাল পর্যটকদের কাছে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। ২০০৬ সালের গণনা অনুযায়ী, দ্বীপের লোকসংখ্যা ছিল ৭০০০ জন।

আর প্রতি বর্গকিলোমিটারে লোকসংখ্যার ঘনত্ব ছিল ৮৭৫ জন। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে সেন্ট মার্টিন বেশ দূরে এবং উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নত সুবিধা না থাকায় দ্বীপের লোকজনের বর্ষাকালে কিংবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দুর্ভোগের সীমা থাকে না। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সকাল থেকে সন্ধ্যা পায়ে হেঁটে পুরোটাই ঘুরে দেখা সম্ভব। দ্বীপের প্রবাল যেভাবে উত্তোলিত হচ্ছে এবং ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, তাতে দ্বীপটি একসময়ে হারিয়ে যাবে কালের গর্ভে। তাই যাঁরা সেন্ট মার্টিন বেড়াতে যাবেন, কখনোই তাঁরা প্রবাল আনবেন না কিংবা প্রবাল কিনবেন না।

পশ্চিম বিচ সবচেয়ে আকর্ষণীয়। প্রবালের পাথুরে চাতালে, হালকা চড়াই, উতরাইয়ের মাঝ দিয়ে সাগরের অল্প পানিতে এই দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রের পানি অনেক স্বচ্ছ ও টলটলে। পানি পরিষ্কার থাকার কারণে সমুদ্রের পানির নিচে থাকা প্রবাল, শৈবাল এবং ছোট ছোট বাহারি মাছগুলো দেখা যায়। সেন্ট মার্টিনের একবারে সর্বদক্ষিণ প্রান্তে আছে ছেঁড়া দ্বীপ বা ছেঁড়াদিয়া। মূল সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি এঁকেবেঁকে, কখনো কৌণিক চমৎকার আকৃতি নিয়ে লম্বালম্বিভাবে উত্তর থেকে দক্ষিণে গিয়েছে, কী সুন্দর গাছপালা। নারিকেলগাছ সারি সারি। সমুদ্রের কিনার ঘেঁষে বালুর ওপর সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছে। কেয়াগাছে ধরে আছে ফল। ফলগুলো দেখতে আনারসের মতো।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সমুদ্রপাড়ের মনোরম দৃশ্যের কথা না-ই বা বললাম। পাশ ঘেঁষে সমুদ্র চমৎকার ভঙ্গিতে বেঁকে গিয়েছে মাঝসমুদ্রের গভীরতার দিকে। বালুর বিচের পর পাথুরে বিচ। সমুদ্রের ঢেউয়ের ছান্দসিক গর্জন। শো শো বাতাস । বাহারি রঙের ছোট ছোট শামুক, ঝিনুক, পাথর কণা, রঙিন পাথর, সেই সঙ্গে সঙ্গে ঝরঝরে বালু। এই রকম বালুময় পথ ধরে প্রবাল পাথর আর পাথর রাজির ওপর দিয়ে রোমান্স, ভয় ও উচ্ছ্বাসে হেঁটে যেতে কার না ভালো লাগে! প্রবাল পাথরের পর পাথর যেন প্রাচীর দেওয়া । মাটির সোদা গন্ধ। অবশ্য পিপাসা মেটাবার জন্য ছাউনি দেওয়া খোলা দোকানে নারিকেল জিঞ্জিরার নারিকেল অপেক্ষা করে থাকে। সেই সঙ্গে কচি ডাবের মিষ্টি পানি তো আছেই। সেজন্যে : এনটিভি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *