নাবীল অনুসূর্য
চণ্ডীগড়—ভারতের প্রথম পরিকল্পিত নগরীগুলোর একটি। শহরটির নকশা করেন সুইস-ফরাসি স্থপতি লু কোহবিজিয়ে। সাজানো-গোছানো এই শহরে প্রতিবছরই অসংখ্য পর্যটক বেড়াতে আসে। তবে মজার বিষয় হলো, শহরটির সবচেয়ে বড় পর্যটক আকর্ষণকারী যে পাথর-বাগান, সেটি কোহবিজিয়ের মূল পরিকল্পনায় আদৌ ছিল না। পাথর-বাগানটি গড়ে তোলেন নেক চাঁদ নামের এক ভারতীয়। তা-ও রীতিমতো লুকিয়ে-চুরিয়ে।
এই নেক চাঁদ ছিলেন চণ্ডীগড় ক্যাপিটাল প্রজেক্টের প্রকৌশল বিভাগের একজন সড়ক পরিদর্শক। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়ই ১৯৫৭ সালে তিনি তাঁর শখের এই গোপন প্রজেক্টের কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন অফিস শেষ করে নেক চাঁদ চলে যেতেন বর্জ্যাগারে। শিবালিক হিলের নিচে, লেকের কাছেই সেই বর্জ্যাগার। সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে বের করতেন তাঁর শিল্পকর্মের কাঁচামাল—মাটির তৈজসপত্রের ভাঙা টুকরা, ফেলে দেওয়া বোতল, গাড়ির বাতিল যন্ত্রাংশ, বাড়িঘরের নষ্ট পাইপ-ফিটিংস, পরিত্যক্ত সড়কবাতি, অকেজো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ভাঙা স্যানিটারি। তারপর এসব নিয়ে চলে আসতেন পিডাব্লিউডির একটা গুদামে। সেটিই ছিল তাঁর ওয়ার্কস্টেশন। সেখানে বসে-বসেই ওসব বাতিল আর অকেজো জিনিসপাতি দিয়ে তৈরি করতেন অসাধারণ সব শিল্পকর্ম—বিভিন্ন গড়নের শৈল্পিক সব ভাস্কর্য। কোনোটি মানুষের গড়নের, কোনোটি আবার পশুপাখির।
নেক চাঁদের ভয় ছিল, কর্তৃপক্ষ জানতে পারলে তাঁর এই শিল্পসাধনা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই পুরো ব্যাপারটি তিনি গোপন রেখেছিলেন। ভাস্কর্যগুলোর কথা গোপন রাখতে কেবল রাতের আঁধারেই কাজ করতেন। তাঁর এই পাথর-বাগানের কথা তিনি গোপন রেখেছিলেন পুরো ১৮টি বছর। আর যখন এটি মানুষজন খুঁজে পায়, তত দিনে এই বাগানের মোট আয়তন গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১২ একর। ইতিমধ্যে পিডাব্লিউডির বিভিন্ন পরিত্যক্ত জায়গাজুড়ে তিনি এই বাগান গড়ে তুলেছেন। জায়গাগুলোর একটি থেকে আরেকটিতে যাওয়ার রাস্তাও আছে। আর প্রতিটিতেই শখানেক পাথরের মূর্তি; নৃত্যরত-গীতরত মানুষের মূর্তি, পশুপাখির মূর্তি।
আবিষ্কারের পরপরই, নেক চাঁদের যেমনটি ভয় ছিল, তেমনটিই ঘটল। সেখানে এমন বাগান গড়ে তোলার কোনো অনুমতি নেক চাঁদের ছিল না। কাজেই কর্তৃপক্ষ বিনা অনুমতিতে গড়ে তোলা এই পাথর-বাগানের ব্যাপারে খড়গহস্ত হলো। বাগানটি উঠিয়ে দেওয়ার নোটিশ জারি করল। কিন্তু বাদ সাধল জনগণ। তাদের দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত বদলাল সিদ্ধান্ত। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নেক চাঁদের পাথর-বাগানের উদ্বোধন হলো। নামকরণ করা হলো ‘রক গার্ডেন’। আর নেক চাঁদকে করা হলো সেই রক গার্ডেনের সাবডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার। সঙ্গে এই পাথর-বাগান গড়তে-সংরক্ষণ করতে তাঁকে দেওয়া হলো ৫০ জন শ্রমিক।
ধীরে ধীরে চণ্ডীগড়ের এই পাথর-বাগানের খ্যাতি শহরের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। যে পাথর-বাগান ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহরের মূল নকশায় ছিলই না, শহরটির সবচেয়ে বড় পর্যটন-আকর্ষণ হয়ে ওঠে সেটিই। বর্তমানে এই পাথর-বাগানের আয়তন প্রায় ৪০ একর। এই ৪০ একর জায়গাজুড়ে নেক চাঁদ যত ভাস্কর্য গড়েছেন, সবই পরিত্যক্ত-বাতিল-অকেজো জিনিসপত্র আর আবর্জনা দিয়ে। তাঁর এই শিল্প প্রতিভার জন্য ভারত সরকার তাঁকে দেশটির চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘পদ্মশ্রী’তেও ভূষিত করে। এমনকি ১৯৮৩ সালে ভারতে এই পাথর-বাগানের ছবি দিয়ে ডাকটিকিটও প্রকাশ করা হয়। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ