শিহাব শাহরিয়ার
বাঙালিদের কাছে ‘সুবর্ণভূমি’ শব্দটি বা নামটি নিশ্চয়ই খুবই চমৎকার; অন্তত আমার কাছে। মনে হবে এটি বাংলাদেশেরই কোনো স্থানের নাম। কিন্তু আমার মত হয়ত অনেকে ভুল করতে পারেন যে, সাদা হাতির দেশ থাইল্যান্ডের বিমানবন্দরের নাম সুবর্ণভূমি। আগে জানতাম না। যখন ঢাকা থেকে থাই এয়ারওয়েজে ব্যাংকক বিমানবন্দরে নামছি, তখনই দেখলাম সুবর্ণভূমির সৌন্দর্য। দুপুরের রোদে ঝলমল করছে বিমানবন্দরটি। সারি সারি বিমান দাঁড়িয়ে আছে, আকাশ থেকে নামছে, কোনো কোনোটি উড়ছে। আমরা অবতরণ করতে করতেই এ দৃশ্য দেখছি। ভালো তো লাগছেই!
SAARC Cultural Centre এর উদ্যোগে আয়োজিত Saered Heritage বিষয়ক চার দিনব্যাপী সিম্পোজিয়ামে যোগ দিতে ব্যাংকক হয়ে শ্রীলঙ্কা যাচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে আমার সঙ্গী মনিরুল হক। মনির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে পাস করে বেশ কিছুদিন ইরানে দোভাষীর কাজ করেছে। ও বেশ রসিক এবং এনারজেটিক। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সে আমারই সহকর্মী। মনির বলল, বাহ্ দারুণ!
আমরা যাবার মাসখানেক আগে চালু হয়েছে ঢাকা-কলম্বো বিমান ‘মিহিন লঙ্কা’। এই বিমানে কলম্বো যেতে মাত্র তিন ঘণ্টা সময় লাগে। আমরা বিমানটির সিডিউল পাইনি। পেলে ট্রানজিটের ঝামেলায় পড়তাম না। ট্রানজিট-টাইম সব সময়ই বিরক্তিকর। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান যাবার সময় এই ট্রানজিট টাইম আমার কাছে বিরক্তি লেগেছে। সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরেও একই ঘটনা ঘটল। কলম্বোগামী ফিরতি বিমানের জন্য প্রায় ছয় ঘণ্টা বসে থাকলাম। ইউ আকারের পর্যাপ্ত ডে-লাইটে ভরা বিমানবন্দরটি বেশ পরিচ্ছন্ন। হিথরো, জেএফকে, নারিতা, হংকং, ওমান, কাতার, বাহরাইন বিমানবন্দর দেখার পর সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরটিও আমার কাছে ভালো লেগেছে। বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন বিমানে শত শত যাত্রী আসছে আর যাচ্ছে। নানা প্রকৃতির, নানা রঙের, নানা বর্ণের, নানা ভাষার মানুষ দেখার এক চমৎকার জায়গা হলো এসব বিমানবন্দর। মানুষ দেখতে দেখতে মনে পড়ছে বাংলাদেশের মানুষের কথা। শ্যাম দেশের মানুষেরা এখনও আধুনিকতা থেকে অনেকটা পিছিয়ে। অথচ সে দেশেরই একটা বিমানবন্দর কতটা নান্দনিক। আমাদের একটি অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর নেই? থাকলে দেশের অনেক আয় হতো।
বিমানবন্দরের ভিতরে মনির অনেকগুলো ছবি তুলল। আমি যাত্রীদের জন্য রাখা কম্পিউটারে ইন্টারনেট টিপে টিপে কিছুটা সময় কাটালাম। তারপর কলম্বোগামী বিমানে উঠে গভীর রাতে বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরে নামলাম। সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরের মত ততটা আকষর্ণীয় নয় এটি। মূল শহর থেকে বিমানবন্দরটি মোটামুটি দূরে। আমাদের যারা রিসিভ করতে এসেছিল, পরের ফ্লাইটে আসার কারণে তারা চলে গেছে। এ সময় আমি কিছুটা চিন্তিত হলেও, মনির নার্ভাস হলো না। যে হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, সেই ঠিকানা বের করে আমরা ট্যাক্সি ভাড়া করতে গেলাম। এয়ারপোর্টের ভিতরেই গাড়ি ভাড়া করার ব্যবস্থা রয়েছে। কথা বলতে বলতেই পরিচয় হলো মি. রোহানের সাথে। যিনি আশির দশকে শ্রীলঙ্কা থেকে পাকির আলির সঙ্গে এসে বাংলাদেশের আবাহনীতে ফুটবল খেলে গেছেন। রোহান এক সময় সেনাবাহিনীতেও ছিলেন। এখনও শারীরিকভাবে অনেক স্মার্ট দেখলাম তাকে। তিনি বেশ আন্তরিকতা দেখিয়ে আমাদের ট্যাক্সি ঠিক করে দিলেন। মধ্যবয়সী ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ভদ্রই মনে হলো। আমরা চললাম হোটেলের উদ্দেশে।
রাতের কলম্বো যেন রাতের ঢাকা। কোনও কোনও জায়গা আবার মনে হলো বাংলাদেশের রাতের কোনো জেলা শহর। রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে পুলিশি চেকপোস্ট। আমাদের ভাড়া করা ট্যাক্সিক্যাবের চালককেও কয়েকবার পুলিশ জিজ্ঞেস করে তথ্য নিলো এবং এক জায়গায় তাদের চালকের কাছ থেকে টাকাও নিতে দেখা গেল। প্রায় দুই ঘণ্টা পর জানাকি হোটেল খুঁজে পেলাম। থ্রি স্টার হোটেলের বিশাল কামরা। সকালেই সেখানকার ফাইন আর্টস গ্যালারিতে সিম্পোজিয়ামের উদ্বোধন হবে বলে আমরা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালের সূর্যালোকে গাড়িতে করে যে পথেই যাচ্ছি- দেখছি, সবুজ বৃক্ষেঘেরা ছিমছাম কলম্বো শহর। হাইরাইজ বিল্ডিং তেমন চোখে পড়ছে না। ভারত, ভুটান ও বাংলাদেশ থেকে আমরা যে অতিথিরা রয়েছি, আমাদের গাইড করছে যে শ্রীলঙ্কান তার নাম মি. রাসমী। তিনি সার্ক কালচারাল সেন্টারে কর্মরত রয়েছেন। তিনিই বিভিন্ন জায়গা চেনাচ্ছেন। তার মুখ থেকেই শুনলাম সে দেশের সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানসমূহ- কলম্বো শহরে গলফেইস, রত্নাপুরা, নিগাম্বু, কেন্ডি, অনুরাধাপুরের মৃত নগরী, সিগিরিয়া ইত্যাদি। সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি রাম-সীতা আর রাবণের কাহিনি। যাদের অবস্থান ছিল এই শ্রীলঙ্কায়। এখানে হযরত আদম, বুদ্ধ ও শিবের জন্য স্মরণীয় স্থান। লেখক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘কলম্বোর কাছেই রত্নপুরা। রত্নপুরাতে আছে রত্নগিরি বা রত্নের পাহাড়। … এই রত্নগিরিই বিখ্যাত আদম’স পিক। … আদম’স পিক সম্পর্কে কিছু বলা যাক। সাত হাজার তিন শ’ আটান্ন ফুট উঁচু পাহাড়। এর চূড়ায় একটি পদচিহ্ন। মুসলমানরা দাবি করেন এই পদচিহ্ন হযরত আদমের। বেহশত থেকে নির্বাসিত হয়ে তিনি এসেছেন শ্রীলঙ্কায়। খ্রিস্টানদেরও এই দাবি। তাদের মতে শ্রীলঙ্কাই হলো স্বর্গভূমি। খ্রিস্টানদের একটি দল অবশ্য বলে এটি সেইন্ট পিটারের পায়ের ছাপ। বৌদ্ধদের দাবি এটি গৌতম বুদ্ধের বাঁ পায়ের ছাপ। তিনি পৃথিবী থেকে শেষবারের মতো চলে যাওয়ার সময় বাঁ পা রাখেন এখানে, ডান পা রাখেন ব্যাংককের সারাবুড়ি প্রদেশে। সেখানে পাথরের ওপর ডান পায়ের একটি ছাপ আছে। হিন্দুদের দাবি এই পায়ের ছাপ শিবের। পাহাড়ের নিচে একটি শিবমন্দিরও আছে। প্রধান ধর্মগুলির মধ্যে ইহুদি ছাড়া বাকি সবাই পদচিহ্নের দাবিদার। ইহুদিরা যদি বলত এটি মোসেসের (মুসা আলায়েস সালাম) পায়ের ছাপ, তাহলে সর্বকলা সম্পন্ন হতো। আমার নিজের ধারণা, এটা কোনো মানুষের পায়ের ছাপই না। প্রাকৃতিক কারণে শিলা ক্ষয়ে পায়ের পাতার আকৃতি নিয়েছে। কিংবা মানুষই পাথর খুদে এই জিনিস বানিয়েছে।’ এই বিশ্বাসের উপর সব ধর্মানুসারীরাই চলেছেন। তবে কোনো বিরোধ তো নেই। তর্কে বহু দূর- আমরা আপতত সেই দূরের পথ মাড়াবো না।
রাস্তার পাশেই ফাইন আর্টস গ্যালারি। গ্যালারির সামনে ফুল-সজ্জিত বাগান। রাস্তার অপর পার্শ্বে ছোট ছোট স্টল সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা, যাতে শোভা পাচ্ছে সে দেশের লোকশিল্পকর্মের নানা উপাদান। আমাদের গাড়ি থামল। নেমেই সিম্পোজিয়ামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিলাম। শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী বাদকদলের বাজনা ও মোমবাতির প্রজ্জ্বলনে উদ্বোধন হলো তিন দিনের সিম্পোজিয়াম। সার্ক কালচারাল সেন্টারের কর্তা ব্যক্তি সকলেই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে পরিচয় হলো বাংলাদেশ মিশনের কনসুলার অফিসার মীর আকরামের সঙ্গে। তিনি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পর্বের প্রতিনিধিত্ব করলেন। উদ্বোধন পর্বের পর আকরাম আমাদের দু’জনকে তার বাসায় একদিন যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা বাংলাদেশ স্টলকে সাজালাম ঐতিহ্যের অংশ কয়েকটি বই এবং ভাস্কর্য ও অলংকরণ নিদর্শনের ফটোচিত্র দিয়ে। এরপর শুরু হলো মূল সেমিনার। আর্টস গ্যালারির ভেতরে আমরা বাংলাদেশ পর্বে প্রবন্ধ পাওয়ার পয়েন্টে উপস্থাপন করলাম। প্রবন্ধের উপর আলোচনা হলো। বিকেলে আমরা ফিরে গেলাম আমাদের হোটেলে।
পরদিন সন্ধ্যায় গাড়ি চালিয়ে মীর আকরাম নিজেই এসে হোটেল থেকে মনির ও আমাকে নিয়ে গেলেন তার সরকারি বাসায়। হোটেল থেকে তার বাসা খুবই কাছে। আকরাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করে বিসিএস ফরেন ক্যাডারে চাকরি নিয়ে শ্রীলঙ্কায় আছেন গত চার বছর ধরে। বললেন, শ্রীলঙ্কা তার কাছে ভালই লাগে। কিন্তু তার স্ত্রীকে এমন মনে হলো না। এ বিষয়টি অবশ্য আমি ২০০৬ সালে বাহরাইনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বর্তমানে প্রয়াত রুহুল আমিনের স্ত্রীর মধ্যেও দেখেছি। বাঙালি মেয়েরা সব সময়ই বাবা-মা’র কাছাকাছি থাকতে চায়। যা হোক, এখানে এসে দেখা হলো আরও কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে। কেউ বেসরকারি চাকরিসূত্রে, কেউ ব্যবসায়িক কাজে, কেউবা ভ্রমণের উদ্দেশে সেখানে আছেন। আমাদের সঙ্গে তাদেরও দাওয়াত করেছেন আকরাম। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার নানা বিষয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা হলো। তারপরে বাঙালি খাবারের নানান আয়োজন। খাওয়া-দাওয়া করে আমরা ফিরে গেলাম হোটেলে। ফেরার সময় ভাবলাম বিদেশে-বিভূঁইয়ে এরকম বাঙালি আপ্যায়ণ বেশ আনন্দদায়ক।
ভারত মহাসাগরের কূলে জেগে থাকা দুই দেশ মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কা। মালদ্বীপে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ না হলেও শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অবস্থা কিছুদিন আগেও ছিল নাজুক। একজন বাঙালি ওখানে প্রায় কুড়ি বছর ধরে আছেন। তার কাছে শুনলাম- দ্বীপাঞ্চলের শ্রীলঙ্কার বিগত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা। এলটিটিই তামিল গেরিলাদের সঙ্গে সরকারের সংঘর্ষের কারণে অবকাঠামো কোনো উন্নয়ন হয়নি। টাইগার প্রভাকরণের কারণে হাজার হাজার বিদ্রোহী যোদ্ধা স্বদেশী বন্ধুদের সঙ্গে দিনের পর দিন যুদ্ধ করেছে। বহু মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। সুনামি আর সেই গৃহযুদ্ধ শেষে শ্রীলঙ্কা জেগে উঠছে সবুজ লতার মতো।
নীল জলে ঘিরে আছে দ্বীপ দেশ শ্রীলঙ্কা। ব্রিটিশরা বহু বছর আগে জেলে অধ্যুষিত এই দেশে প্রবেশ করেছিল। এর আগে পর্তুগীজ জলদস্যুরাও ছিল। নিজেদের শাসনের প্রয়োজনে এখানে সভ্যতার আলো জ্বালাতে শুরু করে ব্রিটিশরা। যেমনটা করেছে ভারত উপমহাদেশে। জেলে জীবন থেকে ধীরে ধীরে ব্রিটিশদের আলোর পথে ধাবিত হতে শুরু করল শ্রীলঙ্কানরা। ভারত থেকে যাওয়া কিংবা অনেকের মতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এই মানুষগুলো একদিন বুঝতে পারল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। আজ প্রায় ৯৮ শতাংশ লোক শিক্ষিত। শ্রীলঙ্কার রয়েছে অনেক ঐতিহ্য। নারকেল গাছে ছেয়ে আছে প্রায় সারা শ্রীলঙ্কা। মানুষদের অধিকাংশের গায়ের রং কালো এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। কলম্বো শহরের বিভিন্ন জায়গায় শত শত বৌদ্ধের মূর্তি রয়েছে। আমরা একদিন শহরের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মন্দির দেখতে গেলাম। রাসমী আমাদের গাইড করছেন। যাবার সময় দেখলাম শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি নদী। আমরা যখন ঘণ্টা খানেকের পথ পার হয়ে মন্দিরের সামনে পৌঁছলাম, তখন দুপুর গড়িয়েছে। বেশ গরম লাগছে। মন্দির এলাকা আমাদের দেশের মাজারের আশেপাশের জায়গার মতই। জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়। বিশাল এলাকা জুড়ে টিলার মত উঁচুতে বড় মন্দির। পাশাপাশি একটি পুরনো ও একটি নতুন মন্দির। পুরনো মন্দিরটি টেরাকোটার চমৎকার কারুকাজে সজ্জিত। ভারতীয় চার গবেষক ও ভুটানের গবেষক সেই স্থাপত্য নন্দিত নকশার ক্লিক ক্লিক ছবি উঠাচ্ছে। মন্দির জুড়ে বুদ্ধের নানান আকারের, নানান রকমের মূর্তি রয়েছে। অসংখ্য পর্যটক, দর্শক ঘুরে ঘুরে দেখছেন আর ভক্ত ও বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সেখানে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করছে। আমরাও মন্দিরের ভিতর এবং বাইরের সব কিছুই দেখলাম। একজন মহিলা ভিক্ষুক আমাদের কাছে ভিক্ষা চাইল।
১৯৯৬ সালে রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয় করে শ্রীলঙ্কা। ক্রিকেটে তারা এখন অনেক শক্তিশালী। বিশ্বকাপ ২০১১ শুরুর আগ মুহূর্ত তখন। কলম্বো শহর সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। দেখলাম প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম ও সিগিরিয়া যাবার পথে আরও একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। শহরের মোড়ে মোড়ে বিশ্বের সেরা সেরা ক্রিকেটারদের ছবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড টানানো হয়েছে। তিন দেশ মিলে এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন করছে। বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কা। ভেনু হিসেবে বাংলাদেশও প্রস্তুত। উদ্বোধনীসহ আটটি ম্যাচ হবে বাংলাদেশে। পাকিস্তান পারেনি বলেই বাংলাদেশ এই সুন্দর সুযোগটি পেয়েছে।
একদিন দেখতে গেলাম শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল মিউজিয়াম। শহরের প্রাণকেন্দ্রের বড় চত্বরের মাঝে সাদা বিল্ডিংয়ের জাদুঘরটিতে রয়েছে শ্রীলঙ্কানদের অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানান নিদর্শন। সেই আদি জেলে জীবন থেকে বুদ্ধের ভাস্কর্য, অলংকার, পুতুল, অস্ত্র-শস্ত্র ইত্যাদি। নানান দেশের দর্শক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন শ্রীলঙ্কানদের জীবন ও ঐতিহ্য। জাদুঘরের দুইজন নারী অফিসার আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন আর বর্ণনা করলেন মিউজিয়ামে রাখা নিদর্শনের ইতিহাস।
রাজধানী কলম্বো থেকে প্রায় ৫ ঘণ্টার পথ পেরিয়ে যেতে হয় শ্রীলঙ্কার নান্দনিক শহর কেন্ডিতে। এ যাত্রায় যাওয়া হয়নি। যাওয়া হয়নি রত্নাপুরা, নিগাম্বু, ডাম্বুলা কিংবা মৃত নগরী অনরাধাপুর। তবে একদিন দেখতে গেলাম সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান সিগিরিয়া। সেদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় মাইক্রোবাসে কলম্বো থেকে যাত্রা করলাম সিগিরিয়ার উদ্দেশে। বাংলাদেশের মতই রাস্তার দু’পাশের গ্রামীণ পরিবেশ। ধানক্ষেত, নারিকেল বাগান আবার কখনও সমতল, কখনও পাহাড়ি উঁচু ভূমি চোখে পড়ছে। যেতে যেতে নাস্তার জন্য নেমে গেলাম এক জায়গায়। রাস্তার পাশে বিশাল একটি দিঘি। দিঘির কিনারে চমৎকার রেস্টুরেন্ট। বিভিন্ন পদের খাবার রয়েছে। খাবারের সঙ্গে ওরা সব সময় বিভিন্ন ফল রাখে। শ্রীলঙ্কান নিজস্ব কিছু খাবারও রয়েছে; কেউ কেউ তা খেলো। নাস্তা শেষে আবার আমরা যেতে শুরু করলাম। সেদিন ছিল বৃষ্টিভেজা দিন। থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। রোদও উঠছে।
সিগিরিয়া পৌঁছুতে প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগল। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই অসংখ্য দেশি-বিদেশি দর্শক বাংলাদেশের পাহাড়পুরের মত এক পুরনো নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দর্শনীয় স্থান উপভোগ করছে। সিগিরিয়ার মূল আকর্ষণ ছয়শ ফুট উঁচু পাথরের পাহাড় বা রক। অনেক দূর থেকে দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন রকটি। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার আগে দর্শক চারদিকের মনোরম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। পাদদেশে এক সময় একটি সভ্যতা ছিল। তারই চিহ্ন রয়েছে। এর রূপ দর্শন করে বিশিষ্ট লেখক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘সিগিরিয়া রক একসময় বনেজঙ্গলে ঢাকা পড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। দুজন ব্রিটিশ পর্যটক ১৮৫৩ সালে এর অস্তিত্ব খুঁজে পান। এরপর থেকে প্রতিবছর শত শত পর্যটক এখানে আসেন। মুগ্ধ হয়ে দেখেন যিশুখ্রিস্টের জন্মের ১৬০০ বছর আগের অপূর্ব স্থাপত্য।’
আমাদের গাড়ি যেখানে থামল সেখানে লাল সুরকি বিছানো চমৎকার রাস্তা। রাস্তার পাশেই টিকিটঘর। আমরা টিকিট কাটলাম। ওখানে টাকার বিনিময়ে গাইড পাওয়া যায়। আমরা একজন গাইড নিলাম। তিনি এক এক করে পৃথিবীখ্যাত ‘সিগিরিয়া রক’ বা ‘লায়ন রক’ সম্পর্কে আমাদের জানালেন। রাজা কাশ্যপ নামে খ্রিস্টের জন্মের আগে শ্রীলঙ্কার এক নৃপতি ছিলেন। ভারতীয় জলদস্যু এবং সৎভাই ম্যাগনোলার ভয়ে তিনি এই পাথরের প্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাসাদে একটি সুইমিংপুল, পাঁচশ রক্ষিতা ছিল। এখনও পাহাড়ের গায়ে এদের অর্ধ-নগ্ন ও নগ্ন চিত্র আঁকা আছে। ভীতু রাজা সব সময় দূর্গের ভিতর অবস্থান করতেন। একদিন ম্যাগনোলা বিশাল হাতির বহর নিয়ে আক্রমণ করে সেই দূর্গ। সুসজ্জিত সেনাবাহিনীসহ রাজা কাশ্যপ পরাজিত হয়ে আত্মহত্যা করেন। দর্শনীয় এই রকটি দখলে আসে বীর ম্যাগনোলার। তারপর এতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাস করতে শুরু করে।
টিপটিপ বৃষ্টির ভেতর অসংখ্য দর্শক ও পর্যটক ছবি তুলছেন আর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছেন। এভাবে ওঠা অত্যন্ত কঠিন বৈকি! ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তবু শত শত পর্যটক উঠছেন, দেখছেন, আনন্দ পাচ্ছেন। এঁকে বেঁকে কখনও লোহার সিঁড়ি, কখনও কাঠের, কখনও বা পাকা সিঁড়ি বেয়ে আমরাও উপরে উঠছি। নিচের দিকে তাকালে ভয় লাগে। চারশ ফুট ওঠার পর একটু সমতল জায়গা রয়েছে। এখানে বসে বিশ্রাম করা যায়। দাঁড়িয়ে দূর পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যায়। গল্প শোনা যায়। এই স্থানে এসে মনে পড়ল, সিলেটের তামাবিল দিয়ে ডাউকি হয়ে শিলং ও চেরাপুঞ্জি যাওয়ার কথা। ৩ হাজার, ৪ হাজার, ৫ হাজার ফুট ভিজিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। এ যেন এমন নিবিড় এক অনুভব, এক অন্যরকম আনন্দ-অনুভূতি, এক নান্দনিক ভালোলাগা জীবনের গল্প। অঝর বৃষ্টির ধারা, যে কারণে সবুজ পাহাড় শাদা হয়ে গেছে। মেঘগুলো এসে বার বার খাবি খাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে, সেই সাথে আমাদের গায়েও। সম্পূর্ণ পাথরের পাহাড়। একদম চূড়ায় শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই তর তর করে উঠে যাচ্ছে। তারপর পাহাড় বিজয় শেষে এক এক করে নেমে আসছে সকলেই। আমরাও নেমে এলাম এক সময়। পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই পর্যটক আসুক না কেন এই পাহাড়-চূড়া ছুঁয়ে যাবেনই।
কলম্বোর প্রাণ কেন্দ্রে গলফেইস। আমরা যারা কক্সবাজারের বিশাল সমুদ্র সৈকত দেখেছি, তারা কেউ কেউ হয়ত আহত হবেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হাউসের পাশে স্বল্প দৈর্ঘে্যর সমুদ্র সৈকতের রয়েছে আলাদা আনন্দ। শহরবাসী ও পর্যটকরা সেখানেই আনন্দ কুড়াচ্ছেন। বিচ বা সৈকত বেশি বড় নয়। পড়ন্ত বিকালের মিষ্টি রোদে আমরা হাঁটছি। ভারতীয় গবেষক বন্ধুরা, নানা এঙ্গেলে ছবি তুলছেন। সৈকতের সোনালি বালিতে সাগরের নীল জলের মৃদু ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সমুদ্রে নামার জন্য সৈকতের মাঝমাঝি স্থানে একটি কাঠের অস্থায়ী সেতু এবং সিঁড়ি স্থাপন করা হয়েছে, যা দিয়ে সমুদ্রবিলাসী পর্যটক, দর্শকরা নামছে ও উঠছে। সমুদ্র মানেই ভাললাগা, সমুদ্র মানেই অজানা সুরে ভেসে যাওয়া। কিন্তু এই ভাললাগার ক্ষণটি বেশি সময় টিকল না। হঠাৎ করেই এক পশলা বৃষ্টি এলো। ভিজিয়ে দিতে চাইলো আমাদের সকল আনন্দ। গাইড রেশমির ডাকে আমরা সবাই মাইক্রোবাসে উঠে এলাম। আমাদের সমুদ্রের পাড় ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা দেখছি, একদিকে সমুদ্রের সৌন্দর্য অন্যদিকে কলম্বো শহরের সৌন্দর্য। আমাদের গাড়ি থামল একটি কারুশিল্প বিক্রয় কেন্দ্রের সামনে। এতে শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পের নানান পশরা রয়েছে। ক্রেতা অধিকাংশই বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ভ্রমণপিয়াসী মানুষ। শ্রীলঙ্কার পাথর জগৎ বিখ্যাত। নীলা বা পদ্মরাগ মণি, রুবি, গার্নেট, ক্যাটস আই, এমেথিস্ট, টোপাজ ইত্যাদির রত্নভাণ্ডার। আমার ব্যক্তিগতভাবে পাথরের প্রতি তেমন আগ্রহ নেই, তবু দেখার জন্যই দেখলাম দামি দামি কিছু পাথরের কাজ। দেখার আরও একটা কারণ দেশের অনেক পরিচিতজন শ্রীলঙ্কা থেকে পাথর আনার জন্য বলেছেন। যাহোক ব্যাটে-বলে মিলল না, পাথরও কেনা হলো না।
শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরবার আগের সন্ধ্যায় কলম্বোর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে ডিনারের আমন্ত্রণ পেলাম আমরা। সেখানে খাবারের বাহারি আয়োজন। ডিনারের আগে আমাদের নেওয়া হলো হোটেলের পাশেই একটি গ্রামীণ পরিবেশে। গ্রামীণ পরিবেশ বলতে, একটি বিশাল পুরনো বটগাছের তলায় শ্রীলঙ্কার প্রাচীন গ্রামের মডেল তৈরি করা হয়েছে। যেখানে গ্রামের ঘর-বাড়ি, গাছ-গাছরা, খাবার-দাবার, গান-বাজনা সবকিছুই রয়েছে। টিম টিম করে হ্যারিকেন বাতি জ্বলছে, সেই আলোয় রান্না করছেন গ্রামীণ নারীরা। নারকেলের তৈরি নানান রকমের খাবারসহ বিভিন্ন উপাদানের খাবার পরিবেশিত হচ্ছে অতিথিদের জন্য। আমাদেরকেও দেওয়া হলো সেইসব খাবারের কিছু কিছু অংশ। সেইসাথে শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সেদেশের প্রাচীন জীবনের ইতিহাস বললেন একজন ভদ্রলোক। এরপর আমরা মূল ডিনারে অংশ নিলাম। অনেক ধরনের খাবার। খাওয়ার সঙ্গে চলল গান। ভাষা না বুঝলেও সেদেশের ফোক গানের সুর আমাদের কিছুক্ষণ টানল।
নীল জলের দ্বীপভূমি সিগিরিয়ার দেশ ছেড়ে আমরা ফিরে এলাম পরদিন আপন আলয়ে। দ্বীপ দেশের ভালবাসা আমাদের সত্যি মুগ্ধ করেছে। হয়ত আবার কখনও যাবো, হয়ত কখনও আর যাওয়া হবে না কিন্তু শ্রীলঙ্কা ভ্রমণস্মৃতি মনে থাকবে বহুদিন, বহুদিন, বহুদিন।
সূত্র : রাইজিংবিডি